Alapon

কাসেম সুলাইমানি, শিয়া এবং একবিংশ শতক...


৩ রা জানুয়ারি, ২০২০৷ ভোরবেলা, শুক্রবার৷ একটা বিশেষ বিমান এসে নামে বাগদাদের এয়ারপোর্টে৷ পৃথিবীর অন্যতম সুরক্ষিত বিমানবন্দর এটা৷ ব্যক্তিগত বিমান থেকে ধীরে ধীরে নেমে এলেন একজন জেনারেল৷ তার পদ ধীর ও স্থির৷ কোন রকম ভয় বা দ্বিধা নেই৷ কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই তিনি সামনে পা বাড়ালেন৷ তার জন্য অপেক্ষা করছিল তারই পুরোনো সহোযোগী আবু মাহদি আল-মুহান্দিস৷ এই মুহান্দিস জেনারেলের বড়ই বিশ্বস্ত ছিলেন৷ দুজনের প্রায়ই দেখা হয়৷ জেনারেল বাগদাদের মাটিতে যখন তখন উড়ে আসতে পারেন৷ সেদিনও তিনি বাগদাদে উড়ে আসেন এক বিশেষ বৈঠকের জন্য— একটা বিষয়ে জরুরি বৈঠক সারতে।

দুজনে তারা সামনে পা বাড়ালেন৷ দুটো গাড়ি অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য৷ প্রথম গাড়িটায় জেনারেল ও তার বন্ধু মুহান্দিস উঠলেন৷ পেছনেরটায় আছে দেহরক্ষীরা৷ গাড়ি চলতে শুরু করল৷ বিমানবন্দর ছাড়িয়ে গেল৷ আরেকটু এগুল গাড়ির চাকা৷ তখনই পরপর দুটো মিসাইল এসে আঘাত হানল প্রথম গাড়িটায়৷ তার পরই তৃতীয় মিসাইল এসে উডিয়ে দিল দ্বিতীয় গাড়িটাকে৷ লণ্ডভণ্ড গাড়িতে আগুন জ্বলতে লাগল দাউদাউ করে৷ দুমড়ে মুচড়ে গেল সব৷ সকলেই মারা গেল৷ ইরানের কাসেম সুলাইমানি মারা গেলেন এই মিসাইলের আঘাতে৷



কাসেম সুলাইমানির মৃত্যুতে দুরকম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এক, রাজনীতির নতুন মেরুকরণ। দুই, শিয়া-সুন্নির ঐক্যের আলোচনা। রাজনীতির মেরুকরণ আমাদের আলোচ্য নয়। ঐক্যের বিষয়টা হলো ধর্ম-সম্পর্কীয়। কারণ শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ পৃথিবীর প্রাচীন দ্বন্দগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই দ্বন্দ সম্পূর্ণই ইসলাম-সম্পর্কীয়৷

পৃথিবীর কিছু দ্বন্দ যেন শেষ হবার নয়। তা যেন চলবে এবং চলতে থাকবে নিরবধি। তার মধ্যে অন্যতম শিয়া ও সুন্নির দ্বন্দ। এই দ্বন্দ নিয়ে আমাদের দেশেও আলোচনা হয়। পত্রিকায় কলাম লেখেন বুদ্ধিজীবীরা। আন্তর্জাতিক মহলে শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ "হট টপিক"। সভা-সেমিনার, টকশো এবং বিস্তর লেখাজোখা হয় এর ওপর। শিয়া-সুন্নির মাঝে ঐক্যের প্রয়াসী নানান উদ্যেগ দেখা গেছে বিভিন্ন সময়ে। একবিংশ শতকে এসে ২০২০ সনে সেই ঐক্যের কথা উঠেছে। সুলাইমানির মৃত্যুর পর নতুনভাবে, বলা উচিত নবউদ্যমে, শিয়া ও সুন্নির ঐক্যের কথা চাউর হয়েছে মানুষের মাঝে। অধুনার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা নিয়ে, রীতিমতো, ঝড় বয়ে গিয়েছে। এখনও যার রেশ কাটছে না৷ দুরকম প্রতিক্রিয়া দেখেছে সাধারণ মানুষ। অবশ্য দুপক্ষের আলোচনা থেকে তেমন কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারে নি কেউ- বলা ভালো অধিকাংশই। মিলনকামীদের আছে আবেগ৷ আর আমাদের কাছে নেই পূর্ণ তথ্য৷

মিলনের পক্ষের আবেগটাই আগে দেখা যাক...

বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব সবেচে’ সঙ্কটাবস্থা পার করছে। তাদের শত্রু এখন আর বহিরাগত নয়। বরং ভেতরের মুনাফিক তলে তলে হাত মিলিয়েছে কাফের শক্তির সঙ্গে। এই মুহূর্তে আমাদের উচিত এক হয়ে তাদের বিরূদ্ধে লড়াই করা। আমেরিকা ও জায়োনবাদের জোট বিশ্ব জুড়েই নৈরাজ্য চালাচ্ছে। তাদের হাতের মুঠোয় পুরো বিশ্ব। মুসলিমদের ঘরে ঘরে শত্রু তৈরী করে রেখেছে তারা৷ এমন সঙ্গিন সংকটকালে মুসলিমদের চাই এক হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

আমেরিকা বর্তমানে মুসলমানদের অন্যতম দুশমন। জায়োনবাদের কৌশলের সঙ্গে একীভূত হয়ে সাম্রাজ্য বিস্তারের আগ্রাসন চালাচ্ছে তারা- যা অজানা নয় কারও কাছেই। মুসলিমদেরকে নিজের ভূমিতেই করে রেখেছে কোণঠাসা। এই মুহূর্তে যিনি বা যারাই আমেরিকার চক্ষুশূলে পরিণত হবেন। তারাই মুসলিমদের কাছে পাবেন একটা বিশেষ মনোযোগ। এই বাড়তি মনোযোই কেড়েছে ইরান। আমেরিকা যখন কাসেম সুলাইমানিকে হত্য করেছে। সুতরাং তিনি আমেরিকার বন্ধু নন। যে আমেরিকার শত্রু, মুসলিমদের বন্ধু সে। ‍এবং তাই কাসেম সুলাইমানি শুধুই ইরানের জেনারেল নন। তিনি বরং মুসলিমদের জন্যই ছিলেন আশির্বাদ স্বরূপ। এবং তিনি শহিদ। মহাবীর কাসেম সুলাইমানি(!)

এই আবেগটাই কাজ করে তাদের মগজে। শিয়ারা সুলাইমানির হত্যাকে কেন্দ্র করে ঐক্যের ডাককে আরও মজবুত করার চেষ্টা চালায়৷ যূথবদ্ধভাবে একটা সংহত প্লাট ফর্ম তৈরী করার চেষ্টা তারা করেছিল। তাদের এই চেষ্টা নতুন নয়। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকেও শিয়াদের সঙ্গে ঐক্যের ডাক দিয়েছিল ইরানের, শিয়া ইমাম, খোমিনী। তখনও আবেগ এসে ভর করেছিল আমাদের ওপর। এই আবেগটার পেছনে অবশ্য লুকিয়ে আছে বিষন্নতা। চারিদিকে যখন কেবলই আঁধার দেখা যায়। তখন টিমটিমে আলোকেও মনে করা হয় রত্ন। কিন্তু আলোটা যে বোমার সুতোয় লাগানো আগুন। তা বুঝতে পারি না আমরা অনেকেই। না বুঝেই কাছে যাই উষ্ণতার জন্য। সব আঁধার পেরিয়ে যখন ওঠে ভোর। তখন কেটে যায় আঁধারের ঘোর। তবে সময়ের সেই ব্যবধানেই যার ধ্বংস হবার। সে নিপতিত হয় অধপাতে।

মিলন কামীরা এবার যুক্তির অবতারণা করেন। তারা বলেন, ইসলামের মাঝে মাযহাবি মতপার্থক্য বেশ পুরোনো। মাযহাব হচ্ছে ইসলামকে সহজ করার জন্য। সুতরাং শিয়াও তেমনই একটা মাযহাব। মাযহাবে মাযহাবে কিছু আমলগত পার্থক্য বিদ্যমান। এবং তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে কোরআন ও সুন্নাহর দলিল। শিয়ারা যেইভাবে ইবাদত করে। তাতে বেশ কিছু পার্থক্য দেখা যায়। তা মূলত কোরআন ও হাদিছ থেকেই নেয়া। এই ঠুনকো কারণকে উপলক্ষ করে দ্বন্দ জিইয়ে রাখার কোন যৌক্তিকতাই নেই।

এইখানে এসে অনেকেই একটু ধন্দে পড়ে যান৷ কেবলই হানাফি ও শাফীর মতো বিষয়? শিয়া-সুন্নির মাঝের বিরোধ কী আমলগত? কেবল ইবাদত নিয়ে মতোবিরোধ চলমান এই দুয়ের মাঝে? এতোই মতোবিরোধ যে যুদ্ধ করতে হচ্ছে? রক্তপাত ঘটাচ্ছে নামাজ পড়ার পদ্ধতি নিয়ে? তা-ও আবার যুগ যুগ ধরে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই না আমরা৷

যারা শিয়ার বিপক্ষে অবস্থান করেন৷ তারাও মূলত জোরালো কোন কথা বলতে পারেন না৷ আমরা কেবল জানি যে, শিয়া দলটা হক নয়৷ তারা (শিয়ারা) যদিও একমাত্র নিজেদেরকেই হক বলে দাবী করে৷ কিন্তু তারা হক নয়৷ সাহাবাদের তারা গালি দেয়৷ আমরা এরকমই জানি কেবল৷ না জানি মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দের রাজনৈতিক হাকিকত৷ না জানি প্রায় বারোশ বছর ধরে চলা শিয়া মতবাদের ভেতরের কথা! নিচের প্রশ্নগুলোর সদুত্তর নেই আমাদের অনেকের কাছেই৷

শিয়া আসলে কী? কেবলই মাযহাবি পার্থক্য তাদের সঙ্গে? যেমনটা শাফিয়ি-মালিকী-হাম্বলি ও হানাফিদের মধ্যে চলে! নাকি আকিদাগত দিকটাই সর্বাগ্রে বিবেচ্য? কী আকিদা শিয়াদের? ইত্যাদি প্রশ্নগুলোর সমাধান না শিয়ারা স্পষ্ট করে। আর না আমরা জানি তার উত্তর। আমাদের মাঝে কেউ চান আবেগের মিলন। যারা চান না তারাও জানেন না, ঠিক কী কারণে শিয়ারা নয় আহলে সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত।

আলোচনার সংকট

শিয়া-সুন্নির ঐক্যের আলোচনায় তাই দেখা যায় একটা সংকট। উভয় দলই একটা ধোঁয়াশার মধ্যে থাকে। বস্তুত জলটা ঘোলা করে শিয়ারাই। কারণ তাদের একটা আকিদা হলো তাকিয়া। যার মূল কথা হলো, শিয়া নয় এমন কারো কাছে আসল কথা বলা যাবে না। শিয়ারা তাই তাদের মৌলিক আকিদা নিয়ে কোন কথা বলে না। বাংলা ভাষায় তো দূরে থাক। স্বয়ং আরবিতেও তাদের মৌলিক গ্রন্থাবলি পাওয়া দুষ্কর। তারা সেগুলো শুধু নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। তারাই চর্চা করে৷ ফলে তাদের আকিদা নিয়ে তেমন জানা-শোনা নেই আমাদের।

ফলে আমরা যারা আহলে সুন্নাহর অনুসারী তাদের মধ্যে দুটো সমস্যা দেখা দেয়।

এক, আলেম সমাজের না-জানা৷ আমরা, মাদরাসা পড়ুয়ারা, শিয়া সম্পর্কে তেমন কোন তথ্যই পাই না। বরং সামান্য কিছু জানতে পারি মাত্র। এই স্বল্প জ্ঞান দিয়ে শিয়া নিয়ে কোন অবস্থানই আমাদের জোরালো নয়। বাংলা ভাষায় তেমন কোন মৌলিক বইও রচিত হয়েছে বলে দেখা যায় না। আরবি বইও হাতের নাগালে নেই। আমাদের অনেক মাদরাসা পড়ুয়ারাই শিয়াদের সঙ্গে ঐক্যের মাঝে কোন সমস্য খুঁজে পান না। সমস্যা না জানলে তা খুঁজে পাওয়া যাবে কীভাবে?

মাওলানা মনযূর নোমনী রহঃ লিখেন- এস্থলে আমি সত্য প্রকাশে কুণ্ঠবোধ করি না যে, আমাদের জনগণ, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিক ও সুধী বর্গের তো কথাই নেই, আমরা যারা মাদ্রাসা ও উচ্চ দীনী প্রতিষ্ঠান সমূহে শিক্ষা অর্জন করে “আলেমে-দ্বীন”-রূপে কথিত ও গণ্য হই, তারা সাধারণভাবে শিয়া মাযহাবের বুনিয়াদী মূলনীতি ও আকায়েদ সম্পর্কেও সম্যক অবগত নই।

তিনি আরও বলেন- এক্ষেত্রে এ সত্য প্রকাশও সমীচীন মনে করি যে, শিয়া মাযহাব সম্পর্কে আমাদের সুন্নী আলেমগণের অজ্ঞতার একটি বিশেষ কারন আছে। তা এই যে, শিয়া মযহাবে দ্বীন ও মযহাবকে গোপন করার ও প্রকাশ না করার অত্যন্ত জোরদার নির্দেশ রয়েছে। আমি যতদূর জেনেছি এবং অধ্যয়ন করেছি- বিশ্বের সকল ধর্ম ও মযহাবের মধ্যে এটা কেবল শিয়া মযহাবেরই বৈশিষ্ট। ( ইরনী ইনকিলাব ইমাম খোমেনী ও শিয়া মতবাদ। পৃ, ৩)

দুই, আধুনিক শিক্ষিতদের মাঝে আকিদার গুরূত্ব কয়েক শতক থেকেই হ্রাস পেয়েছে বলা যায়। এবং তার উৎকট প্রকাশও দেখেছি আমরা বিভিন্ন সময়ে। তারা কেবল চান ইসলামি শক্তির উত্থান। ইতিহাসে মুসলিমদের এতো এতো বিরত্বগাঁথা তারা কেবল শুনেই এসেছেন। কিন্তু তা এখন নেই কেন? তাদের সোজা উত্তর- আমাদের মাঝে ঐক্য নেই বলে। সুতরাং চাই ঐক্য। এমনকি তা যদি হয় শিয়াদের সঙ্গে। তবু তা-ই সঁই। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হয়ে শক্তি অর্জন করাই আসু প্রয়োজন।

ইসলামের প্রধান শক্তিই হলো তার আকিদা। যদি এই আকিদাই নষ্ট হয়ে যায়। তবে তার শেকড়ই নষ্টই হয়ে গেল যেন। কিন্তু আকিদার পাঠ ও তার গুরূত্ব আমাদের মাঝে প্রবলভাবে নেমে গেছে। ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় মুসলিমরা যেখানেই গেছেন। সেখানেই তারা প্রচার করেছেন ইসলামের কালিমা। এই কালিমাই তো দেয় আকিদার প্রথম সবক। আমরা শক্তি অর্জন করে কী করবো? এই আকিদাই তো প্রচার করবো। যদি তা-ই নষ্ট হয়ে যায়। তবে ইসলাম তার আবেদন হারাবে নিদারুণ ও করুণভাবে। আমরা নিশ্চিয়ই এর জন্য ঐক্য চাই না যে, শক্তি বৃদ্ধি করে অমুসলিমদের গণহারে হত্যা করবো- যেমনটা তারা আমাদের সঙ্গে করছে। তাদের দেশ দখল করে চালাবো বর্বরতা- লুণ্ঠন ও জঘন্য কর্মকাণ্ড। দীন বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীর সুপার পাওয়ার হবার কোন অভিলাষ থাকতে পারে না একজন মুসলমানের। বরং আমাদের জিহাদ তো হবে আকিদা প্রতিষ্ঠারই জন্য।

হাদিসে এসেছে- وعن أبي موسى عبد الله بن قيس الأشعري رضي الله عنه قال: سئل رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الرجل يقاتل شجاعة، ويقاتل حمية ويقاتل رياء، أي ذلك في سبيل الله ؟ فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: من قاتل لتكون كلمة الله هي العليا فهو في سبيل الله متفق عليه .

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, এক লোক বিরত্ব দেখিয়ে লড়াই করে, আরেকজন করে শক্তি দেখিয়ে, অন্যজন করে লোক-দেখানোভাবে। এর মধ্যে কোনটা আল্লাহর রাস্তায় বলে গণ্য হবে? রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কালিমা উঁচু করার জন্য লড়াই করে। সেই হলো আল্লাহর রাস্তায়। (রিয়াদুস সালিহীন)

যদি শক্তি অর্জনই আমাদের মূল লক্ষ হয়ে থাকে। তবে আমরা কেন কাদিয়ানিদের সঙ্গে ঐক্য করছি না? এর উত্তর আমাদের সকলেরই কম বেশি জানা। কারণ তাদের সঙ্গে ঐক্য করলে আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শেষ নবী মানা হয় না। যা আমাদের একটা মৌলিক আকিদা। তো বলুন তো, আমরা কি এমন লোকদের সঙ্গে ঐক্য করতে পারি, যারা আমাদের কোরআনকে নির্ভুল মনে করে না? তাদের সঙ্গে ঐক্য, যারা বলে যে, সাহাবীরা কোরআন বিকৃত করেছেন? তাদের সঙ্গে ঐক্য, যারা মনে করে মাত্র তিনজন সাহাবী ব্যতীত বাকি সকল সাহাবীই কাফের হয়ে গেছেন? তাদের সঙ্গে ঐক্য, যারা আলি রাযিঃ-কে মনে করে নবীর সমান- তবে অন্য নবীদের চে’ শ্রেষ্ঠ? তাদের সঙ্গে ঐক্য, যাদের কাছে আহলে সুন্নাহর সকলেই কাফের? তাদের সঙ্গে ঐক্য, যাদের কাছে আমাদের ইমামগণ-ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফি, ইমাম হাম্বালি ও ইমাম মালেক সহ অন্যরা- কাফের? তাদের সঙ্গে ঐক্য, যারা আমাদেরকে নাপাক মনে করে? এবং আমাদের রক্ত যাদের কাছে হালাল, তাদের সঙ্গে ঐক্য?

সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলি নদবী রহঃ লিখেন- বর্তমানে অনেক অশুভচক্র কোরআন-হাদীস, পূর্ববর্তী মনীষীদের মতাদার্শ এবং আক্কীদা ও আদর্শের বিশুদ্ধতাকে প্রশংসা, দোষারোপ ও সমালোচনার মানদণ্ডরূপে বিবেচনা করে না। বরং ইসলামের নাম নিয়ে যে কোন একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ক্ষমতা দখল, কোন পাশ্চাত্য শক্তিকে হুমকী প্রদান কিংবা তাকে বেকায়দায় ফেলাটাই প্রিয় ও আদর্শ নেতা হিসেবে বিবেচিত হওয়ার মানদণ্ড বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।

তিনি আরও লিখেন- আমাদের নব্য শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে আক্কীদার গুরূত্ব আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেতে শুরু করেছে, এটা অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নবী-রাসূল ও অন্যান্যদের দাওয়াত এবং তাদের চেষ্টা-চরিত্রের উদ্দেশ্য ও চেতনায় এই আক্কীদা-বিশ্বাসই ছিল সর্বপ্রধান পার্থক্য নির্দ্ধারণী প্রাচীর, যাকে অতিক্রম করে যে কোন ধরনের আপোষ রফায় তারা কখনো সম্মত হননি। তাদের কাছে কোন কিছু গ্রহণীয়-পরিত্যাজ্য বা পছন্দনীয়-অপছন্দনীয় হওয়ার মানদণ্ড এবং মিল-অমিলের প্রধান শর্তই ছিল এই আক্কীদা। মুসলমানদের সীমাহীন দুর্বলতা সত্ত্বেও এই আক্কীদাগত দৃঢ়তা, স্থিরতা এবং লজ্জা ও সম্মানবোধের কারণেই ইসলাম আজ পর্যন্ত তার প্রকৃতরূপে বিদ্যমান রয়েছে। দ্বীনের ধারক-বাহকগণ এ ব্যাপারে কোন পরাশক্তি বা বিশাল রাজদণ্ডের সামনে নতি স্বীকার করেননি এবং তাদের কোন ভ্রান্ত বিশ্বাস বা দাবীর সামনে নীরবতা পালন কে বৈধজ্ঞান করেননি; মুসলমানদের পার্থিব স্বার্থ উদ্ধারের এবং মত-বিরোধ ও বিচ্ছিন্নতা থেকে আত্মরক্ষার লোভে কিংবা হাওয়ার তালে তাল মিলিয়ে তা গ্রহণ করে নেওয়া তো অনকে পরের কথা। (ইরনী ইনকিলাব ইমাম খোমেনী ও শিয়া মতবাদ, ভূমিক।)

এক্ষণে অনেকেরই টনক নড়ে যাবার কথা। আমরা আগে হয়ত কখনও শুনিইনি যে, এমন এমন আকিদাও কারো থাকতে পারে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হায়াত শেষ হবার পূর্বে আল্লাহ তাআলা তাকে জানিয়ে দিয়ে বলেছে যে, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। এবং তোমাদের ওপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম। এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দীন হিসেবে মনোনীত করে দিলাম। (সুরা মায়েদা, আয়াত ৩)

সুতরাং কোন সন্দেহ নেই যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দায়িত্ব পূরণ করেছেন। এবং তিনি আকিদার পতাকাবাহী এমন একদল সুসংগঠিত বাহিনী গড়ে রেখে গেছেন। যারা তার মৃত্যুর পর, জীবনবাজি রেখে হলেও, নির্মল আকিদা নিয়ে ছুটে যাবে পৃথিবীর দূরদূরান্তে। এবং ‍ইতিহাস তা-ই বলে।

কিন্তু ভাবুন তো একবার, ইসলামের প্রথম খলিফা কাফের! দ্বিতীয় খলিফা কাফের! তৃতীয় খলিফা কাফের! ভাবতে পারছেন? আরও ভাবুন, কোরআন, সেই খলিফদের হাতেই, বিকৃত হয়ে গেছে! আমরা যেই কোরআন প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর ধরে পড়ছি, যার ওপর করছি আমল৷ তা আসলে বিকৃত কোরআন! আসল কোরআন তবে কোথায়? ভাবতে পারছেন?

না এমনটা ভাবতে পারবে না কেউই৷

ধরুন আপনি বিশ্বদরবারে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গেলেন৷ ইসলামের মহত্ত্ব নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন৷ আবু বকর ওমরসহ সকল সাহাবীদের গুণগান গাইতে থাকলেন৷ তখন যদি কেউ প্রশ্ন করে যে, তোমাদের ইসলাম তো সেই চৌদ্দশত বছর আগেই বিকৃত হয়ে গেছে৷ আবু বকর ও ওমর তো মুসলিমই নয়৷ তখন আপনি কী উত্তর দিবেন? ইসলাম যদি তার শ্রেষ্ঠ লোকদেরই ধরে রাখতে মা পারে৷ তবে সেই ইসলামের আবেদন রইল কোথায়?

@Nayeem

পঠিত : ৬১৩ বার

মন্তব্য: ০