Alapon

কওম আর উম্মাহ শব্দটি সকল সংকীর্ণতার উর্দ্বে...



একদিন সকালে আমাদের জামেয়া কাসিমিয়ার সহপাঠী আবুল খায়ের আমাকে বললো, কোন এক শিবিরের নেতা নাকি তার পাওনা টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এলাকার ছেলে হিসেবে দায়বদ্ধতা আছে। ফলে টাকা আদায় করতে মাস্তানের বেশে বিকেলে সেই ছাত্রের বাড়িতে গেলাম। তাকে পেলাম না, বলা হলো সে লজিং থাকে। চলে গেলাম চান্দ্রা খাশের বাড়ির লজিং ঠিকানায়। গিয়ে দেখি আসরের জামায়াত হচ্ছে, কাচারীতে সেই ছাত্রই ইমাম। আবুল খায়েরকে বললাম, নামাজ পড়বি না। বললো, মুরব্বিরা বলছে ওদের পেছনে নামাজ পড়া জায়েজ নেই। ফলে আমারও জামায়াত গেলো।

নামাজ শেষ হওয়ার পরে তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলাম কেন সে পাওনা টাকা দিচ্ছে না। বললো, আমি তার কাছ থেকে কিছু কিতাব কিনেছিলাম। শর্ত ছিলো আমি আগে ভালো করে দেখবো, কিতাব ঠিক থাকলে টাকা দেবা। বাড়িতে আনার পরে দেখি সব পৃষ্টাই প্রায় বাতিল। তাছাড়া এর কদিন পরে আমাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেয়। আমি আলিয়াতে ভর্তি হয়েছি। এখন কওমী কিতাব দিয়ে কী করবো। তাকে ফেরত নিতে বললাম, সে বললো ফেরত নেওয়া যাবে না, টাকা দিতেই হবে।

আমি খায়েরকে বললাম, তুই না বললি টাকা পাওনা, এখন তো দেখি কিতাব বিক্রি করা টাকার হিসেব। কিতাব বিক্রি না করলে কি চলে না ? তোর আব্বার চাউলে গদি, যতদুর জানি তিনিও কিতাব বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। সে বললো, আমার কিতাব বিক্রি করেছি আমার প্রয়েঅজনে। সে কিনার সময় ভালো করে দেখতো। ছেলেটি বললো, আমি কি এতগুলো কিতাব এক সাথে চেক করতে পারি নাকি ? আমি বললাম, নারে ভাই এই ঝামেলায় আমি নাই। তুই পারলে কিতাবে দাম ছেড়ে দে।

চলে আসার সময় তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দিলো কেন ? সে অকপটে বলে দিলো, কে বা কারা যেন মুহতামিম সাহেবের কাছে নালিশ দিয়েছে আমি শিবির করি। তিনি আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছেন, আমি উত্তরে বলেছি মাদ্রাসায় কোন দল করি না, বাড়িতে গেলে শিবিরের লোকদের সাথে বসি। ব্যাস, এতেই আমাকে বের করে দিয়েছে। বললাম, শিবির করলে তাদের সমস্যা কোথায় ? বললো সে এক বড় ইতিহাস, যদি দেখা হয় আরেক দিন বলবো।

রাস্তায় এসে আমি খায়েরকে প্রশ্ন করলাম, কিরে তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দিলো কেন ? বললো, জামায়াত শিবির করা জায়েজ নাই। এরা নবী, সাহাবাদের দুশমন। বললাম, শিয়া টিয়া নাকি ? বললো, ওরকম কিছু না, তারা মওদূদীবাদী। জীবনের প্রথম মওদূদী সাহেবের নাম শুনে আমার কোন প্রতিক্রিয়াই হয়নি। বললাম, আচ্ছা তুই যে ছাত্রলীগ করস, তোর পুরো ফ্যামিলি আওয়ামী লীগ করে তাতে মুহতামিম সাহেবের কোন সমস্যা নাই ? তার কোন উত্তর নেই।

এবার বলি, সেই আবুল খায়ের এখনো জীবিত আছে এবং সেদিনের সেই পুরনো, ছেড়া কিতাব কিনে পড়ালেখা করা গরিব ঘরের ছাত্রটিও জীবিত আছে। দুজনের সাথেই আমার স্বাক্ষাত হয়। যাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো ভাগ্যক্রমে সে হিফজুল কোরআন পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত একটি মাদ্রাসার মুহতামিম অন্যদিকে আবুল খায়ের মাদ্রাসা পলাতক রক্তে মাংসে গড়া গোড়া সেকুল্যার। ইসলাম এবং ইসলামী গোষ্টীর সাথে তার আজন্ম শত্রুতা। তার পেছনে আমি বহু সময় দিয়েছি। আমার দোস্ত কাম মামু কবির প্রায়ই বলতো, মামু ওদের পেছনে আর সময় দিস না, রক্তে মাংসে ওরা আওয়ামী লীগ। হেদায়েত নসিবে নাই। আমি বলতাম, চেষ্টা করতে দোষ কী, আমার পুরস্কার তো আছেই।

আজকে সেই ভাইটির সাথে আমার স্বাক্ষাত হলো। তিনি জামায়াতের রোকন প্রার্থী। আলহামদুলিল্লাহ, আমি পুরনো ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়ার পরে তিনি বললেন, মজার বিষয় কী জানেন, আমাদের কে প্রায় সময় বলা হয় আমরা কেন আলেম তৈরি করি না। যখন প্রশ্ন করি, আমরা যে কামিল পাশ করলাম, আলেম হতে পারিনি ? তারা উত্তর দেয় আলিয়া মাদ্রাসায় আবার আলেম হওয়া যায় নাকি। যখন জানতে চাই তাহলে আমাদের কেন মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হলো , তখন তাদের উত্তর একটাই হয়, আমরা আমাদের ঘরানার বাইরের কাউকে বিশ্বাস করি না।

আসলে ওটা চরম মিথ্যা কথা। ওরা সেকুল্যার ফাসেকদের বিশ্বাস করতে পারে, কিন্তু ইসলামী আন্দোলনে বার বার কমিটমেন্টের উদাহারণ দেওয়া সংগঠন জামায়াত শিবিরকে বিশ্বাস করতে পারে না। এটাই হলো বাস্তবতা। আজকে আলিয়া আর কওমী বিভাজন টেনে যারা কিতাবী ইলমের বড়াই করে তারা কখনো আয়নায় মুখ দেখেনি যে, তারা মুলত কওমের না, উম্মাহর না, বিশেষ একটি মতাদর্শের সেবক।

কওমের হওয়া আর কওমী হওয়া ভিন্ন কথা। যেসব কারণে এই ভূখন্ডে দ্বীন পরাজিত, সেকুল্যার গোষ্টির মুখাপেক্ষী তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ইলমকে নিজেদের সম্পদ বানিয়ে নেওয়ার প্রাচীন পন্থার অন্ধ তাকলিদের প্রতি জোর দেওয়া। আমি বলি, কেয়ামতের ময়দানে বহু তালেবে ইলমের মামলার আসামী হওয়া থেকে উত্তম নয় কি ইলমের দুয়ারটা আল্লাহর বান্দাদের জন্য খাস করুন, আল্লাহর জন্য কাজ করুন। আল্লাহর কাছে কি জবাব দেবেন তার হিসেব আছে তো ?

বিদ্র- মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার আজকে ত্রিশ বছর পুর্নপ হলো বলে মনে হলো। আমি জানি অনেকেই হয়তো বলবেন করোনা বিপর্যয়ের সময় কেন এসব। আমি বলি, করোনাও কি আমাদের চোখ খুলতে পেরেছে, গোত্র, গোষ্টির সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দিয়েছে? ক্বলবই যদি অন্ধকার থাকে, ‍দুনিয়ায় দ্বিপ্রহর থাকলেই কি আর না থাকলেই কি।

@Apu

পঠিত : ৫২১ বার

মন্তব্য: ০