Alapon

মঙ্গল শোভাযাত্রা অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা নাকি সংস্কৃতি!



বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ভিনদেশী হিন্দুত্ববাদি সংস্কৃতি হলেও দীর্ঘদিন প্রগতিশীলরা এটাকে পাত্তা না দিয়ে পালন করে আসছে। গত বছর আনন্দবাজার পত্রিকায় পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা আর রমনা বটমূলের আয়োজনকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুজো মণ্ডপের উৎসব বলে সম্বোধন করে। কিন্তু তারপরেও সে মহোৎসব থেমে থাকেনি। কিন্তু বাস্তবতার নির্মম পরিহাসে আজ তারা পরাজিত।

আজ নেই সেই চারুকলায় উন্মাদনা, নেই রমনার বটমূলে ছায়ানটের গান, নেই মঙ্গল শোভাযাত্রা, পান্তা ইলিশ নেই, ধামরাইয়ের হাজরার শোভাযাত্রাও নেই, নতুন কাপড় নেই, মানুষের মুখে হাসি নেই, ঘরে স্বজন নেই, মেলা নেই, বাতাসা নেই, গরম জিলাপি নেই, ঢাক নেই, ঢোল নেই, তালপাতার বাঁশি নেই, রঙিন ঘূর্ণি নেই, হাওয়াই মিঠাই নেই, রাস্তাঘাটে মানুষ নেই, রবীন্দ্রনাথ নেই, লালন নেই, নজরুল নেই। নেই কোন শুভেচ্ছা বিনিময়।

অস্কারজয়ী ম্যুভি ‘লাইফ অব পাই” এর একটা দৃশ্যের গল্প বলি। ম্যুভির নায়ক ‘পাই প্যাটেল’ ছোটবেলায় একসাথে তিনটি ধর্ম পালন করত। সে প্রথমে মন্দিরে গিয়ে পূজা করে, তারপর মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করে, অতঃপর গির্জায় গিয়ে যীশুর মূর্তির সামনে প্রার্থনা করে! তার ধারনা এভাবে সে সকল ধর্মের গড/দেবতাকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হবে!

প্যাটেলের এমন উদ্ভট কার্যকলাপ দেখে তার বাবা মন্তব্য করেন- “মানুষ কখনো একসাথে দুইটা ধর্মে বিশ্বাস করতে পারে না। একসাথে একাধিক ধর্ম পালন করার মানে হল- তুমি আসলে কোনটাই বিশ্বাস করছ না। এভাবে তুমি সবগুলো ধর্মের সাথেই প্রতারনা করছ।”

আমাদের তথাকথিত প্রগতিশীল ও মডারেট মুসলিমরা তাই করে চলছে! একদিকে নিজেদেরকে তারা মুসলিম দাবী করছে, আবার আরেকদিকে মঙ্গল শোভাযাত্রা, হোলি, চৈত্র সংক্রান্তি ইত্যাদি ভিন্ন ধর্ম সংশ্লিষ্ট আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের পক্ষে নানান যুক্তি দাড় করাচ্ছে। অথচ ইসলাম এগুলো পরিস্কার ভাষায় নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

সে যায় হোক এখন পহেলা বৈশাখের ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক

নববর্ষ উদযাপন একটি পুরনো ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। তবে কবে থেকে মানুষ নববর্ষ বা বর্ষ গণনা শুরু করেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। মানব সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ সূর্য উদয়-অস্তের ভিত্তিতে রাত দিন গণনা শুরু করেছিল। কিন্তু মাস গণনার ব্যাপারটা শুরু করেছিল চাঁদের ভিত্তিতে। অর্থাৎ মানুষ চাঁদের ছোট-বড় হওয়া দেখে মাস গণনা করতো। এক শুক্ল পক্ষ অন্য শুক্ল পক্ষ কিংবা এক কৃষ্ণপক্ষ থেকে অন্য কৃষ্ণপক্ষ পর্যন্ত একমাস ধরে মাস গণনা করতো তারা। এভাবে ১২ চান্দ্র মাসে এক বছর গণনা করা হতো। পরবর্তীতে সৌর বছর দিয়ে বর্ষ গণনা করা হয়। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি এক নয়। কেউ গণনা করে চন্দ্রের ভিত্তিতে কেউ আবার সূর্যের ভিত্তিতে। আবার একদিন থেকেও সব বছর গণনা শুরু হয়নি। তাই বর্ষ গণনার ভিত্তি অনুযায়ী বিভিন্ন জাতি বিভিন্ন সময়ে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। যেমন ইরানের নববর্ষ ‘নওরোজ’ পালিত হয় বসন্তের পূর্ণিমায়। অন্যদিকে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ উদযাপিত হয় ১লা জানুয়ারি। আবার বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হয় গ্রীষ্মের শুরুতে অর্থাৎ ১লা বৈশাখে। হিজরি নববর্ষ পালিত হয় মুহাররমের ১ তারিখে। সব জাতির বর্ষ গণনা যেমন এক নয় তেমনি সব জাতির নববর্ষের উৎসবও অভিন্ন নয়। প্রত্যেক জাতি তার নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিতে নববর্ষ উদযাপন করে থাকে। বাংলা নববর্ষ উৎসবও পালিত হওয়া উচিত বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিতে। কৃষি নির্ভর বাঙালি জাতির নববর্ষ উদযাপন দরকার কৃষি সংস্কৃতির ভিত্তিতে।

নববর্ষ উদযাপনের ইতিহাসও অনেক পুরনো। প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে থেকেই পারস্যের ১১ দিনব্যাপী ‘নওরোজ’ পালিত হত। ব্যবিলনে নববর্ষ উৎসব উদযাপন হতো প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর আগেও। রোমানরা অনেক আগেই বসন্তকালের নববর্ষ উৎসব উদযাপন শিখেছিল ব্যবিলনীয়দের কাছ থেকে। ইহুদিরা নববর্ষ উৎসব ‘রাশ হুশনা’ পালন করতো খ্রিস্ট জন্মের অনেক আগ থেকেই। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান জগতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ি ১লা জানুয়ারি Happy new year পালিত হয়ে আসছে অনেক দিন থেকে। হিজরি নববর্ষ উৎসবের কোন আড়ম্ভরতা না থাকলেও আরবসহ গোটা মুসলিম বিশ্বেই প্রায় দেড় হাজার বছর যাবত এ দিবস পালিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ ‘পয়লা বৈশাখ’উদযাপিত হচ্ছে মাত্র কয়েক শতক ধরে।

ভারতবর্ষে মুগল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে হত, যা ছিল সবার জন্যই বিড়ম্বনার কারণ। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য মুগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০/১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন এবং তা কার্যকর হয় তাঁর সিংহাসন-আরোহণের সময় থেকে। হিজরি চান্দ্রসনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। নতুন সনটি প্রথমে ‘ফসলি সন’নামে পরিচিত ছিল, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা হয় মূলত আকবরের সময় থেকেই। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন। এ উপলক্ষে তখন মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। ক্রমান্বয়ে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে পহেলা বৈশাখ আনন্দময় ও উৎসবমুখী হয়ে ওঠে এবং বাংলা নববর্ষ শুভদিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।

মুগল সম্রাট আকবর তার সভাজ্যোতিষী আমীর ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর পরামর্শে হিজরি ৯৬৩ সনকে বাংলা ৯৬৩ সন ধরে বাংলা সন গণনার নির্দেশ দেন। পারস্যের (ইরানের) নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান ‘নওরোজ’ এর আদলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সূচনাও করেন তিনি। তার আনুকুল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হতো। ‘নওরোজ’ অনুষ্ঠানের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ‘মিনা বাজার’। আর এ মিনা বাজারের আদলে বাংলা নববর্ষ উৎসবে যোগ হয়েছে ‘বৈশাখী মেলার’। প্রকৃতপক্ষে বাংলা ‘নববর্ষ’ উৎসবের মূলে আছে মুসলিম ঐতিহ্য। উৎপত্তিগত দিক দিয়ে বাংলা সনের সাথে যেমন মুসলিম ঐতিহ্য জড়িত তেমনি নববর্ষ উৎসবের সাথেও জড়িত পারসিয়ান মুসলিম সংস্কৃতি। মুসলিম ঐতিহ্যের ভিত্তিতে বাংলা নববর্ষ চালু হলেও মুসলমানদের উদারতার কারণে তা সার্বজনীন অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।

এখানে একটা প্রশ্ন খুব গুরুত্বপূর্ণ। সম্রাট আকবর প্রবর্তিত সনের নাম বাংলা সন হবে কেন? মূলত এই সন আকবর এবং ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর আবিষ্কৃত নয়। এটি বহুবছর ধরে চলে আসা বাংলার মানুষদের মধ্যে প্রচলিত সন গণনা। বাংলার কৃষকগন সাধারণত ফসল রোপন ও ফসল কাটার জন্য এই সনের ব্যবহার করে আসছে। এদেশে মুসলিম সম্রাটরা আসারও অনেক আগে থেকেই এই সন গণনা করা হয়। ধারণা করা হয় রাজা শশাঙ্কের আমল (৫৯৩ খ্রিস্টাব্দ) থেকেই এর প্রবর্তন হয়। এটা সাধারণত শশাঙ্কব্দ নামেও পরিচিত ছিল। বাঙ্গালিদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। সেই সাথে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এই সনের ব্যপকতা কৃষক ছাড়া আর কারো মধ্যে ছিল না। সাধারণত হিজরি সাল অনুসারেই সব ধরণের কর্মকান্ড পরিচালিত হত। বাংলা সন অনেক পুরাতন হলেও সেখানে পহেলা বৈশাখ বা নববর্ষের উৎসব অনুপস্থিত ছিল। সেটা চালু হয় যখন এই বাংলা সনকে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য সম্রাট আকবর গ্রহন করেন।


মঙ্গল শোভাযাত্রা:

পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়, তার ইতিহাস মাত্র ২৭ বছর। ১৯৮৯ সালের আগে এরকম কিছু হতো না। ’আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান চালু করে চারুকলার কিছু ছাত্র। এর অন্যতম সংগঠক ছিলো শিল্পী তরুণ ঘোষ। পশ্চিম বাংলার বরোদায় আর্ট ইনিইটউটের ছাত্র ছিল সে। বরোদায় যেভাবে নতুন বছরকে বরণ করার জন্য নানা ফোক মোটিফ, মুখোশ ও খেলনার আয়োজন করে, সেই কনসেপ্ট আদমানী করে তরুণ ঘোষ এবার সাজায়। প্রথমে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। সেবার কিছু মুখোশ আর জীবজন্তুর প্রতীক ছিলো। পরে এটাকে আরো হিন্দুয়ানী করে নাম বদলে দেয়া হলো ”মঙ্গল শোভাযাত্রা।” এখন সেখানে হিন্দুদের প্রায় দেবদেবী, গনেশের বিভিন্ন প্রতিমা, রাক্ষস-খোক্কস, অসুর, আবার রাজাকার প্রতিকৃতি/মুখোশ বহন করা হয়। তাহলে, এই মঙ্গল শোভাযাত্রা কি করে আবহমানকালের ঐহিত্য হয়? আসলে শেয়াল-কুকুর আর ভুত-পেত্নীর মুখোশ পরে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তোলার এই ব্যর্থ চেষ্টা মিথ্যাচার ছাড়া কিছুই নয়।


পান্তা ইলিশ :

আর পান্তা-ইলিশও বাংলাদেশে প্রথম চালু হয় ১৯৮৩ সালের বৈশাখের সময়। দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ, কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল সহ কিছু তরুণ সাংবাদিক কবি প্রথম পান্তা ইলিশের আয়োজন করে রমনার বটমুল। জনপ্রতি পঁচ টাকা চাঁদা দিয়ে পান্তা ভাত, ভর্তা আর ডিম দিয়ে খাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ডিম বদল করে দেযা হয় ইলিশ ভাজা। সেই থেকে চালু হয়ে গেলো পান্তা ইলিশ কালচার । এর আগে পান্তা ইলিশ দিয়ে বর্ষবরনের কথা শোনা যায়নি। বর্তমানে এই পান্তা-ইলিশ নিয়ে এত বাড়াবাড়ি চলছে, যে মনে হয় এটা না খেলে বুঝি বর্ষবরন হবে না। এর চাপ পড়েছে মাছের বাজারে এবং নদীতে। ইলিশের হালি ৪০ হাজার টাকা গিয়ে ঠেকেছে, এমনকি দিনাজপুরে তিন মন ধানে এক কেজি ইলিশ! ঢাকা শহরের ধনীর দুলাল দুলালীরা ‘পান্তা-ইলিশ’ দিয়ে নববর্ষ উদযাপন করতে যায়, যেখানে থালার রেট হাজার টাকাও ওপরে। অথচ প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে বাংলার সংস্কৃতি চর্চা নয়, সাধারণ গরীব মানুষদের উপহাস করা হচ্ছে!

b]
সর্বজনীন নয়; হিন্দুজনীন:[/b]

ওরা বলছে, পহেলা বৈশাখ একটি সর্বজনিন বাঙালী উৎসব। ঐ দিনের সর্বজনীন উৎসবের মধ্যে রয়েছে: হিন্দুদের ঘটপুজা, গণেশ পুজা, সিদ্ধেশ্বরী পুজা, হিন্দুদের ঘোড়ামেলা, হিন্দুদের চৈত্রসংক্রান্তি পুজা-অর্চনা, হিন্দুদের চড়ক বা নীল পুজা বা শিবের উপাসনা ও সংশ্লিষ্ট মেলা, গম্ভীরা পুজা, কুমীরের পুজা, অগ্নিনৃত্য, ত্রিপুরাদের বৈশুখ মারমাদের সাংগ্রাই ও পানি উৎসব, চাকমাদের বিজু উৎসব (ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমাদের পুজা উৎসবগুলোর সম্মিলিত নাম বৈসাবি), হিন্দু ও বৌদ্ধদের উল্কিপুজা, মজুসি তথা অগ্নি পূজকদের নওরোজ, হিন্দুদের বউমেলা, মঙ্গলযাত্রা এবং সুর্যপুজা।

একটু ভাবুন, ইসলাম সূর্যপুজারীদের সাথে সময়ের সামঞ্জস্য হয়ে যাবে বলে তিন সময় নামায পড়া হারাম করেছে। আর কাফেরদের পুজাকে এখন বানানো হচ্ছে সর্বজনীন!!!


বাঙ্গালী বনাম মুসলমান:


বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা ১৯৬৭ সাল থেকে এবং শোভাযাত্রার সূচনা ১৯৮৯ সাল থেকে। তাহলে এ আয়োজনকে কিভাবে বাঙালীর সংস্কৃতি দাবি করা হয়? আজ থেকে ১০০ বছর আগের বাঙালী কোন মা, বধু, কণ্যা কী স্বপ্ন দেখতেন যে, কোন পর পুরুষ তার শরীরের লোভনীয় অঙ্গে আলপনা এঁকে দিবে, সে কোন পর পুরুষকে মুখে তোলে ইলিশ-পান্তা খাওয়াবে? বিগত হাজার বছরের বাঙালী নারী সমাজ পরপুরুষের সান্নিধ্যকে ঘৃণা করে এসেছে। বাঙালীর ইতিহাস, ঐতিহ্য হচ্ছে পর্দা ও শালীনতা বোধের গর্বিত ইতিহাস। ছেলে-মেয়ে এক সাথ বটতলায় বসা বাঙালীর সংস্কৃতি নয়। হ্যাঁ, শরৎ চন্দ্রের ভাষায় ভাষা মিলিয়ে কেউ যদি বলেন, ‘আজ বিকেলে বাঙালী বনাম মুসলমান ছেলেদের মাঝে ফুটবল খেলা হবে’ তবে তিনি বর্ষবরণের প্রচলিত আয়োজনগুলোকে বলতে পারেন বাঙালী সংস্কৃতি।


কিন্তু একজন মুসলমান কখনো বর্ষবরণের এ আয়োজনগুলোকে “আমাদের সংস্কৃতি” বলতে পারে না। আমরা ভাষায় বাঙালী, এ কথা সত্য। এর চেয়েও বড় সত্য কথা হচ্ছে, বিশ্বাস ও সংস্কৃতিতে আমরা মুসলমান। আমাদের সব চেয়ে বড় পরিচয় আমরা মুসলমান। আমাদের সব কিছুই অন্যদের থেকে আলাদা। জন্ম থেকে নিয়ে বিবাহ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সকল কাজ-কর্ম, আচার-আচরণ, রীতি-রেওয়াজ ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত। ধর্ম ভেদে সংস্কৃতি ভিন্ন হবেই। আল্লাহ বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইসলামের বাইরে যেয়ে অন্য কিছুর চর্চা করবে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না।” (আলে ইমরান ৩:৮৫) তাই সকল ধর্মের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য সর্বজনীন সংস্কৃতি বলতে উদ্ভট কোন কিছুর অস্তিত্ব এ পৃথিবীতে নেই।


আকবর ও তার পরবর্তীযুগে পহেলা বৈশাখ:

আকবারের সময় থেকেই বাংলার কৃষকরা চৈত্রমাসের শেষদিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার এবং অন্যান্য ভূ-স্বামীর খাজনা পরিশোধ করত। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির সেই মালিকেরা তাদের কৃষকদের মিষ্টিমুখ করাতেন।

অতীতে বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। এটি পুরোপুরিই একটি অর্থনৈতিক ব্যাপার। হালখাতা মানে হিসাব রক্ষণের পুরাতন বই হালনাগাদ করে নতুন বই খোলা। গ্রামে-গঞ্জে-নগরে ব্যবসায়ীরা নববর্ষের প্রারম্ভে তাঁদের পুরানো হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নতুন খাতা খুলতেন। এ উপলক্ষে তাঁরা নতুন-পুরাতন খদ্দেরদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন।

পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে পুরনাঙ্গ ধারনা পেতে চাইলে প্রথমেই যেই ব্যাপারটা আপনাকে একদম ভুলে যেতে হবে সেটা হল – পহেলা বৈশাখ উদযাপন হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি। বাংলা সন প্রচলন হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে, আজকে থেকে ৪৩৪ বছর আগে। যদি আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকেই হিসাব করা হয় তাহলেও সেটা মাত্র (১৫৫৬-২০১৮) ৪৬২ বছরের পুরনো হয়। একেবারে সহজ করে বলতে গেলে, পহেলা বৈশাখ উদযাপন হাজার বছরের বাঙ্গালি সংস্কৃতি তো ঠিক, তবে সেটা প্রায় ৬০০ বছর কম হাজার বছরের সংস্কৃতি।

এবার চলুন এই ৬০০ বছর টাকেও আরও বাড়িয়ে দেয়া যাক!

“আধুনিক পহেলা বৈশাখ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে ওই বছর পহেলা বৈশাখে ‘হোম কীর্তন’ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।” (প্রথম মহাযুদ্ধে বাংলা বর্ষবরণ, মুহাম্মদ লুৎফুর হক দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০০৮)
১৯১৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত অতিক্রান্ত বছর ১০১; হাজার নয়।


সাংস্কৃতিক আগ্রাসন:

আবহমানকাল ধরে একটি দেশের মানুষের রুচি, সামাজিক কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ইতিহাস ও বিশ্বাস নিয়ে গড়ে ওঠা রীতিনীতিই হলো দেশীয়, লোকজ সংস্কৃতি। এতে মূলত ধর্মীয় বিধি-নিষেধেরই প্রতিফলন ঘটে থাকে। এ দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের জীবনধারা ইসলামের অনুসারী হওয়ায় ইসলামই হচ্ছে এদের লোকজ সংস্কৃতির প্রাণশক্তি।
এ জন্য প্রকৃত দেশজ সংস্কৃতির সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই। কারণ, তা মূলত ইসলামী সংস্কৃতি। যেমন, আজান, নামায, ঈদ, কুরবানী ইত্যাদি। কিন্তু ‘দেশজ সংস্কৃতির নামে যখন অন্য একটি পৌত্তলিক ধর্মের পুজা-পার্বন ও সংস্কৃতির অনুসরণ ও মিশ্রণের অপচেষ্টা করা হয়, তখন তা প্রতিহত করা অনিবার্য হয়ে যায়। অন্যথায়, জাতীয় বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। হাজার বছরের সংস্কৃতির সাথে কিছু প্রাণী মূর্তির মঙ্গলযাত্রা যোগ করলেই তা দেশজ সংস্কৃতি হয়ে যায় না। বরং তা হচেছ মূলত সাংস্কৃতিক আগ্রাসন।

একটি সুস্থ সংস্কৃতির ভেতরে কৌশলে অন্যধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ঐ ধর্মের দেউলিপনাকেই প্রমাণ করা। এটা সাংস্কৃতির দস্যুপনা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর দ্বারা কিভাবে আমাদের কোমলমতি শিশু ও আগামী প্রজন্ম মুশরিক হয়ে যাচ্ছে, তার একটি নমুনা দেখুন। একটি পত্রিকা ছেপেছে, “পয়লা বৈশাখের কদিন আগেই ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলপড়–য়া অনি তার মায়ের সঙ্গে চারুকলা ঘুরে গেছে। একটা লক্ষীসরাও কিনেছে। মায়ের কাছে গল্প শুনে শুনে তখনই সে মাকে বলেছে, এবারই নতুন পোশাক পরে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেবে। অনিকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন সে এই শোভাযাত্রায় অংশ নেবে? ছোট্ট অনি বলেছে, ‘এটা এক ধরনের প্রার্থনা। মা বলেছে, এই শোভাযাত্রায় অংশ নিলে ভালো হবে।’

মূলত, সংস্কৃতি জাতির প্রাণশক্তি। ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে জাতীয় সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হয়। ধর্মের ভিন্নতা সত্ত্বেও অভিন্ন মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনায় বাঙালি সংস্কৃতি সমন্বিত ও সংস্থিত। তবে বিশ্বায়নের নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার আমাদের সংস্কৃতি। অন্তঃসারশূন্য বাহ্যিক চাকচিক্যময় কুরুচিপূর্ণ আগ্রাসী অপসংস্কৃতি আমাদের যুব ও তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করছে। তারা নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে ভিনদেশী সংস্কৃতিতে মোহচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। তাদেরকে অপসংস্কৃতি হতে প্রতিহত করতে না পারলে প্রাণশক্তি হারিয়ে আমাদের জাতি কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে। আর অপসংস্কৃতি প্রতিহত করতে হলে নিজস্ব সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হবে। উচ্চকিত করতে হবে মানবিক ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাঙালি সংস্কৃতি। বিশ্বায়নের বিভ্রান্তি থেকে নতুন প্রজন্মকে মুক্ত করতে হতে হবে শেকড়সন্ধানী। তরুণ-যুব ও শিক্ষার্থীদের মনে জাতীয় মূল্যবোধ সংস্কৃতি ও নৈতিকতার চেতনা জাগ্রত করতে হবে। দৃঢ়ভাবে আকড়িয়ে ধরতে হবে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে। পরিহার করতে হবে পাশ্চাত্যের অপসংস্কৃতি।

পঠিত : ১২৬৮ বার

মন্তব্য: ০