Alapon

আল্লাহ বোঝার তাওফীক দিন

“যে বিশ্ব একেবারে বিশৃংখল, বিধিবিহিন। তেমন একটি বিশ্বকে কোন মুর্খের সৃষ্ট বলে ধরে নেয়া যেতে পারে” – উক্তিটি নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ ষ্টিফেন ওয়াইনবার্গ-এর।

দুবলের উপর শক্তিমানের যুলুম অবিচার, ধনী দরিদ্রের বেদনাদায়ক ব্যবধান, কল্যাণ ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাকামীদের অসহায়ত্ব – ইত্যাদি দেখে বোধকরি ওয়ানইনবার্গ উক্তিটি করেছিলেন। শুধু ওয়াইনবার্গ নয়, মনুষ্যজগতের এহেন অরাজগকতা দেখে এ জাতীয় ধারণা লালন করেন এ পৃথিবীর বহু মানুষ।

তাদের বক্তব্য: এ Universe – এ কোনও গড বা অতি শক্তিধর কেউ থাকলে পৃথিবীব্যাপী এমন হানাহানি ও যুলুম অবিচার চলতে পারতোনা। কোথাও কোন অন্যায় অবিচার হওয়ামাত্রই সেই অতি শক্তিধর গড মাটিতে নেমে এসে অন্যায়কারীকে সাথে সাথে পাথর বানিয়ে ফেলতেন কিংবা নিদেনপক্ষে তার হাত পা অবশ হয়ে যেতো কিংবা এমন ধরণের কিছু। আর সেই গড (যদি সত্যই তিনি অস্তিত্বে থাকেন) এর যিনি দূত হবেন তিনিও হবেন অতি মানব, অতি প্রাকৃত ক্ষমতার অধিকারী। ইত্যাদি ইত্যাদি।

এখনতো Covid-19 এর দৌরাত্ব্য তাদের হেতুবাদ - এ আর এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে: এ কেমন শক্তিধর গড! নিরীহ অনুসারীরা পযন্ত নাস্তানাবুদ। যে ঘরগুলোকে তার ঘর বলা হয় তা-ও আজ অনেকাংশে বন্ধ। অথচ গড নিবিকার। কোথায় সেই Infinite power? যদি সত্যই সেই সবশক্তিমানের অস্তিত্ব কোথাও থাকতো, তাহলে অন্তত: তার অানুগত্যশীলেরা এ ভয়ানক মহামারী থেকে রেহাই পেয়ে যেতো। অথবা নিদেনপক্ষে মাসজিদে প্রবেশমাত্র করোনারা ত্রাহি ত্রাহি করে পালাতো।

যাহোক, এ নিবন্ধে আমি এসকল ধারণা বিশ্বাসের জওয়াব আমাদের মহান প্রভু আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কিভাবে দিয়ে রেখেছেন তা উল্লেখ করবো।

এ জগত সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন:
“এ আকাশ ও পৃথিবী এবং এদের মধ্যে যা কিছুই আছে, এগুলো আমি খেলাচ্ছলে তৈরী করিনি। যদি আমি কোনো খেলনা তৈরী করতে চাইতাম এবং এমনি ধরনের কিছু আমাকে করতে হতো তাহলে নিজেরই নিকট থেকে তা করে নিতাম” (সুরা আল আম্বীয়া ১৬-১৭)

অর্থাৎ আল্লাহ বলেন যে, যদি আমি খেলা করতেই চাইতাম তাহলে খেলনা বানিয়ে নিজেই খেলতাম। এ অবস্থায় একটি অনূভুতিশীল ও দায়িত্বশীল প্রাণী সৃষ্টি এবং তার মধ্যে সত্য-মিথ্যার এ দ্বন্ধের অবতারণা করে কেবল নিজের আনন্দ ও কৌতুক করার জন্য এবং অন্যকে অনর্থক কষ্ট দেবার মতো যুলুম কখনোই করা হতোনা। এখানে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে হানাহানি ও লড়াই বাধিয়ে আনন্দে অট্রহাসি হাসার জন্য এ ভুবন সৃজিত হয়নি।

এর মানে, একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে এ জগতের সৃষ্টি। যা বেশ স্পষ্ট করে বলা হয়েছে সুরা আল মুলক এর ২ নং আয়াতে:
“তিনিই সেই সত্বা, যিনি জন্ম ও মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন, এটা পরীক্ষা করার জন্য যে, কার কর্ম ভাল”।

অন্য এক আয়াতে বলা হয়েছে যে, এ পৃথিবীতে আগত প্রতিটি মানব মানবীকেই আল্লাহ পরীক্ষা করেছেন এবং পরীক্ষা গ্রহণের এ অলংঘনীয় ধারা চলবে কিয়ামাত অবধি।

“মানুষ কি মনে করে নিয়েছে ‘আমরা ইমান এনেছি’ কেবলমাত্র এটুকু বললেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে, আর পরীক্ষা করা হবেনা? অথচ আমি তাদের পুববর্তীদের সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি। আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন, কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক’ (সুরা আল আনকাবুত ২-৩)

আবার কোথাও বলা হয়েছে:
“আর, অবশ্যই আমি কখনো ভয়-ভীতি, কখনো অনাহার, কখনো প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি, কখনো ফল ফসলাদির ক্ষতির মাধ্যমে তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো। এ সকল অবস্থায় পতিত হয়ে যারা সবর অবলম্বন করবে, তাদেরকে তুমি (হে নাবী) সুসংবাদ দাও”।

রোগ ও অসুস্থতার মাধ্যমেও পরীক্ষা করা হবে:

আতা ইবনু আবী রাবাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন যে, একদিন একজন কালো মহিলাকে দেখিয়ে আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহু) আমাকে বললেন: “আমি কি তোমাকে একটি জান্নাতি মহিলা দেখাবো? আমি বললাম: অবশ্যই। তিনি বললেন: এই কালো মহিলাটি একদিন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এসে বললো: হে আল্লাহর রাসুল, আমি মৃগী রোগে ভুগছি এবং তাতে আমি বিবস্ত্র হয়ে পড়ি। আপনি আমার জন্য দোয়া করুন। রাসুল সা: বললেন: যদি তুমি সবর অবলম্বন কর তাহলে এর বিনিময়ে আল্লাহ তোমাকে জান্নাত দেবেন। আর যদি তুমি আরোগ্য লাভই চাও, তাহলে বলো, আমি তোমার জন্য দোয়া করি। মহিলাটি বললো: আমি সবরই অবলম্বন করবো, তবে আমার দেহ থেকে যেন বস্ত্র খুলে না যায় সেজন্য আপনি দোয়া করুন। রাসুল সা: তার জন্য অনুরুপ দোয়া করলেন”। (বুখারী ৯৯/১০, মুসলিম ২৫৭৬ আরবী। আরও দ্রষ্টব্য: রিয়াদুস সালেহীন আরবী পৃ: ৩৯, হাদিস নং ৩৫)

অন্য এক হাদিসে এসেছে:
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছন: “কোন মু’মিন ব্যক্তি প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে তা শাহাদাত হিসেবে গণ্য”। (বর্ণনাকারী: আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু)

আর একটি হাদিসে এসেছে:
উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন যে, আমি রাসুলুল্লাহকে মহামারীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন: এটা এক ধরণের আযাব। আল্লাহ যার উপর চান এ আযাব পাঠান। কিন্তু মু’মিনদের জন্য তা রাহমাত। যে মু’মিন মহামারী কবলিত অঞ্চলে সাওয়াবের আশায়, সবরের সাথে অবস্থান করে (সেখান থেকে না পালিয়ে) এবং আস্থা রাখে যে, আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন তা-ই হবে, তাহলে তার জন্য রয়েছে শহীদের মযাদা” (বুখারী)

পরীক্ষার চুল্লি কেমন হবে:
“তোমরা কি মনে করেছো, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে? অথচ তোমাদের আগে যারা ইমান এনেছিল তাদের উপর যা কিছু ঘটেছে, এখনো তোমাদের উপর তা নেমে আসেনি। দু:খ-কষ্ট ও বিপদ মুসিবাত দিয়ে তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছে। এমনকি সমকালীন রাসুল এবং তার সাথে যারা ইমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলতো: আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে?” (সুরা আল বাকারা ২১৪)।

পরীক্ষার ভয়াবহতা কখনো কখনো এমন হয়েছে যে, দুবল ইমানদারদের ইমানের ভিত ভেংগে গিয়েছে। অন্যদিকে সংশয়বাদীরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, যে আল্লাহর কথা কিছু মানুষ বলে বেড়ায় আসলে সে আল্লাহর অস্তিত্ব কোথাও নেই। আর থাকলেও এখন তার শাসন শৃংখলা বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে অথবা মহাকাল তাকে গ্রাস করে নিয়েছে।

শাস্তি প্রয়োগে আল্লাহর নিয়ম:

“অবাধ্যতার কারনে তাৎক্ষণিক শাস্তিবিধান যদি আল্লাহর নীতি বা নিয়ম হতো তাহলে এ যমীনের বুকে কোনই বিচরণশীল জীবের অস্তীত্ব থাকতোনা। কিন্তু তিনি তাদেরকে এক বিশেষ সময়সীমা পযর্ন্ত অবকাশ দেন। অত:পর যখন সেই সময়টি এসে যায়, তখন আর এক মুহুর্তকালও আগ পিছ হয়না”। (সুরা আন নাহল ৬১)।

“এরা তোমাকে আহবান করছে, আযাব দ্রুত নিয়ে আসার জন্য। (তাদেরকে বলো): এটার জন্য যদি একটি সময় পুবাহ্নেই নির্ধারিত না থাকতো তাহলে তাদের উপর আযাব এসেই যেতো। তবে হ্যা, নিশ্চিতভাবেই (ঠিক সময়মতো) তা অকস্মাৎ এসে যাবে যখন তারা জানতেও পারবেনা” (সুরা আল আনকাবুত ৫৩)।

“একটি নির্দিষ্ট সময় পযন্ত চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত মুলতবী রাখা হবে – একথা যদি তোমার রব পুবেই ঘোষণা (লিপিবদ্ধ)না করতেন তাহলে তাদের বিবাদের ফয়সালাতো সাথে সাথেই করে দেয়া হতো (সুরা আশ শুরা ১৪)।

অর্থাৎ আল্লাহ বলেন যে, যারা পাপী ও অপরাধী তাদেরকে যদি দুনিয়াতেই আযাব দিয়ে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং শুধু ভাল ও সত্যপন্থীদের বাচিয়ে রাখা হয় তাহলে কে সত্য ও ন্যায়ের অনুসারী, আর কে পাপী ও অন্যায়কারী তা সুস্পষ্ট হয়ে যায় বটে। কিন্তু তিনি এ চুড়ান্ত ফয়সালা কিয়ামাত পযন্ত সময়ের জন্য মূলতবী করে রেখেছেন। কারন, যদি পৃথিবীতেই এ ফয়সালা করে দেয়া হয় তাহলেতো মানবজাতীর পরীক্ষা অনুষ্ঠানই (যে উদ্দেশ্য তিনি এ ধরণী সৃষ্টি করেছেন) অর্থহীন হয়ে যায়।

বাকী রইল প্রাকৃতিক জগতের কথা। এই যে ন্যাচারাল বিশ্ব, এর দিকে তাকালে কি মনে হয়, এটি কোন মুর্খের সৃষ্ট? যদিও আমরা তাকে দেখিনা, কিন্তু আমাদের চোখের সামনে এই যে, অগণিত সৃষ্টি, এই যে অপার রহস্যঘেরা মহাজাগতিক বিশ্ব তা কি কোনও এক অজানা স্রষ্টার দিকে অংগুলি নির্দেশ করছেনা? মহাশুন্যে ঘুর্ণায়মান অবাক করা এ পৃথিবী এবং এখানে প্রাণের উন্মেষ, তাদের জীবিকার সংস্থান এসবের দিকে তাকালে কি মনে হয়না যে, এর পেছনে সক্রিয় রয়েছেন জ্ঞানদীপ্ত এক স্রষ্টা। এখানকার প্রতিটি অণু পরমাণু, মানুষ ও জীবজন্তর সৃষ্টি, মাটি, পানি, হাওয়া, পৃথিবী থেকে সুয ও চাদের এক নিরাপদ দুরত্ব এগুলো কি প্রতিনিয়ত একথার প্রমাণ করছেনা যে, এখানে ক্রীয়াশীল রয়েছেন এক অতি শক্তিধর ও অতি প্রজ্ঞাবান এক সত্ত্বার অস্তিত্ব।
আল্লাহ বোঝার তাওফীক দান করুন।।

পঠিত : ৩৭৭ বার

মন্তব্য: ০