Alapon

মানবসেবায় আত্মোৎসর্গ; ডাঃ মঈনকে চিরকাল মনে রাখবে বাংলাদেশ



“উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, / ‘ভয় নাই, ওরে ভয় নাই- / নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান / ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’’ কবিগুরু রবি ঠাকুরের অমর এ পঙ্ক্তিতে উঠে এসেছিল মানবতার তরে জীবন দেওয়া ক্ষণজন্মা মহাপুরুষদের ত্যাগ চিরকাল অম্লান হয়ে রয়।
আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। মানব সেবা যে করেনা সে তো নিকৃষ্ট আর নির্জীব। আমাদের ক্ষুদ্র এই জীবনে অপরের জন্য কিছু করে যেতে পারার মধ্যেই প্রকৃত সফলতা নির্ভর করে।

ডাঃ মঈনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ

ডাঃ মোঃ মঈন উদ্দিন ১৯৭৩ সালের ২ মে সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার নাদামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে তিনি ধারণ নতুন বাজার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৮ সালে এসএসসি এবং ১৯৯০ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। একই বছর ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেখান থেকে ১৯৯৮ সালে কৃতিত্বের সাথে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর তিনি এফসিপিএস ও এমডি কোর্স সম্পন্ন করেন।

২২তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ স্বাস্থ্য ক্যাডারে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সালের ২০ মে তিনি ওসমানী মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন সিলেটের একজন মেধাবী চিকিৎসক। মেডিসিনের পাশাপাশি কার্ডিওলজিরও চিকিৎসক ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ১৯৯৮ সালে তিনি এফসিপিএস’র পাশাপাশি কার্ডিওলজিতে এমডি করেন। এ কারণে রোগীদের কাছে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। তার সহজ, সরল ও সাবলীল ব্যবহার রোগীদের মুগ্ধ করতো।

ডাঃ মঈনুদ্দিনের স্ত্রী ডাঃ রিফাত জাহান সিলেটের বেসরকারি পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজের ফিজিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও এ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (চলতি দায়িত্ব)। তার বড় ছেলে জিহাদের বয়স ১২বছর। আর ছোট ছেলে জায়ানের বয়স ৭ বছর। তারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করছে।
তার পিতা মরহুম মুন্সি সিকদার আলী ছিলেন একজন পল্লী চিকিৎসক। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে ৫ম ডাঃ মঈন উদ্দিনের বড় ভাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী শফিক উদ্দিন বছর খানেক পূর্বে সেখানে মারা গেছেন। মেঝভাই সিরাজ উদ্দিনও মারা যান কয়েক বছর পূর্বে। তার তিনবোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। ভাইদের মধ্যে তিনি একমাত্র বেঁচে ছিলেন। তার তিন বোনের সবাই শিক্ষক। ডা. মঈনের শ্বশুর ডা. নুর আহমদ ও শাশুড়িও চিকিৎসক। তার বাবা মরহুম মুন্সি সিকদার আলী একজন আলেমও ছিলেন।

'গরীবের ডাক্তার' খ্যাতি পাওয়ার নেপথ্যেঃ

পিতা মরহুম মুন্সি সিকদার আলী মৃত্যুর আগে ছেলেকে বলেছিলেন এলাকার অসহায় রোগীদের যেন নিয়মিত সেবা দেন। পল্লী চিকিৎসক পিতার কথা রেখেছেন ডাঃ মঈন উদ্দিন। প্রতি শুক্রবার সরকারি ছুটির দিনে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের ছাতকের নাদামপুরে ছুটে আসতেন তিনি। বিনামূল্যে গরিব অসহায়দের ব্যবস্থাপত্র দিতেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পও করেছেন তিনি। নিজে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি রোগীর সেবায় ব্যস্ত ছিলেন। ওসমানীর ওয়ার্ড, ইবনে সিনার চেম্বার, গ্রামের বাড়িতে রোগী দেখা- সবখানেই ব্যস্ত ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের পর এখানেই তিনি গ্রামের খেটে খাওয়া গরিব-দুঃখী মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। তার সেবা নিয়ে খুশি ছিলেন রোগী ও স্বজনরাও।

ডা. মঈন উদ্দিনের কাছ থেকে চিকিৎসা নেয়া একজন নিম্নবিত্ত পরিবারের রোগী নগরের আখালিয়া এলাকার আরব আলী তার মৃত্যুর খবর শুনে বলেন, তিনি আমার চিকিৎসক ছিলেন। তাকে আমি দীর্ঘদিন ধরে প্রাইভেটে দেখিয়ে আসছি। ১০০-২০০ যাই রোগী দেখার ভিজিট দিয়েছি হাসিমুখে নিয়েছেন। কোনোদিন মুখ কালো করেননি। এই সমাজে তার মতো একজন ভালো চিকিৎসক পাওয়া বিরল।

এলাকার মুরুব্বী সোহেল আহমদসহ স্থানীয় এলাকাবাসী জানান ,ডাঃ মঈনুদ্দিন শুধু গরিবের ডাক্তার ছিলেন না। এলাকার কোন রোগী তার সিলেট চেম্বারে গেলেও তিনি তাদের ফ্রি দেখতেন। তিনি আজীবন মানবতার কল্যাণে কাজ করে গেছেন। যার ফলে পুরো সিলেট বিভাগ জুড়ে তার ছিল 'গরীবের ডাক্তার' বলে সুখ্যাতি।

উত্তর খুরমা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ডা. মঈন উদ্দিনের আত্মীয় মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, তিনি একজন মেধাবী ও সৎ চিকিৎসক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তার মৃত্যুতে কেবল তার জন্মস্থান ছাতক নয়, পুরো সিলেট কাঁদছে।

তিনি বলেন, ডা. মঈন গরিব রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিতেন না। বিশেষ করে গ্রাম থেকে যাওয়া গরিব রোগীদের ভালোবাসতেন। তিনি আমার পারিবারিক চিকিৎসকও ছিলেন।

ডা. মইন উদ্দিন ছিলেন সিলেটের সন্তান। নিজের স্বপ্ন ছিলো সিলেটের মানুষকে ঘিরে। এ কারনে উচ্চ গ্র্যাজুয়েশনের পরও তিনি দেশ ছেড়ে বিদেশের বিলাসবহুল জীবন বেছে নেওয়ার পরিবর্তে সিলেটের মানুষকে সেবা দিতে থাকেন। আমৃত্যু ছিলেন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক।

মেডিসিন, কার্ডিওলজি বিভাগ চষে বেড়াতেন তিনি। ফলে রোগীদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। নিজের চেম্বার ছিলো ইবনে সিনায়। বিকেলে রোগী দেখতেন তিনি সেখানে। রাতে সব ডাক্তাররা যখন ঘরে ফিরে যেতেন তখন তিনি নীরবে এক ‘ঢু’ মারতেন ওসামানীর ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে। সেবা দিতে সময় মানতেন না তিনি।

ডাঃ মঈনের গরীবের প্রতি ভালবাসা ও দায়িত্বনুভূতির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তার অধীনে ইন্টার্নশীপ করা ডাঃ ফয়জুর বলেন,
“স্মৃতি খুব কষ্টের, মঈন স্যারের ইন্টার্ন ছিলাম, ইন্টার্নশিপ শেষ হলে স্যার যে হাসপাতালে চেম্বার করতেন ঐ হাসপাতালে ডিউটি ডক্টর ছিলাম। একদিন রাত ২টায় এক রোগী ভর্তি হলো প্রচন্ড খিচুনি নিয়ে। রিসিভ করেই স্যারকে ফোন দিলাম, স্যার ফোন ধরেই বললেন ‘ফজলুর আমিতো প্রায় বাসায় চলে আসছি, ম্যানেজ করতে পারবা না?

আমি আমতা আমতা করে বললাম, স্যার ডায়াজিপাম দিয়েছি, রোগীটা খারাপ এখনও খিচুনি হচ্ছে দেখে গেলে ভালো হত স্যার। স্যার ওভার ফোনে কি কি করতে হবে কিছুক্ষণ বললেন, তারপর হঠাৎ বলে বসলেন ঠিক আছে ফজলুর তুমি ফোন রাখ আমি আসছি।’

দশ মিনিটের ভিতরে স্যার চলে আসলেন। এসেই বললেন যেহেতু ডায়াজিপাম দিয়ে ফেলেছো এখন আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নেক্সট স্টেপে যেতে হবে, স্যার ১৫ মিনিট রোগীর পাশে অপেক্ষা করলেন তারপর বললেন, এখন ফসফেন লোডিং শুরু করো। রোগিটা গরিব ছিল স্যার নিজে থেকে যাবতীয় পরীক্ষার ৫০% কমানোর জন্য স্লিপে সাইন করলেন।

পরে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন শোন, ‘পার্টি গরীব, আমার ভিজিট তোলার দরকার নাই, ফ্রী করে দিও আর সকালে পেশেন্ট স্টেবল হলে ওসমানীতে রেফার্ড করে দিও, আজ আমার ইউনিটে ভর্তি আছে, এখানে এরা হসপিটালের বিল দিতে পারবে না’। এই ছিলেন আমাদের মঈন স্যার।’’

ক্ষণজন্মা এই মানবদরদীর অসময়ে চলে যাওয়াঃ

প্রানঘাতী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ডা: মইন উদ্দিন ১৫ই এপ্রিল, বুধবার ভোর ৪ টা ৩০ মিনিটে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

উল্লেখ্য, চিকিৎসক মইন উদ্দিনের করোনা উপসর্গ ধরা পড়ে প্রায় ১৩ দিন আগে। এরপর তিনি নিজে নমুনা টেস্ট করেন। ৫ এপ্রিল রিপোর্ট আসে পজেটিভ। এরপর আক্রান্তের ৩য় দিন ৭ এপ্রিল তিনি নগরীর শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি হন।

সেখান থেকে পরিবারের ইচ্ছায় চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই ক্ষণজন্মা মানবদরদীর মৃত্যু হয়।
বড় নীরবে,বড় অভিমানে ১৫ এপ্রিল রাত ৮ টায় ছাতকস্থ পারিবারিক গোরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন গরীবের ডাক্তার খ্যাত, করোনাভাইরাসে শহীদ হওয়া প্রথম ডা. মো. মঈন উদ্দিন (রাহিমাহুল্লাহ)। পরোপকারী এই চিকিৎসকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে অনেকে দোয়া চেয়েছেন। তার স্মৃতিচারণ করে অনেকেই লেখেন, তিনি ছিলেন একজন সত্যিকারের গরিবের চিকিৎসক। মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এ গুণী চিকিৎসকের মৃত্যুতে যেন কাঁদছে পুরো সিলেট।



নিজে ডাক্তার হয়েও শিকার হয়েছিলেন বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনারঃ

নিজ কর্মস্থলেই চিকিৎসা পাননি ডা. মঈন। তার এক ছাত্রের বক্তব্য,

“অক্সিজেনসহ স্যারের স্যাচুরেশন থাকে ৯০%। কিন্তু, অক্সিজেন ছাড়া ৮০%। এটা একটা খারাপ সাইন। ভেন্টিলেটর সাপোর্টের পূর্ব লক্ষণ। শামসুদ্দিনে ভেন্টিলেটর আছে। কিন্তু, মেইনটেইনেন্সের টিম (ডাক্তার, নার্স) নেই। যা ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে। ওসমানীর ডাক্তারদের একাংশ স্যারকে সেখানে শিফট করতে চেয়েছিলেন। ওসমানীর এক ৪টি ভেন্টিলেটর আছে। কিন্তু, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে তা নাকচ করে দেন ওসমানীর পরিচালক।”

অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, “এমতাবস্থায় মঈন স্যার ঢাকায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, এমন আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় যাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো এয়ার অ্যাম্বুলেন্স করোনা রোগী নেবে না। বিমান বাহিনীর একটি অ্যাম্বুলেন্স আছে, সেটি ব্যবহার করতে হলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সুপারিশ লাগে। এমতাবস্থায় মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সুপারিশ করতে অপরাগতার কথা জানান।”

“সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক হয়েও তিনি পাননি নিজের প্রতিষ্ঠানের আইসিইউ, পাননি সরকারের অ্যাম্বুলেন্সও।”
[ঢাকা ট্রিবিউন, ১৫ এপ্রিল]

ডাঃ মঈনের চিকিৎসায় অবহেলা ও যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়ায় তার ঘনিষ্ঠ ডাক্তার ফয়জুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন,

“করোনাতে আক্রান্ত হয়ে স্যার যখন শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন সিলেটে, একসময় ঢাকায় উন্নত চিকিৎসার জন্য স্যার এই রাষ্ট্রের কাছে একটি এয়ার এম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, রাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে স্যার এয়ার এম্বুলেন্স পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন না, আমার সদা হাস্যজ্বল স্যার তারপর অনুনয় করে রাষ্ট্রের কাছে একটি আইসিউ এম্বুলেন্স চেয়েছিলেন, রাষ্ট্র কর্নপাতই করেনি।

অবশেষে স্যার নিজ উদ্যোগে একটি সাধারণ এম্বুলেন্সে কুর্মিটোলা হাসপাতালে রেফার হলেন এবং আজ সকালে রাষ্ট্রকে সকল দায়ভার থেকে মুক্তি দিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন।

নাহ্, রাষ্ট্র কিছুই হারায়নি শুধু আমরা চিকিৎসকরা হারিয়েছি এফসিপিএস ও এমডি কমপ্লিট করা মানবিক একজন স্যারকে।

ডা. মইনের মৃত্যুতে ডা: জাহেদ উর রহমান তার মনের দু:খ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এইভাবে,
“একজন রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা তিনি, মেডিকেল কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, কিন্তু তাকে ঢাকায় আনার জন্য হেলিকপ্টার চেয়েও পাওয়া যায়নি, যদিও তার কয়েক দিন আগে একজন এসিল্যান্ডকে ঢাকায় চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে আনা হয়েছিল। এই সরকার ক্ষমতায় থাকতে প্রশাসন লাগে, পুলিশ লাগে, ডাক্তার লাগে না।
শুধু তাই না, তাকে ঢাকায় আনতে এম্বুলেন্সও পাওয়া যাচ্ছিল না ঠিকমত। সবশেষে অনেক দেরি করে তিনি পৌঁছেন কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে। ঢাকায় পৌঁছার পথে পথে তিনি দেখিয়ে দিলেন দেশের একটা বিভাগীয় শহরে করোনার তথাকথিত প্রস্তুতি আসলে কী।
হয়তোবা তিনি ঠিক সময়ে সিলেটে সেবা পেলে কিংবা ঢাকা চলে আসতে পারলে তিনি বেঁচে যেতেন। হয়তোবা শুরু থেকেই ডাক্তারদের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই থাকলে তিনি করোনায় আক্রান্তই হতেন না। তার মৃত্যু ভয়ংকরভাবে প্রমাণ করল এই দেশের তথাকথিত উন্নয়ন কী ফালতু, কী ঠুনকো!
উন্নয়ন মারানো সরকারি লোকরা আপাতত গর্তে ঢুকেছে। জানি, করোনা পরিস্থিতি আরেকটু শান্ত হলেই ওরা গর্ত থেকে বের হবে এবং শুরু করবে উন্নয়ন মারানো। আমরা একেবারেই নপুংসক হয়ে গেছি, তাই আমাদের সামনে ওসব কথা আবারও বলা যাবে।”

সিলেটে করোনা চিকিৎসার যে চিত্র ফুটে উঠেছে সারা দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার অবস্থাও এর খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। এতো সময় পেলাম আমরা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দেশের বিশেষজ্ঞরা বার বার সতর্ক করার পরও এ অবহেলার যৌক্তিক কোন কারণ আছে কি?
ডা. মইনের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নাকি সরকার?


কাঁদছে সিলেটবাসী, কাঁদছে দেশঃ

মানবদরদি চিকিৎসক ডা. মঈন উদ্দিন সিলেটে করোনা যুদ্ধে প্রথম সারির যোদ্ধা ছিলেন। তিনি সিলেটে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ টিমের সদস্য ছিলেন। তার মৃত্যুর খবর সিলেটে ছড়িয়ে পড়ার পর তার সহকর্মী, ছাত্রছাত্রীসহ সিলেটবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

প্রাণঘাতী করোনার এই ভয়াবহ সময়েও তিনি অবিরাম সেবা দিয়ে গেছেন রোগীদের। চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অপর্যাপ্ততা আর সঙ্কটের মধ্যে সেবা দিতে গিয়ে অজান্তে কোথাও থেকে করোনা সংক্রমিত হয়েছিলেন তিনি। প্রাণঘাতি করোনা সব মায়াজাল বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গেলো পরপারে। ডাঃ মঈনের মৃত্যুর সংবাদ সিলেটে পৌঁছানোর পরপরই সর্বমহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। গরীবের ডাক্তারের জন্য কাঁদছে সিলেট। শোকবিধূর সিলেটে সবার চোখেমুখে যেন স্বজন হারানোর বেদনা।

এই কান্নাটা শুধুমাত্র সিলেটেই সীমাবদ্ধ নেই, কাঁদছে সারাদেশের মানুষ। মানবতার ডাক্তারের জন্য শোকাহত হয়ে পড়েছেন সবাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বইছে শোকের মাতম। পরিচিত জনেরা তো আর্তনাদ করছেন। সবখানেই নেমেছে পিনপতন নিরবতা।

ড. আসিফ নজরুল তার ফেসবুকে লিখেছেন,
“কিছু মানুষের শেষ ঠিকানা শুধু জমিনে হয় না। হয় অন্য হাজারো মানুষের অন্তরে।
ডাঃ মঈন উদ্দিন আপনিও চিরদিন থাকবেন আমাদের হৃদয়ে। সব ভালো মানুষ এ পৃথিবীতে সুবিচার পাননা তারা পান আল্লাহ্-র কাছে, আপনিও পাবেন দোয়া করি। আর সব অমানুষ এ পৃথিবীতে শাস্তি পায়না।
তবে দোয়া করি আপনার মৃত্যু যাদের অবহেলায় কিছু শাস্তি যেন তারা পায় এ দুনিয়াতেই। ভালো থাকবেন গরীবের ডাক্তার! ভালোবাসা আপনার জন্য।”

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ও ওসমানী হাসপাতালের সাবেক উপপরিচালক ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন,

“ডা. মঈন উদ্দিন একজন দায়িত্ব সচেতন চিকিৎসক ছিলেন। তিনি কখনও সরকারি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতেন না। তিনি গরিব রোগীদের আপনজন মনে করে চিকিৎসা করতেন। আমি তার মাগফেরাত কামনা করি।”

সাংবাদিক পীর হাবিবুর রহমান বলেন,

“সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ডা:মঈন উদ্দীন শহীদ হয়েছেন।সুনামগন্জের সন্তান এ ডাক্তার করোনার যুদ্ধে প্রথম সারির যোদ্ধা।সিলেটে করোনায় আক্রান্ত হলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছিলেননা।একটা ভেন্টিলেশন পাননি।ঢাকায় আসতে এয়ার এম্বুলেন্স দূরে থাক আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সের জন্য কত আকুতি করেও পায়নি।অবশেষে আজ ভোরে ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস।ডা:মঈন উদ্দীনের বাবা যখন মারা যান তখন তার বয়স দুই বছর।মা সংগ্রাম করে ছেলেকে পড়ান।ঢাকা মেডিকেলের মেধাবি ছাত্র ছিলো।১০বছর আগে মাকে হারায়।১২ও ৭বছরের দুটি সন্তান এতিম হলো।স্ত্রী রিফাত অকালে বিধবা,সেও ডাক্তার।বড় অমায়িক রুগীর প্রতি যত্নশীল মঈন গরিবের ফি নিতেননা।দেশ তার মেধাবি সন্তানকে হারালো।

চীনের করোনার ভয়াবহতার পর সময় পেয়েও আমাদের দূর্নীতিগ্রস্হ স্বাস্হ্য মন্ত্রনালয় কার্যকর প্রতিরোধ গড়েনি।মূল যোদ্ধা চিকিৎসক ও তাদের সহকর্মীদের পিপিই দেয়নি।সরকারি বেসরকারি হাসপাতালের সমন্বয়ে প্রয়োজনীয় আইসিইউ বেড,ভেন্টিলেশন মজুদ ও সরবরাহ করে সমন্বিত পরিকল্পিত শক্তিশালী চিকিৎসা ব্যবস্হা গড়তে পারেনি।বড় বড় কথা বলেছেন কর্তারা।আমি শহীদ মঈনের শোক গাঁথা হৃদয়ে স্বাস্হ্যমন্ত্রীর বরখাস্ত চাই,সচিবের অপসারন চাই। আমি স্বাস্হ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকেরও অপসারন চাই।এই ব্যর্থতার দায় তাদের নিতেই হবে।রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকে মানুষ বিশ্বাস ভরসা করেনা।আমিও না।তাই এই অপদার্থদের বরখাস্ত চাই।”

এইদিকে ডাঃ মঈনের মৃত্যুর পর তার রাজনৈতিক পরিচয় সামনে নিয়ে এসে কিছু নিকৃষ্ট ব্যক্তির আক্রমণাত্মক বক্তব্যের বিরুদ্ধে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’এর সম্পাদক নঈম নিজাম লিখেছেন,

“বড় অদ্ভুত এক সমাজে বাস করি। একদল প্রশ্ন করছেন ডা. মঈন কোন ধারার রাজনীতি করতেন? আমার পাল্টা প্রশ্ন আপনারা কোন আসমানের মানুষ? বাস্তবতা আপনাদের কানে যায় না? দম্ভ ছাড়ুন। মাটিতে পা রাখুন এবার। ড. মইন করোনা যুদ্ধের প্রথম শহীদ। নষ্ট রাজনীতি বন্ধ করুন। একজন চিকিৎসক জীবন দিয়েছেন। তাকে সম্মাণ দিন। শ্রদ্ধা জানান। বর্তমান বাস্তবতা মোকাবেলা করতে হবে মানবতাকে সামনে রেখে। ভন্ডামি মার্কা রাজনীতি দিয়ে নয়। মইন ঢাকা আসতে আইসিউ অ্যাম্বুলেন্স পাননি। এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাননি। পারলে সেই সব নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করুন।”

শিল্পী আসিফ আকবার বলেন,

“অনেকক্ষন ধরে মোবাইল নিয়ে বসে আছি কি লিখবো! ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা। ডাক্তার মঈন উদ্দীনের মৃত্যুতে হতবিহবল হয়ে পড়েছি।উনার স্ত্রী এবং দুই শিশু সন্তানের জন্য শান্তনার ভাষা নেই।
এই করোনা যুদ্ধে আমরা কতটা অসহায় ড: মঈন সেটা জীবন দিয়ে প্রমান করে গেলেন।আমরা কথায় কথায় এই দু:সময়ে অযোগ্য মুখে ডাক্তারদের গালি দিয়ে যাচ্ছি। কিছু ডাক্তারের জন্য পুরো চিকিৎসক সমাজকে হেয় করতে দ্বিধাবোধ করছিনা।
আমার চোখে ভাসছে ডাক্তার নার্স ব্রাদারদের সাদা এ্যাপ্রন।মৃত্যুর মিছিলে প্রজ্জ্বলিত মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একদল দেবদূতের প্রতিচ্ছবি।আসল কথা হচ্ছে এই দেশের জন্য জীবন দিয়ে দিলেও সম্মান পাওয়া দুরে থাক, ভুলে যাওয়া জাতি মনেই রাখেনা। দুইদিনের প্যাকেজ শোক তারপর আবার পুরনো লাইনেই চলবে মালগাড়ী। ড: মঈন আপনার রুহের মাগফিরাত কামনা করি।আপনার শোকসন্তপ্ত পরিবারকে আল্লাহ শক্তি ধারন করার ক্ষমতা দিন।”

ডা. মঈনের পরিচিত ইমরান লস্কর নামের একজন লিখেছেন,

“প্রিয় ডা. মঈন ভাই, আপনি ছাত্রজীবন থেকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে মানুষকে আহবান করে আসছেন। ডাক্তার হওয়ার পর বিগত ২০ বছর ধরে সপ্তাহের একদিন নিজ বাড়ী সুনামগঞ্জের গোবিন্দগঞ্জে ফ্রী রোগী দেখতেন। নিজ চেম্বারে রোগী দেখতেন অত্যন্ত ধীরে সুস্থে।মানুষের সাথে অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার করতেন।

কোরআনের প্রতি ছিল অকৃত্রিম দরদ। সিলেট শহরের কোরআন শিক্ষার অসাধারণ প্রতিষ্ঠান কোরআন লার্নিং সেন্টারের সকল কার্যক্রমে অকাতরে সহযোগিতা করতেন। নিজেও কোরআন শিক্ষার প্রতি ছিলেম অত্যন্ত আন্তরিক।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কোরআন লার্নিং সেন্টারের এডভান্স কোরানিক ল্যাংগুয়েজ কোর্সে অধ্যয়নরত ছিলেন।আল্লাহ আপনার মৃত্যুকে শহীদি মৃত্যু হিসেবে কবুল করুন,আমিন ।”

পরিশেষে, এদেশের মানুষের জন্য ডাঃ মঈনের এই ত্যাগ জাতি চিরদিন মনে রাখবে। তার অসামান্য অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এদেশের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চির অম্লান হয়ে রবে ‘গরীবের ডাক্তার’ ডাঃ মঈন উদ্দিনের অসামান্য অবদান।

পঠিত : ৬৫২ বার

মন্তব্য: ০