Alapon

ইয়াসিন সুরায় বর্ণিত হাবিবে নাজ্জারের ঘটনা ও ঐতিহাসিক জনপদ আন্তাকিয়া...


আসলে দেশ বিদেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াতে কার না মন চায় না, তবে সবার ক্ষেত্রে তা বিভিন্ন কারনে সম্ভব হয়ে উঠেনা। যাহোক, আলহামদুলিল্লাহ্‌ সুযোগ পেলেই কিন্তু আমি সুযোগ হাতছাড়া করার পার্টি না। ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে অনেকের পছন্দ থাকে উঁচু দালানকোঠা আর ঝাঁ চকচকে শহরের তালিকা, আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। হাজার বছর আগের প্রাণবন্ত সব ঐতিহাসিক জনপদ আমাকে বেশি আকৃষ্ট করে, আর তাইতো সুযোগ পেলেই ছুটে যাই সে সমস্ত জনপদে। আজ আপনাদের নিয়ে যাব তুরস্ক তথা আনাতোলিয়া অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন জনপদ আন্তাকিয়া শহরে।

আদানা থেকে অনেকটা কাছের শহর হওয়ায় যেতে খুব একটা ঝামেলা হবেনা এটা আগে থেকেই জানতাম। সাঁ সাঁ করে পাহাড়িয়া পথ চিরে ছুটে চলেছে আমাদের ভক্সওয়াগেন, আর গাড়ির কাচ দিয়ে বাইরে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি আমি, দু’চোখ ভরে প্রকৃতির সবটুকু সৌন্দর্য দেখার আগ্রহ নিয়ে। পথের দু’ধারে শত শত জয়তুন আর সারি সারি কমলা বাগান, আর একটু দূরে তাকালেই আঙুর লতার ফাঁকেফাঁকে টসটসে আঙুরের থোকা মনের অজান্তেই জিভ থেকে টসটস করে রস বের করে আনে, যাত্রা পথের এসব নিদর্শন এই শহরের ফুলেফলে সমৃদ্ধির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। দেখতে দেখতে হঠাত দূরে চোখে পড়ল জাহাজের সারি, কানে ভেসে আসছে পোর্ট ইস্কান্দারন এর কর্মব্যস্ততার শব্দ। হাতাই শহর হিসেবে অনেক বয়স্ক হওয়ায় এর পথে ঘাটে বার্ধক্যের ছাপ সুস্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়। তবে মৌলিক কাঠামোগত দিক দিয়ে আর দশটি শহরের সাথে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। পাহাড়চূড়া থেকে রাতের হাতায়ের যে দৃশ্য আমি দেখেছি তা অনেকদিন গেঁথে থাকবে হৃদয় কোঠায়। সত্যিই যেন সারারাত ধরে তাকিয়ে থাকি আলোকিত সেই শহরপানে। এইতো কাছাকাছি চলে এসেছি আন্তাকিয়ার।

সিরিয়ার সীমান্তবর্তী এই জনপদের সাথে জড়িত আছে ইতিহাসের অনেক স্মৃতি। আন্তাকিয়ায় প্রবেশ করলেই যে নামটি আপনার নজরে পড়বে সেটি হাবিব নাজ্জার। সুরা ইয়াসিনে বর্ণিত সেই জনপদের কাছে শহর থেকে দৌড়ে আসা ব্যক্তিটিই ইতিহাসে হাবীব নাজ্জার নামে পরিচিত (It is called. But Not Sure)। সুরা ইয়াসিনে সেই বর্ণনা এভাবে এসেছে-

وَاضْرِبْ لَهُم مَّثَلاً أَصْحَابَ الْقَرْيَةِ إِذْ جَاءهَا الْمُرْسَلُونَ

আপনি তাদের কাছে সে জনপদের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করুন, যখন সেখানে রসূল আগমন করেছিলেন।

إِذْ أَرْسَلْنَا إِلَيْهِمُ اثْنَيْنِ فَكَذَّبُوهُمَا فَعَزَّزْنَا بِثَالِثٍ فَقَالُوا إِنَّا إِلَيْكُم مُّرْسَلُونَ

আমি তাদের নিকট দু’জন রসূল প্রেরণ করেছিলাম, অতঃপর ওরা তাদেরকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। তখন আমি তাদেরকে শক্তিশালী করলাম তৃতীয় একজনের মাধ্যমে। তারা সবাই বলল, আমরা তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছি।

قَالُوا مَا أَنتُمْ إِلاَّ بَشَرٌ مِّثْلُنَا وَمَا أَنزَلَ الرَّحْمن مِن شَيْءٍ إِنْ أَنتُمْ إِلاَّ تَكْذِبُونَ

তারা বলল, তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ, রহমান আল্লাহ কিছুই নাযিল করেননি। তোমরা কেবল মিথ্যাই বলে যাচ্ছ।

قَالُوا رَبُّنَا يَعْلَمُ إِنَّا إِلَيْكُمْ لَمُرْسَلُونَ

রাসূলগণ বলল, আমাদের পরওয়ারদেগার জানেন, আমরা অবশ্যই তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছি।

وَمَا عَلَيْنَا إِلاَّ الْبَلاَغُ الْمُبِينُ

পরিস্কারভাবে আল্লাহর বাণী পৌছে দেয়াই আমাদের দায়িত্ব।

قَالُوا إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِن لَّمْ تَنتَهُوا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُم مِّنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌ

তারা বলল, আমরা তোমাদেরকে অশুভ-অকল্যাণকর দেখছি। যদি তোমরা বিরত না হও, তবে অবশ্যই তোমাদেরকে প্রস্তর বর্ষণে হত্যা করব এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে।

قَالُوا طَائِرُكُمْ مَعَكُمْ أَئِن ذُكِّرْتُم بَلْ أَنتُمْ قَوْمٌ مُّسْرِفُونَ

রসূলগণ বলল, তোমাদের অকল্যাণ তোমাদের সাথেই! এটা কি এজন্যে যে, আমরা তোমাদেরকে সদুপদেশ দিয়েছি? বস্তুতঃ তোমরা সীমা লঙ্ঘনকারী সম্প্রদায় বৈ নও।

وَجَاء مِنْ أَقْصَى الْمَدِينَةِ رَجُلٌ يَسْعَى قَالَ يَا قَوْمِ اتَّبِعُوا الْمُرْسَلِينَ

অতঃপর শহরের প্রান্তভাগ থেকে এক ব্যক্তি দৌড়ে এল। সে বলল, হে আমার সম্প্রদায় তোমরা রসূলগণের অনুসরণ কর।

اتَّبِعُوا مَن لاَّ يَسْأَلُكُمْ أَجْرًا وَهُم مُّهْتَدُونَ

অনুসরণ কর তাদের, যারা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় কামনা করে না, অথচ তারা সুপথ প্রাপ্ত।

وَمَا لِي لاَ أَعْبُدُ الَّذِي فَطَرَنِي وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

আমার কি হল যে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং যার কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে, আমি তাঁর ইবাদত করব না?

أَأَتَّخِذُ مِن دُونِهِ آلِهَةً إِن يُرِدْنِ الرَّحْمَن بِضُرٍّ لاَّ تُغْنِ عَنِّي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا وَلاَ يُنقِذُونِ

আমি কি তাঁর পরিবর্তে অন্যান্যদেরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করব? করুণাময় যদি আমাকে কষ্টে নিপতিত করতে চান, তবে তাদের সুপারিশ আমার কোনই কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে রক্ষাও করতে পারবে না।

إِنِّي إِذًا لَّفِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ

এরূপ করলে আমি প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হব।

إِنِّي آمَنتُ بِرَبِّكُمْ فَاسْمَعُونِ

আমি নিশ্চিতভাবে তোমাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। অতএব আমার কাছ থেকে শুনে নাও।

قِيلَ ادْخُلِ الْجَنَّةَ قَالَ يَا لَيْتَ قَوْمِي يَعْلَمُونَ

তাকে বলা হল, জান্নাতে প্রবেশ কর। সে বলল হায়, আমার সম্প্রদায় যদি কোন ক্রমে জানতে পারত –

بِمَا غَفَرَ لِي رَبِّي وَجَعَلَنِي مِنَ الْمُكْرَمِينَ

যে আমার পরওয়ারদেগার আমাকে ক্ষমা করেছেন এবং আমাকে সম্মানিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

وَمَا أَنزَلْنَا عَلَى قَوْمِهِ مِن بَعْدِهِ مِنْ جُندٍ مِّنَ السَّمَاء وَمَا كُنَّا مُنزِلِينَ

তারপর আমি তার সম্প্রদায়ের উপর আকাশ থেকে কোন বাহিনী অবতীর্ণ করিনি এবং আমি (বাহিনী) অবতরণকারীও নই।

إِن كَانَتْ إِلاَّ صَيْحَةً وَاحِدَةً فَإِذَا هُمْ خَامِدُونَ

বস্তুতঃ এ ছিল এক মহানাদ। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে সবাই স্তদ্ধ হয়ে গেল।

মহান রাব্বুল আলামিন জান্নাতে মানুষদের কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ রাখেন না, সেটার সুস্পষ্ট উদাহরন আমরা দেখতে পাই হাবিবে নাজ্জারের ঘটনাতেও। হাবিবে নাজ্জারকে হত্যা করার পর মহান রব্বুল আলামিন তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান, জান্নাতে প্রবেশ করেই হাবিবে নাজ্জার তার রবের প্রতিশ্রুতি স্বরূপ যে অফুরন্ত নেয়ামত প্রাপ্ত পান সেটা তার জনপদের মানুষদের জানানোর জন্য আকুতি করে বলেন – “হায় যদি আমার সম্প্রদায় জানতো, আমার রব আপনাকে সম্মানীতদের অন্তুভুক্ত করেছেন” সেই জান্নাতী ব্যাক্তির ইচ্ছার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তার মনের কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। তুরস্কের যে সমস্ত এলাকার অনেক মানুষ এখনও আরবী ভাষায় কথা বলে থাকে হাতাই তার অন্যতম। প্রাচীন জনপদ হওয়ার সুবাদে পূর্ববর্তী নবী রাসূলদের ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী আজও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ চার্চ রয়েছে এই শহরে।

ইস্কেন্দেরণ (Iskenderon) ইতিহাস নিয়ে জানাশোনা ব্যাক্তিমাত্রই শুনে থাকবেন, হাজার বছর ধরে এই সমুদ্রবন্দর ব্যবসায়ীদের উল্লেখযোগ্য একটি রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, আজও তুরস্কের একটি অন্যতম সমুদ্রবন্দর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তুরস্কের যে সমস্ত খাবার তুরস্কের সীমানা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ইসেকেন্দেরণ কাবাব তার মধ্যে অন্যতম। হাতাই আসলে অবশ্যই ইসকেন্দেরণ কাবাব ( İskender Kebabı) ও কুনেফে ( Hatay Künefe- প্রকার মিষ্টি জাতীয় সুস্বাদু খাবার) না চেখে যাবেন না, সত্যিই অমৃত।

সিরিয়ার সীমান্ত ঘেঁষা এই শহরেই রয়েছে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সাহায্য সংস্থা IHH এর লজিস্টিক সেন্টার। সিরিয়ান শরণার্থীদের জন্য প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ রুটি ও শুকনা খাবার পাঠানো হয় এখন থেকেই।

অনেক সময় পার হয়ে গেল এবার যাবার পালা, তবে যাবার আগে হাতাই এর ব্যাপারে একটি মজার তথ্য দিয়ে বিদায় নিতে চাই – ২য় বিশ্ব যুদ্ধের আগ দিয়ে ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩ বছরের জন্য পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিল হাতাই, পরবর্তীতে গণভোটের মাধ্যমে সিরিয়া বা তুরস্কের যেকোন একটিতে যোগ দেবার প্রশ্নে জনগণ তুরস্ককে বেছে নেই, সেই থেকে হাতাই তুরস্কের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাশিয়ার বিমানটি ও কিন্তু এখানেই ভূপাতিত করা হয়েছিল ।


রাতের অন্ধকার আকাশে দুর পাহাড়ের উপরে windmill’গুলোর লাল বাতি টিপ টিপ করে জ্বলছে, যেন দুর আকাশের তারাগুলি রাতের বিষন্নতা ফেলে নেমে এসেছে হাতাইয়ের বুকে আর আমরা সেই আবেগকে ঠেলে ফিরে যাচ্ছি আদানার পথে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভালো আমল করার এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার তাওফিক দেন, আমিন।

cltd

পঠিত : ৪৯১ বার

মন্তব্য: ০