Alapon

লাল ‍মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের একাল-সেকাল...


০১.

"... ইতিহাসের ধারাবাহিকতা উপলব্ধি করে যদি কোনো ব্যক্তি তার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সঠিক ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, তখন সে ইতিহাসের নায়ক হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু তার পেটি বুর্জোয়া ভিত্তিকে অতিক্রম করে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলেই এত বড় নেতা হতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কখনও মৌলিকভাবে, স্থায়ীভাবে জনগণের পক্ষ ত্যাগ করেননি। চূড়ান্ত পর্যায়ের সিদ্ধান্ত তিনি দেশের জনগণের স্বার্থেই গ্রহণ করতেন॥"


— মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম (সভাপতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ডাকসুর প্রথম ভিপি)


তথ্যসূত্র : সাক্ষাৎকার / বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ॥ [ ১৭.০৩.২০২০ ]


০২.

"... ৩রা জানুয়ারী পল্টন ময়দানে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আয়োজিত এক সভায় ইউনিয়নের নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঘোষণা করেন,


'দরকার হলে আরও রক্ত দেবো। তবু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লেজুড় সরকারকে উৎখাত করে সমাজতন্ত্র কায়েম করবোই।'


ঐ সভায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি সেলিম ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের বহিষ্কারের কথা ঘােষণা করেন এবং সদস্যপদ বই থেকে সংশ্লিষ্ট পাতাটি জনসভায় ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলেন। ১৯৭২ সালের ৬ই মে এই ছাত্রনেতাই শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ দেয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন।


জনাব সেলিম ডাকসু'র পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধি প্রত্যাহার করে সাবধান করে দেন যে,


'সংবাদপত্র, টিভি ও বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের নামের আগে আর জাতির পিতা ও ‘বঙ্গবন্ধু' উপাধি ব্যবহার করা চলবে না।'


তিনি বাড়িতে ও দোকানে টানানো শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামিয়ে ফেলার আহ্বান জানান। ঐ দিনই বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টির নেতা মনি সিং বলেন,


'বর্তমান সরকার সম্পূর্ণ অযোগ্য।'


৩রা জানুয়ারী কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মুজিববাদী ছাত্রলীগ আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায় ছাত্রলীগ সভাপতি শেখ শহীদুল ইসলাম 'বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অশােভনীয় উক্তি উচ্চারণের জন্য ন্যাপ (মােজাঃ) ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের আগামী ৭ই জানুয়ারীর মধ্যে জনতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বলেন। তিনি বলেন, 'যদি ক্ষমা না চাওয়া হয় তাহলে জনতা ৭ই জানুয়ারীর পর থেকে বাংলার মাটিতে ন্যাপ (মােজাঃ) ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কোনাে জনসভা অনুষ্ঠিত হতে দেবে না।' ঐ সভায়ই শেখ শহীদ বলেন, 'যেসব লােক মন্ত্রী হবার খায়েশ এবং সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য সরকারের কাছে শতবার তোষামােদ করেছেন, তারা এবং তাদের ছত্রছায়ায় থেকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন আজ গণতন্ত্রের সুযােগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অশোভন উক্তি করছে'। তিনি ঘোষণা করেন যে; 'আজ বৃহস্পতিবার (৪ঠা জানুয়ারী) থেকে যে পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর নামের পূর্ণ মর্যাদা দেবে না, সংগ্রামী জনতা বাংলার মাটিতে সেই পত্রিকার অস্তিত্ব রাখবে না।' তিনি বলেন, 'বঙ্গবন্ধুকে ডাকসু'র আজীবন সদস্য করা হয়েছে ডাকসু'র তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে। সুতরাং সেখানে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা অন্য কারও নেই। বর্তমান ডাকসু যেহেতু ছাত্র সমাজের মতবিরােধী কাজ করেছে এবং তাদের আস্থা ও ভালবাসা হারিয়েছে, তাই এই ডাকসু বাতিল।' ছাত্রনেতারা এই তৎপরতাকে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করেন। ইতিমধ্যে ডাকসুঅফিসও তছনছ করে ফেলা হয়।


ঐ দিনই বাংলার বাণীতে প্রকাশিত খবরে জানা যায় যে, শেখ মুজিবের ছবি নামিয়ে ফেলার দায়ে এক ব্যক্তির কান কেটে দেয়া হয়েছে। পরদিন ঐ পত্রিকা খবর দেয় যে, একই কারণে রংপুরে দু’ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।


এরপর ৫ই জানুয়ারী পল্টনে ছাত্রলীগের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ছাত্রলীগ নেতারা শ্লোগান দেন যে, 'রব-ভাসানী-মােজাফফর-বাংলার তিন মীরজাফর।' ৬ই জানুয়ারী গােপালগঞ্জের এক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'স্বার্থান্বেষী মহল নির্বাচনের প্রাক্কালে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে ও আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্র করছে। চরম দুঃখের দিনগুলােতে এসব লােককে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তারা নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। দেশের উন্নয়নের জন্য যাতে বিদেশ থেকে কোন সাহায্য না আসতে পারে সেই উদ্দেশ্যে ওরা বিশ্বে বাঙালী জাতির মান মর্যাদা ক্ষুন্ন করার চেষ্টা করেছে।'


৬ই জানুয়ারী এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ন্যাপের মােজাফফর আহমদ তাদের ৭ই জানুয়ারীর প্রস্তাবিত প্রতিবাদ জনসভা বাতিল ঘোষণা করেন। ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি স্বীকার করেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি ভয় পেয়েছেন। সাংবাদিক সশেনে তিনি মওলানা ভাসানীকে ‘শেখ মুজিবের দালাল বলে অভিহিত করেন। তিনি তার দলকে সংসদীয় গণতন্ত্রে আস্থাশীল বলে দাবী করেন এবং গণতান্ত্রিক আচরণ নিশ্চিত করার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের দাবী জানান। তবে ঐ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি আর বাংলাদেশ সরকারের পদত্যাগ দাবী করেননি। ভিয়েতনামের প্রশ্ন তােলেননি, এবং ছাত্র হত্যার বিচার চাননি।


এরপর আওয়ামী লীগের সঙ্গে মােজাফফর আহমদের ন্যাপ ও মনি সিংয়ের কম্যুনিস্ট পার্টির একটি আপােসের জন্য শেষােক্ত দুই দল নানা মহলে লবি করতে থাকেন এবং তারই এক পর্যায়ে ২২শে জানুয়ারী অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে তার বক্তব্য ও তৎপরতার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করে আসেন। একই দিন মনি সিং জিল্লুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে আপােস আলোচনা করেন। কিন্তু নিহত ছাত্র মতিউল ও কাদেরের হত্যার তদন্ত রিপাের্ট বাকশালে ঐ দু’দলের যোগদানের পরেও ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। অনেকেই বলেছেন আপােসের শর্ত হিসেবে তারা ঐ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবী করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন॥"


— আহমেদ মুসা / বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের সূচনাপর্ব : ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামীলীগ ॥ [ লেখক - ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৮ । পৃ: ১৪৪-১৪৬ ]

পঠিত : ৬০৩ বার

মন্তব্য: ০