Alapon

করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান কি একাই লড়াই করছে...?


খাবার না খেয়ে মানুষ কতোদিন বেঁচে থাকতে পারে? সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসের পরবর্তী রেশমা ইতিহাস বা নাটকের পর পিজি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালের মেডিসিন অনুষদের ডিন ডাক্তার এ বি এম আব্দুল্লাহ ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ লিখেন। প্রবন্ধটির শিরোনাম হলো- না খেয়ে কত দিন বাঁচা সম্ভব?

এই প্রবন্ধে তিনি প্রশ্নটির উত্তর দেন এভাবে- “যদিও প্রশ্নটির কোনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত উত্তর নেই, তবুও আমরা বলতে পারি, পানি পান করলে এবং আবহাওয়া অনুকূল হলে একজন সুস্থ পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি অন্তত দুই মাস বেঁচে থাকতে সক্ষম। অন্যদিকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান না করলে ওই একই ব্যক্তির পক্ষে দুই সপ্তাহের বেশি বেঁচে থাকা অস্বাভাবিক হবে।” [প্রথম আলো, ২৬ জুন ২০১৩]

...

করোনার সময় প্রায় সবাই গৃহবন্দী। পৃথিবীর একটা দেশের সাথে আরেকটা দেশের যোগাযোগ অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। মানুষ ঘরে বসে বসে ‘ইয়া নফসি’ জপছে। যাদের ঘরে খাবার আছে তারা মোটামুটি অন্যদের চেয়ে একটু নিশ্চিন্তে আছেন। যাদের খাবার কেনার টাকা আছে তারাও অনেকটা নিশ্চিন্তে আছেন।

কিন্তু চিন্তা হলো যাদের ঘরে খাবার নেই তাদের। সেইসব দিন এনে দিন খাওয়া, সেইসব মধ্যবিত্ত মানুষের। সবাই ঘরে বন্দী হয়ে গেলে তাদের ঘরে খাবার যাবে কিভাবে? তারা কি না খেয়ে মারা যাবে?

না। অনেকেই উদ্যোগ নিচ্ছেন। দিন এনে দিন খাওয়া মানুষদের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে লুকিয়ে দান করছেন। অনেক দেশের সরকার উদ্যোগ নিয়ে জনগণের ঘরে ঘরে খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে, গ্যাসবিল, বাড়িভাড়া মাফ করে দিচ্ছে, রেশন সার্ভিস শুরু করেছে।

সবমিলিয়ে বলা যায় দুটো শ্রেণী অনাহারীর মুখে আহার তুলে দিতে এগিয়ে এসেছে। একশ্রেণী হলো সাধারণ মানুষ, আরেকশ্রেণী হলো সরকার, রাজনীতিবিদগণ। দুই শ্রেণীরই এমন কাজের পেছনে ‘মোটিভ’ আছে।

সরকারের মোটিভ হলো ধরেই নিলাম লোক দেখিয়ে পরবর্তী ইলেকশনে বিজয় নিশ্চিত করা। অথবা বিপদকালে জনগণের দায়িত্বপালন।

সাধারণ মানুষের দান করার পেছনে মোটিভ কী? স্বীকার করুন বা না করুন, সাধারণ মানুষদের দান-সদকা করার পেছনের মোটিভ হলো ধর্মীয়। মুসলিমরা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ক্ষুধার্তকে আহার করায়, অভাবীকে দান করে। ইসলামের অন্যতম একটা পিলার হলো যাকাত। সামর্থ্যবানের উপর যাকাত ফরজ। সে তার যাকাতের টাকা আটটি খাতে দান করে শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে।

খ্রিস্টানরা যেসব চ্যারিটি ফান্ডে দান করে, তাদেরও দান করার পেছনে আছে ধর্মীয় মোটিভ। খ্রিস্টানরা দান করার ব্যাপারে উৎসাহ খুঁজে পায় বাইবেলে- “কারো কাছে যদি সম্পদ থাকে, আর তার ভাই যদি বিপদে পড়েছে দেখেও যদি সে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেয় তাহলে আল্লাহর ভালোবাসা সে কিভাবে পাবে?” [বাইবেল, বুক অব জন ৩:১৭-১৮]

মুসলিমরা দান করার উৎসাহ পায় কুরআনে- “তোমরা সম্পদ ব্যয় করবে, তা পিতা-মাতা, আত্মীয়, ইয়াতিম, মিসকিন ও মুসাফিরদের জন্য।” [সূরা বাকারাঃ ২:২১৫]

চক্ষুলজ্জার ভয়ে যেসব মধ্যবিত্তরা মানুষের কাছে চাইতে লজ্জা পায়, তাদেরকেও সাহায্য করার ব্যাপারে কুরআন উৎসাহিত করেছে- “দান সেই গরীবদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে আবদ্ধ হয়ে আছে যে, জীবিকার জন্য যমিনে যাতায়াত করতে পারে না। হাত না পাতার কারণে অজ্ঞরা তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে থাকে। তাদের চেহারার হাবভাব দেখে তুমি তাদেরকে চিনতে পারবে। তারা মানুষের কাছে কিছু চায় না।” [সূরা বাকারঃ ২:২৭৩]

কুরআনের সবচেয়ে বড়ো মিরাকল হলো, মাঝেমাঝে মনে হয় আয়াতটি এইমাত্র নাযিল হলো। উপরের আয়াতে বলা হয়েছে- জীবিকার জন্য তারা বাইরে যেতে পারছে না, আবার কারো কাছে চাইতেও পারছে না, সুতরাং তাদেরকে দান করো। এ যেন করোনার সময়ের মধ্যবিত্তদের কথাই বলা হচ্ছে!

এই হলো পৃথিবীর বড়ো দুই ধর্মের তথা পৃথিবীর মোট প্রায় ৪.২ বিলিয়ন জনগণের দান করার পেছনের মোটিভ। বাকি ধর্মগুলোরও একই অবস্থা। দান করার পেছনের মোটিভ হলো- এর প্রতিদান আল্লাহ/গড/ভগবান দিবেন।

অতীতে দুর্ভিক্ষে, না খেতে পেরে অনেক মানুষ মারা গিয়েছে। ১৯৪৩ সালে ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’ –এ শুধু বাংলাতেই প্রায় ত্রিশ লক্ষ লোক মারা যায়। স্বাভাবিক সময়েও প্রতিদিন না খেয়ে অনেক মানুষ মারা যায়।

এই যে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে যারা আহার তুলে দিচ্ছন যেসব রাজনীতিবিদ, যেসব ধার্মিক, তারা কেউই বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব বা তথ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দান-সদকা করছেন না। কেউ করছেন ধর্মীয় কারণে, কেউ করছেন রাজনৈতিক কারণে। কেউ বা ধর্মীয়-রাজনৈতিক কোনো কারণেই না, শুধুমাত্র বিবেকের তাড়নায় নৈতিকতার প্রশ্নে এসে দান করছেন; কিন্তু বিজ্ঞান পড়ে এসে কেউ দান করছেন এমনটা শুনা যায় না। বিজ্ঞানের কাজও না মানুষকে দান করার ব্যাপারে উৎসাহিত করা!

তারমানে করোনার সঙ্কটে ধার্মিকেরাও অবদান রাখছেন তাদের নিজেদের জায়গা থেকে, রাজনীতিবিদরা অবদান রাখছেন নিজেদের জায়গা থেকে, তেমনি ডাক্তার-বিজ্ঞানীরাও অবদান রাখছেন নিজেদের সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে। সবার অবদান হলো একটা হলিস্টিক এপ্রোচ (Holistic Approach)।

এই যে মানুষ লকডাউনে গিয়ে নিজেকে আইসোলেট করে ভাইরাস ছড়ানো থেকে বিরত থাকছে, এটা কার অবদান? ডাক্তার বা বিজ্ঞানীরা সারাজীবন রিসার্চ করে চিল্লাচিল্লি করে গলা ফাটালেও সাধারণ মানুষ অন্তত ঘরে ঢুকবে না। সরকার তথা প্রশাসন ভালোর জন্য মানুষকে ঘরে ঢুকাতে বাধ্য করছে। দু-চারটা ব্যতিক্রম ঘটনা বাদে বেশিরভাগ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব (সাধারণ মানুষ যাদের কথা সবচেয়ে বেশি মানে) মানুষকে ঘরে থাকার ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন। এই দুই শ্রেণী যদি জনগণকে ঘরে ঢুকানোর ‘লড়াই’ না করতো, তাহলে ডাক্তাররা কি পারতো মানুষকে ঘরে ঢুকাতে? সচেতন মানুষ ছাড়া কয়জনই বা ডাক্তারদের কথা শুনতো?

করোনার বিরুদ্ধে সমাজের অনেকগুলো শ্রেণী ‘লড়াই’ (একজন বিশ্বাসী হিশেবে এই শব্দটি ব্যবহার করতে আমার আপত্তি আছে) করে যাচ্ছে। ঈমানের কথা বাদ দিয়ে বস্তুগতভাবেই যদি চিন্তা করি তাহলে দেখবো সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, করোনার বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যজোট হওয়ায় একে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে (একজন ঈমানদারের অবস্থান এখানে একটু ভিন্ন, সেই আলোচনায় এখন যাচ্ছি না)।

তাহলে করোনার বিরুদ্ধে সবাই লড়াই করার পরও যদি বলেন- ‘বিজ্ঞান লড়েছিলো একা, কোনো মসজিদ-মন্দির নয়’ তাহলে কি এটা রবীন্দ্রনাথের লাইন দুটো মনে করিয়ে দেয় না?

“শৈবাল দিঘিরে বলে উচ্চ করি শির
লিখে রেখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।”

@Ariful

পঠিত : ৩৮১ বার

মন্তব্য: ০