Alapon

জাতীয়তাবাদের স্বরূপ এবং কিছু কথা...


আজকাল মুসলিমদের মাঝে যে রোগ ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে সেটি হল জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ একটি আদর্শ যেখানে জাতিকে মানব সমাজের কেন্দ্রীয় অবস্থানে স্থাপন করা হয়। সহজভাবে বলা যায়, কোন ব্যক্তি যখন শুধুমাত্র নিজের জাতির উন্নতি কামনা করে, নিজের দেশ জাতি ভাষা কিংবা পতাকা নিয়ে গর্ব বোধ করে, অন্যান্য দেশ ও জাতিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে বিচার করে, অন্য জাতিকে ঘৃণা করে কিংবা কম ভালোবাসে যদিও তারা মুসলিম হয়, অন্যান্য দেশ ও জাতির তুলনায় নিজের দেশ ও জাতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে, তখন তার সেই মনোভাব বা আদর্শকে জাতীয়তাবাদ বলা হয়।

জাতীয়তাবাদ একটি ইসলাম বিরোধী কুফরি মতবাদ এবং ইসলাম একে জাহেলিয়াত বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামে আরব অনারব, সাদা কালো, দেশি বিদেশি সকল মুসলিমকেই সমান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কেউ যদি মুসলিম হয় তাহলে সে ভারতীয়, পাকিস্থানি অথবা অন্য যে কোন দেশের নাগরিক হোক না কেন, সে আমাদের দ্বীনি ভাই। মুসলিমদের মধ্যে
মর্যাদা ও সম্মানের পার্থক্য হবে তাকওয়ার ভিত্তিতে, জাতীয়তা কিংবা দেশীয় নাগরিকত্বের ভিত্তিতে নয়। কেউ যদি ইসলামের বিরোধীতা করে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করে তাহলে সে স্বদেশী হলেও তার সাথে আমাদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।

জাতীয়তাবাদ, গোত্র প্রীতি, বংশীয় আভিজাত্য ও অহংকারবোধকে আরবী পরিভাষায় আসাবিয়্যাহ বলা হয়। এই আসাবিয়্যাহ এর কুফল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যাহর কারণে মৃত্যুবরণ করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যাহর দিকে আহ্বান করে, সে আমাদের দলভুক্ত নয় যে আসাবিয়্যাহর কারণে যুদ্ধ করে। [আবু দাউদ, হাদিস নং ৫১২১]

জাবের বিন আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছেনঃ হে লোক সকল শোনো, তোমাদের প্রতিপালক এক, তোমাদের পিতা এক। শোনো, আরবের উপর অনারবের এবং অনারবের উপর আরবের, কৃষ্ণকায়ের উপর শ্বেতকায়ের এবং শ্বেতকায়ের উপর কৃষ্ণকায়ের কোন শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা নেই। শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা আছে তো কেবল তাকওয়ার কারণেই। [ইমাম আহমাদ, আল মুসনাদ, হাদিস নং ২৩৪৮৯]

ইসলাম কেন জাতীয়বাদকে প্রত্যাখ্যান করে সে সম্পর্কিত কয়েকটি দিক হলোঃ

প্রথমত, জাতীয়তাবাদের কারণে ইসলামের একটি মূলনীতি “আল ওয়ালা ওয়াল বারাহ” সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘিত হয়। আল ওয়ালা ওয়াল বারাহ এর মর্মার্থ হলো আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা। একজন মুসলিমের প্রতি আরেকজন মুসলিমের ভালোবাসা থাকতে হবে আল্লাহর জন্যই। ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী কাফির মুনাফিকদের প্রতি অন্তরে ঘৃণা থাকতে হবে আল্লাহর জন্যই। কোন পার্থিব স্বার্থের জন্য নয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদ মুসলিমদের এই সম্পর্কের মধ্যে দেয়াল তৈরি করে দেয়। ভিনদেশের মুসলিমকে তখন আর আপন ভাবা যায় না। অন্যদিকে নিজ দেশের আল্লাহদ্রোহীর প্রতিও সহানুভূতি চলে আসে।

দ্বিতীয়ত, জাতীয়তাবাদ মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ধ্বংস করে দেয়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে একজন মুসলিমের কষ্টে সমস্ত পৃথিবীর মুসলিমের অন্তরে কষ্ট অনুভূত হবে, এটিই ইসলামের শিক্ষা। অথচ জাতীয়তাবাদ আমাদের সেই অনুভূতি নষ্ট করে দিয়েছে। নিজ দেশের কিংবা নিজ জাতির মানুষ সুখে থাকলেই আমরা খুশি। আর এরূপ স্বার্থপরতাই হচ্ছে জাতীয়তাবাদের মূল শিক্ষা।

তৃতীয়ত, জাতীয়তাবাদ নিজের জাতিকে অন্যান্য জাতি থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শেখায়। ইসলামে নিজ জাতিকে নিয়ে অহংকার কিংবা বংশ মর্যাদার গৌরব চরম নিন্দনীয়। ইসলাম এরূপ কর্মকে জাহেলি যুগের কর্ম বলে উল্লেখ করেছে। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হলো তাকওয়া। এক্ষেত্রে গায়ের রঙ, বংশ, জাতি, ভাষা, ভূখণ্ড ইত্যাদি মূল্যহীন।

চতুর্থত, জাতীয়তাবাদ মানুষকে সত্য অস্বীকার করতে শেখায়। নিজ সম্প্রদায় যখন বাতিলের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং অন্য সম্প্রদায়ের নিকট থেকে সত্যের আহ্বান আসে তখন জাতীয়তাবাদের চেতনায় উন্মত্ত ব্যক্তির জন্য স্বাভাবিকভাবেই সত্যকে গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। আর ঠিক এরূপ কারণেই ইহুদি সমাজ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সত্য রাসূল হিসেবে বিশ্বাস করার পরও ইসলাম গ্রহণ করে সফল হতে পারে নি।

পঞ্চমত, জাতীয়তাবাদ ন্যায় অন্যায় বোধকে নষ্ট করে দেয়। জাতীয়তাবাদের দাবিই হলো নিজের স্বজাতিকে সাহায্য করা হবে যদিও সে অন্যায় করে এবং অন্য জাতিকে সাহায্য করা হবে না যদিও তারা নিরপরাধ হয়। অথচ ইসলামের শিক্ষা হলো অন্যায়কারীকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা হবে, যদিও সে নিজ সম্প্রদায় কিংবা নিজ দেশের নাগরিক হয়।

পঠিত : ৪১০ বার

মন্তব্য: ০