Alapon

ইয়াসির ক্বাদি কী সমকামিতাকে সাপোর্ট করেছেন? (দ্বিতীয় পর্ব)


এক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও বিতর্ক সৃষ্টিকারী টপিক, সমকামিতার শাস্তি কী? যে সমাজ শরিয়া আইনের মাধ্যমে পরিচালিত, সেখানে সকল প্রকার নৈতিক ও যৌন পদস্খলনের জন্য শাস্তি রয়েছে। তবে এ সকল অপরাধ প্রমাণের জন্য রয়েছে বিশাল প্রক্রিয়া। যদি তা প্রমাণিত হয়, তবে তাদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। উদ্দেশ্য মানুষের মনে পাপ সম্পর্কে ভয় সৃষ্টি করা। যাতে মানুষ এই পাপ আর না করে। যেমন, যিনা। ক্লাসিকাল ইসলামি আইনে যিনার (বিবাহিত) শাস্তি রজমের মাধ্যমে হত্যা তথা মৃত্যুদণ্ড।

কিন্তু প্রকৃত ইসলামের ইতিহাসে কদাচিৎ এ শাস্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। ইসলামী আইন বলছে, যিনার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ইবনে তাইমিয়াসহ অন্যান্যরা বলেন, প্রকৃত ইসলামের ইতিহাসে যিনার অপরাধে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি। তবে অল্প কয়েকজন দণ্ডিত হয়েছেন, তারা নিজেরা নিজেদের যিনার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

যিনার শাস্তি প্রমাণের প্রক্রিয়া খুবই কঠিন। প্রমাণের জন্য চারজন সাক্ষী প্রয়োজন; যারা সঙ্গম সম্পাদিত হতে নিজ চোখে দেখবে। এটা প্রমাণিত হওয়া অসম্ভব না হলেও, প্রায় অসম্ভব। সুতরাং ক্লাসিকাল ইসলামি টেক্সট বুকে যে আইন আছে তা সেন্সেশনালাইজ করা উচিৎ হবে না।

আমাদের বোঝা উচিৎ, আইন প্রণয়নের পেছনে আল্লাহ তায়ালার হেকমত কী ছিল। তার হেকমত ছিল অপরাধ বাধাগ্রস্ত করা, শাস্তি দেয়া উদ্দেশ্য নয়। এমনকি ইউটোপিক ইসলামী আইডিয়াল দ্বারাও এটা খুবই কদাচিৎ বাস্তবায়িত হয়েছে। এসব আইনের উদ্দেশ্য মানুষের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করা, যাতে কেউ এই পাপ কাজে জড়িত না হয়।
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, যিনার শাস্তি খুব কমই বাস্তবায়িত হয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।

ইবনুল কাইয়্যিম তার "আদ দা-উ ওয়াদ দাওয়া" গ্রন্থে উল্লেখ করেন। কেউ কেউ বলেন, সমকামের শাস্তি যিনার শাস্তির চেয়ে কঠিন। কেউ কেউ, বলেছেন সমান। কেউ কেউ বলেছেন, এর শাস্তি যিনার চেয়ে চেয়ে কম। এটাই বিখ্যাত হানাফি পজিশন। হানাফি মাযহাব মতে, যিনার মতো এর জন্য মৃত্যুদণ্ড প্রয়োগ হবে না। এর শাস্তি সম্পর্কে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এ বিষয়ে ডক্টর জনাথন ব্রাউনের একটি ভাল আর্টিকেল রয়েছে। "Sharia: Safeguarding each other rights in a pluralistic society."

তৃতীয় পয়েন্ট
শরিয়া বলছে, সমকামিতা অনৈতিক। শরিয়া বলছে, অপরাধ প্রমাণিত হলে এর জন্য শাস্তি রয়েছ। এর দ্বারা আমরা মুসলিমরা কি ঘৃণা প্রচার করছি? এর দ্বারা আমরা কি সহিংসতা ছড়াচ্ছি? এর দ্বরা কি আমরা কাউকে আক্রমণ করতে উদ্বুদ্ধ করছি? অনেকে প্রশ্ন করেন, আপনি কেন হোমোসেক্সুয়ালিটির শাস্তি সম্পর্কে শরিয়ার মতামত প্রচার করেন।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো, দ্বিমত পোষণ ও বৈষম্য করা এক নয়। কিছু লোক আমাদের প্রতি অভিযোগ করে যে, আমরা নাকি হোমোফোবিক (যে অজ্ঞাতার ও অযৌক্তিক ভয়ের বশবর্তী হয়ে সমকামীদের প্রতি ঘৃণা ছড়ায়)। আমাদের উত্তর, আপনি কনসিস্ট হোন। আপনি অভিযোগ করছেন, আমরা যেহেতু সমকামিতার সাথে দ্বিমত পোষণ করছি তার মানে আমরা ঘৃণা, সহিংসতা ছড়াচ্ছি। কিন্তু এটাকে একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করুন, আপনি বরং আমাদের ভিন্নমতকে আক্রমণ করেছেন, আমাদের মোরালিটিকে আক্রমণ করেছেন। এই অভিযোগের মাধ্যমে আপনি কি আমাদেরকে ক্রিমিনালাইজ করছেন না? (ক্রিমিনালাইজ করা মানে, কারো কার্যক্রমকে অবৈধ সাব্যস্ত, গন্য করে তাকে অপরাধী বানানো)

বাস্তবতা হলো, আপনিই বরং আমাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ছড়াচ্ছেন। আপনি আমাদের অবস্থান কে আক্রমণ করছেন। আমাদের নৈতিকতাকে আক্রমণ করছেন। সেজন্য আমরা আপনাকে heterophobia (অপোজিট জেন্ডারের প্রতি ঘৃণা) এর অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারি।

আমাদের নৈতিকতা চর্চার অধিকার আমাদের রয়েছে। কোনটা ভুল কোনটা সঠিক তা নির্ধারণ করার অধিকার আমাদের রয়েছে। আমরা কারো বিরুদ্ধে সহিংসতা, বিগোট্রি (ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, ধর্মান্ধতা) প্রচার করছি না। হোমোফোবিয়া ইত্যাদি লোডেড টার্ম (এমন শব্দাবলি, যা জনতাকে উত্তেজিত করে কিংবা প্ররোচিত করে)।

এসব টার্ম আমাদের ভোকাবুলারি বহির্ভূত। আমরা নৈতিকতা শেখাই। আমরা শেখায় কোনটা ভালো কোনটা খারাপ। আর আমাদের তা করার অধিকার রয়েছে। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলি, ইসলাম কখনো মদপান অনুমোদন করে না। এমনকি যে ইসলামের অনুশীলন থেকে খুব দূরে সরে গেছে সেও জানে মদপান হারাম। কোন মুসলিমকে কী এ কথা চিন্তা করছে যে, মদ পানকারীদের হত্যা করবে? কোন মুসলিম কি পরিকল্পনা করছে যে, তারা সকল মদের বার ধ্বংস করবে? উত্তর হলো, না। আপনারা আমাদের নৈতিকতাকে বুঝতে পারছেন না। আমরা তাদের ওপর শরিয়া পানিশমেন্ট বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি না। কিন্তু আমরা বলি, যা কুরআন বলছে, "মদে কিছু উপকারিতা রয়েছে; কিন্তু উপকারিতার চেয়ে ক্ষতি পরিমাণই বেশি।"

হে মুসলিমরা, কেউ যখন বাজে উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার কাছে আসে এবং জিজ্ঞেস করে, ইসলামে সমকামিতার শাস্তি কী? এ সম্পর্কে তোমাদের শরিয়ার বই কি বলে?

তারা আপনাকে প্রশ্ন করে, যাতে আপনাকে সমস্যায় ফেলতে পারে। উপলব্ধি করুন, সাধারণত জানার ও শেখার জন্য তারা এ প্রশ্ন করে না। তারা এই প্রশ্ন করে, যাতে দশ সেকেন্ডের একটা ক্লিপস নিয়ে (ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ায়) ফক্স নিউজে প্রচার করতে পারে। তারা আপনার থেকে ফিকহ জানতে আগ্রহী নয়; তারা আপনাকে ব্যাকওয়ার্ড, বর্বর চিত্রিত করতে চায়। তারা আপনার উত্তর নিয়ে কেটে দশ সেকেন্ডের একটি ভিডিও বানিয়ে প্রচার করবে এবং বলবে, দেখো মুসলিমরা এটাই বিশ্বাস করে। বাস্তবতা হলো এই প্রশ্ন খুবই নুয়ান্সড (সূক্ষ্ম : যা সাধারণত মনোযোগ এড়িয়ে যায়, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ) ।

ইতোপূর্বে আমি এ বিষয়ে দীর্ঘসময় কথা বলেছি। এখানে দুই মিনিট কথা বলব। যখন আপনাকে কেউ খুবই অকয়ার্ড প্রশ্ন করে, তখন আপনাকে সরাসরি উত্তর দেয়া থেকে সরে আসতে হবে। আপনি তাকে বলবেন, দেখো আমি তোমাকে দশ সেকেন্ডের ক্লিপ দিতে পারব না। আমাকে অন্তত বিষয়টি নিয়ে দুই থেকে তিন মিনিট কথা বলতে হবে।

এরূপ প্রশ্নের দিতে হবে মাল্টি লেয়ারে। অন্তত চারটি ধাপে।

এক. ক্লাসিক্যাল টেক্সট বুক
এ বিষয়ে আমাদের ক্লাসিকাল আইনের গ্রন্থ কী বলেছে তা উল্লেখ করা। সে আপনার থেকে এটাই শুনতে চায়। সে আপনার কাছ থেকে শুনতে চায়, এই অপরাধ সম্পর্কে ইসলামিক স্কলাররা কী বলেছেন।

তারা এটা মিডিয়ায় প্রচার করবে। কিন্তু আপনি তাকে সেই সুযোগ দেবেন না। হ্যাঁ, এর শাস্তি শরিয়ার কিতাবে আছে। কী আছে তা আমি দশ মিনিট আগেই তা উল্লেখ করেছি। আপনি এর সাথে বাকি বিষয়াবলিও উল্লেখ করবেন।

দুই. ইতিহাস
আমরা অধিকাংশ মুসলিম ইতিহাস নিয়ে তেমনটা চিন্তা করি না। বাস্তবে এই আইন কতবার কার্যকর হয়েছে? ইসলামী খিলাফতের সাথে এর সম্পর্ক কতটুকু। ইতিহাসের প্রতি লক্ষ করলে দেখবেন, এ প্রশ্ন খুবই আই ওপেনিং।

আপনি কি মনে করেন, আমাদের ইসলামী ভুখণ্ডে কেউ মদ পান করতো না। ইসলামের প্রত্যেক দশকে মদ এভেইলেবেল ছিল। এতে কোনো ব্যতিক্রম নেই। ফিকহের বই বলছে, যা যথোপযুক্ত। আলেমরা তাই প্রচার করছে। এটাই যথার্থ। ফুকাহা ও খতিবরা তাই বলেছেন। যথার্থই বলেছেন।

কিন্তু আপনি কি মনে করেন সমগ্র ইতিহাসে উম্মাহর শতভাগ মুসলিম মদপান থেকে বিরত ছিল? বাস্তবতায় নেমে আসুন। সমগ্র চিত্র অনুধাবন করতে চেষ্টা করুন। চিন্তা করুন, সে সময়ের আলেম ও জনসাধারণের মধ্যে সম্পর্ক কেমন ছিল। এখনও একই অবস্থা। আলেমরা নৈতিকতা শিক্ষা দেন, কতেক শুনে কতেক অমান্য করে। এটাই তো বাস্তবতা।

এ বিষয়ে ডকুমেন্টেড অনেক তথ্য রয়েছে। অ্যাক্যাডেমিক, হিস্টরিক্যাল অনেক বই রয়েছে। হার্ভাড প্রফেসর খালিদ আল রুয়াইহিব মুসলিম বিশ্বে হোমোসেক্সুয়ালিটি বিষয়ে একটি বই( Before Homosexuality in the Arab-Islamic World, 1500-1800) লেখেন। তিনি বর্ণনা করেন, সবাই জানত মুসলিম বিশ্বের এখানে সেখানে এসবের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু কোন আলেম এটাকে বৈধ বলেনি। আব্বাসীয়, উমাইয়া ও অটোম্যান আমলে সবাই তাদের সম্পর্কে জানত। এমনি আমাদের মুসলিম কালচারেও এমন লোক আছে। আমরা জানি, তারা কারা। সমাজ জানে তার মধ্যে তারা কোথায় বাস করে, সমাজ জানে কি চলছে। কিন্তু তারা তা উপেক্ষা করে যায়। তারা উপেক্ষা করে করে মানে এই নয়, তারা তার বৈধতা দেয়। যতক্ষণ তারা পাবলিকলি করছে না, ততক্ষণ এটা তাদের মধ্যে ব্যপ্ত থাকছে। শরিয়ার কাজ এটা নয় যে, মানুষের বাড়িতে স্পাই ক্যামেরা সেট করবে। শরিয়ার কাজ এটা নয় যে, মানুষের বাড়ির দরজায় গিয়ে করাঘাত করবে এবং দরজা খুলে দেখবে ঘরের ভিতরে কি চলছে।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে, এটা নরমালাইজেশন নয়। এটাই সত্য। মানুষ মদ পান করেছে, যিনা করেছে। সমগ্র ইসলামের ইতিহাসে মানুষ এই অপরাধ করেছে। আব্বাসী কিছু বিখ্যাত কবিদের এই অপরাধ প্রসিদ্ধ। থিওরির পাশাপাশি আমাদের বাস্তবতা নেমে আসতে হবে। থিওরি সব সময় কঠোর। সব সময় আইডিয়েল। বাস্তবতা থিওরিকে টেম্পার ডাউন করে। সকল ইসলামি ভূখণ্ডে আইডিয়াল সুরক্ষিত ছিল কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় তার পূর্ণ প্রতিফলন ছিল না। ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই অপরাধের শাস্তি শরিয়ার কিতাবে বর্ণিত আছে, কিন্তু বাস্তবায়িত হয়েছে কদাচিৎ।

তিন. মোরালিটি ইন মুসলিম ল্যান্ড
ফিকহ যথার্থ নীতি বর্ণনা করছে। কিন্তু আধুনিক সময়ে এর ফাইন টিউনিং-এর কোন সুযোগ আছে কিনা? (ফাইন টিউনিং হলো, সর্বোচ্চ ও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছুটা খাপ খাইয়ে নেওয়া।)

সকল ক্লাসিকাল অভিমতে শাস্তি যেভাবে বলা আছে, সেভাবে বাস্তবায়ন সবসময় অপরিহার্য নয়। আধুনিক মুসলিম সমাজ এ বিষয়ে রিথিংক করতে পারে কিনা, এটা খুবই ভালো প্রশ্ন। মর্ডান মুসলিম ফিকহ কাউন্সিল এবং স্কলাররা এ বিষয়ে দায়িত্ব নেয়া উচিৎ।

ভূখণ্ড শরিয়া দ্বারা পরিচালিত। আমরা সকলে জানি, পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইন মডার্ন ডিবেট সৃষ্টি করেছে। আলেমরা পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ক্লাসিকাল টেক্সটের বিষয়ে রিথিংক করার সুযোগ আছে কিনা? প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সময় এ প্রশ্ন রাখা যেতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এতে সম্পৃক্ত নই। মর্ডান মুসলিম ফিকহ কাউন্সিল ও স্কলাররা এ বিষয়ে চিন্তা করতে পারেন ।

চার. এটা আমাদের সাথে খুবই প্রাসঙ্গিক। আমরা ওয়েস্টার্ন মুসলিমরা হুদুদ পানিশমেন্ট সম্পর্কে কি বলা উচিৎ। ক্লাসিক্যাল টেক্সট বুকে প্রাপ্ত আইন সম্পর্কে আমাদের দায়িত্ব কী? আমেরিকায় বসবাস করা কোন মুসলিম হুদুদ দাবি করতে পারে কিনা। শরিয়া আমাদের থেকে কি এটা দাবি করছে? এখানে আমরা দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে চাই, মুসলিম সংখ্যালঘু দেশে হুদুদ দাবি করা আমাদের আমাদের কাজ নয়।

এর সুস্পষ্ট দলিল-- মুসলিমদের আবিসিনিয়ায় বসবাস। রাসূল সা. মুসলিমদের আবিসিনিয়ায় যেতে বলেছেন। তারা সেখানে সমাজের সদস্য হয়ে বসবাস করেছেন। তারা তাদের মাঝে হুদুদ বাস্তবায়ন করেননি। তারা এসব পানিশমেন্ট কার্যকর করেননি। কারণ এটা তাদের ভূমি ছিল না। সুতরাং আমাদের এই বিষয়ে খুব স্বচ্ছ হতে হবে।

যদি কোনো রিপোর্টার মাইক্রোফোন নিয়ে দশ সেকেন্ডের ভিডিওর জন্য আসে, তাকে তার বাজে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে দেবেন না। বরং আপনি নির্ধারকের ভূমিকা নেবেন। আমরা বলি, আমরা কোন শাস্তির বাস্তবায়ন চাচ্ছি না। আমরা আমাদের বিশ্বাসকে ক্রিমিনালাইজ হতে দিতে চাই না। আমরা আমাদের মেথডোলজি ক্রিমিনালাইজ হতে দিতে চাই না। আমার অধিকার হলো, আমি এখানে আমার বিশ্বাসের অনুশীলন করব। আমরা কোন এক্ট অব বিগোট্রি দাবি করছি না (ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণু আইন)। আমরা কোনো ভিজিলান্ট জাস্টিসও চাই না ( কোনো অপরাধের শাস্তি প্রদানের জন্য নিজেকে কতৃপক্ষের মনে করা) । আমরা ঘৃণা ছড়াচ্ছি না, সহিংসতা চড়াচ্ছি না।

বিপরীতে আমরা সুস্পষ্টভাবে বলছি, এই দেশের সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার অনুসারে আমরা আমাদের দ্বীন অনুশীলন করতে চাই। আমরা মুসলিম হতে চাই; আমরা এমন মুসলিম হতে চাই যারা নিজের আইডেন্টিটির প্রতি বিশ্বস্ত। আমরা মুসলিম হতে চাই, ক্রিমিনালাইজড হওয়া ছাড়াই।

পাঁচ. এই পয়েন্টে আলাদাভাবে আলোচনা করা উচিৎ। আমরা যদি সত্যিকারে এলজিবিটি মুভমেন্টের পথ পরিক্রমা বুঝতে চাই, তবে আমাদের এ মুভমেন্টের ইতিহাস পড়তে হবে। আমাদের জানতে হবে, কীভাবে এক প্রজন্মের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গি ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গিয়েছে। যাদের বয়স ত্রিশের উপরে, তারা জানেন আমি কী বলছি। যাদের বয়স বিশের নিচে তারা হয়তো জানবেন না। এখানে যারা বাস করেন; যাদের বয়স চল্লিশ পঞ্চাশ, বিশেষ করে ষাটের অধিক তারা জানেন পরিস্থিতি কিভাবে রাত দিনের মতো পরিবর্তন হয়ে গেছে। একটি লাইফটাইমের মধ্যেই। আমরা তাদের প্রতি কেমন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করি, সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু যে কোনো সোশ্যাল মুভমেন্টের চেয়ে এটা সবচেয়ে বেশি সফলতা লাভ করেছে। আমরা এটাকে ভালো কী মন্দ মনে করি সেটা বলছি না। আমি বলছি, একটি জেনারেশনের মধ্যে তারা র্যাডিক্যাল সফলতা লাভ করেছে। সিভিল রাইট আইন সফলতা পেতে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হতে দীর্ঘ সময় বয়ে গেছে। আমরা কি বিশ্বাস করি সেটাকে একপাশে রেখে মূল্যায়ন করলে দেখা যাবে, এই মুভমেন্ট বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেছে একটি প্রজন্মের মধ্যে। আর কোন মুভমেন্ট এর মতো এত দ্রুত সফলতা লাভ করেনি।

আমরা যারা এই বিষয়ে কথা বলতে চাই, আমাদের গবেষণা করা উচিৎ পরিস্থিতি কিভাবে এত দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেছে। এ দেশের প্রত্যেকটি স্ট্যাটে সমকামিতা ক্রাইম হিসেবে পরিগণিত ছিল। প্রতিটি ইউরোপীয় দেশে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু কীভাবে এক প্রজন্মের মধ্যে এই দ্রুত পরিবর্তন ঘটল। একসময় সর্বসম্মতিক্রমে এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল। কিন্তু এখন এ ইতিহাস উদ্ধৃত করাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কিভাবে ঘটেছে?

এলজিবিটি মুভমেন্টের ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উল্লেখ করব। অধিকাংশ মর্ডান হিস্টোরিয়ানরা ১৯৬৯ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এটা স্টোনওয়াল রায়ট নামে প্রসিদ্ধ। সেখানে মদের বার ছিল এবং এলজিবিটি এর সদস্যরা যাতায়াত করত। সেখানে পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে। স্টোনওয়ালের লোকজন পুলিশকে পাল্টা আক্রমণ করে। তারা বলে, আমাদের বাধা দেয়ার কোন অধিকার তোমাদের নেই। এটা নিউইয়র্ক অবস্থিত।

বিবেচনা করা হয় এর ফলে এলজিবিটি অ্যাডভোকেসি মুভমেন্ট শুরু হয়। এই প্রথম সমাজের বিদ্যমান ধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি (status quo) পরিবর্তনের প্রচেষ্টা শুরু করে। অবশ্য এর বিরুদ্ধে অনেক প্রতিরোধ হয়েছে সত্তর-আশির দশকে। এলজিবিটি মুভমেন্ট অনেক মেথডোলজি প্রণয়ন করে। এডভোকেসি গ্রুপ খোলে। এরমধ্যে প্রসিদ্ধ গ্রুপ হলো গ্লাড (Glaad)। নর্থ আমেরিকায় ১৯৮৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

আশির দশকে তারা ফ্রন্টলাইনে চলে আসে; রাজনীতিবিদ ও অভিনেতারা এর সাথে সংযুক্ত হতে শুরু করে। ১৯৮৭ সালে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার এই ইস্যুতে কথা বলেন। সংসদ সদস্যরা করতালির মাধ্যমে তার বক্তব্যকে সমর্থন জানান। লক্ষ করুন, তখনও এর প্রতি ইংল্যান্ডের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক ছিল। আমি মার্গারেট থ্যচারের ভক্ত নই। তাকে সমর্থন বা তার বিরোধিতা কোনোটাই করছি না, জাস্ট ঘটনাটি বর্ণনা করছি।

প্রধানমন্ত্রী স্কুলে হোমোসেক্সুয়ালিটির প্রসার নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি বিরক্ত হন, বিক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেন, এটা আমাদের সন্তানদের জন্য ভালো নয়। সংসদ সদস্যরা জোর করতালি দিয়ে তা সমর্থন করেন। তাদের অভিব্যক্তি ছিল, ফাইনালি আমরা শক্ত অবস্থান নিয়েছি।

এটা ১৯৮৭ সালের ঘটনা। আমি কেবল সত্যটা তুলে ধরছি। লক্ষ করুন, বিশ বছরের মধ্যে কি ঘটে গেছে! এখন প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, অখ্যাত কোনো অভিনেতাও তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করবে না। ১৯৮৭ সালে সেকশন 28 নামে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট আইন পাস হয়। লোকাল অথরিটি, স্কুল অথরিটি সমকামী লাইফস্টাইল নিষিদ্ধ করে। এ আইন বাতিল করা হয় ২০০৩ সালে।

১৯৮৭ সালে এলজিবিটি এডভোকেসি গ্রুপের দুইজন ইন্টেলেকচুয়াল চিন্তক সদস্য, একজন হার্ভার্ড গ্রাজুয়েট, নিউরো সাইকিয়াট্রিস্ট মার্শাল ক্যানিথ ক্রিক, অন্যজন এডভার্টাইজিং এক্সপার্ট হান্টার ম্যাডসন। তারা দুজনে সম্মিলিতভাবে একটি বই লেখেন, After Ball : How America Will Conquer its Fear and Hatred of Gays in the 90's. এটা অ্যামাজনের পাওয়া যায়।

হে মুসলিমরা, এটা কন্সপিরেসি থিওরি নয়। এটা ইলুমিনাতির মতো কিছু নয় যে, অন্ধকার রুমে অবতরণ করে সব সম্পন্ন করে ফেলেছে। তাদের ছিল স্ট্রাটেজিক প্ল্যান। আপনি যদি কোন কিছু অর্জন করতে চান, তবে আপনাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, একটি প্লান তৈরি তৈরি করতে হবে, তার জন্য কাজ করতে হবে, প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

হে মুসলিমরা, কন্সপিরেসি থিওরি বিশ্বাস করা বন্ধ করুন। আমি খুশি হতাম মুসলিমরা যদি ইসলামিক পিআর-এর জন্য এমন সফলতা অর্জন করতে পারত। মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হোন, ইসলামের জন্য কাজ করুন।

তাদের একদল চিন্ত্যক একসাথ হয়েছিল। তারা স্ট্রাটেজিক প্ল্যান তৈরি করেছে এবং তা প্রকাশ করেছে। অ্যামাজনে এভেলেবেল। তাদের লক্ষ্য কী ছিল? তাহলো বইয়ের সাবটাইটেল, আমেরিকা কীভাবে নব্বই-এর দশকে সমকামীদের প্রতি লালিত ঘৃণা ও ভয় জয় করবে।

তারা ছয়টি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারা বলে, এটা এবার সবাই শুরু করো।

এক. সব সময় সমকামী আইডেন্টিটি, সমকামিতা সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব স্পষ্ট ও উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতে হবে। এটাকে মেইনস্ট্রিমে পরিণত করতে হবে। এটা স্বাভাবিক করে তুলতে হবে। সমকামিতা যেন কনভারসেশনে পরিণত হয়।

দুই. এলজিবিটি মুভমেন্টের সদস্যদের ভিকটিম হিসেবে উপস্থাপন করুন। তাদের এমন করে উপস্থাপন করুন যারা status quo ( সমাজের বিদ্যমান অবস্থা) পরিবর্তন করতে চায় না। বরং তাদের এমন করে চিত্রিত করুন,যেন তারা সমাজের ঘৃণার শিকার।

তিন. যারা এলজিবিটির জন্য কাজ করছে তাদের সুপার হিরো হিসেবে উপস্থাপন করুন। তাদের সিভিল রাইট ফাইটার্সের মর্যাদা দান করুক। তাদের এমনভাবে উপস্থাপন করুন যাতে মনে হয়, তারা ন্যায়ানুগ অধিকারের জন্য সংগ্রাম করছে।

চার. মিডিয়ায় এলজিবিটি সদস্যদের চমৎকার, হ্যান্ডসাম ও চিন্তাশীল হিসেবে উপস্থাপন করুন। তাদের মেইনস্ট্রিম ও সম্মানিত হিসেবে উপস্থাপন করুন।

পাঁচ. এটা ঠিক বিপরীত। যারা তাদের সমালোচনা করে, তাদের টিটকারী করে, তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করে; তাদেরকে নির্বোধ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে। তাদের বর্বর ও অসহিষ্ণু হিসেবে চিত্রিত করতে হবে। এলজিবিটি সদস্যদের এমনভাবে উপস্থাপন করুন, যাতে তাদের ভালো এবং এর বিরোধিতাকারীদের খারাপ হিসাবে চিত্রায়ণ করা যায়।

ছয়. যাদের থেকে থেকে কর্পোরেট ফান্ডিং পাওয়া যাবে তাদের আক্রমণ করা যাবে না।

@Saifullah

[ড. ইয়াসির ক্বাদির লেকচার থেকে অনুবাদকৃত।]

পঠিত : ১২৬৭ বার

মন্তব্য: ০