Alapon

বাংলাদেশের শ্রম ও শ্রমিকদের অবস্থা



শ্রম ছাড়া কোনো কিছুই উৎপাদন করা যায় না- এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু, কর্ম ঘণ্টা কতোক্ষণ হবে? শ্রমশক্তি বিক্রি করে যে শ্রমিক সে কি তার শ্রম সময়ের মুল্য নির্ধারণ করতে পারবে? কতোক্ষণ কাজ করলে এবং কতোটুকু মূল্য পেলে তার জীবন বিকশিত করার সুযোগ সে পাবে, জীবনের চাহিদা বলতে আসলে কী বুঝায়, শ্রমের কাজে নিয়োজিত পশু এবং মানুষের ভূমিকা, মূল্য এবং মর্যাদা কীভাবে বিবেচিত হবে, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদন ও জীবন বিকাশের জন্য সংস্কৃতি নির্মাণে শ্রমের ভুমিকা কী, শ্রমিক কি শুধু প্রয়োজনীয় দ্রব্য উৎপাদনে শ্রম প্রদান করে নাকি সে উৎপাদিত দ্রব্যের ক্রেতাদের এক বিপুল অংশ, লক্ষ-কোটি শ্রমিক পণ্য না কিনলে তা বিক্রি হবে কীভাবে, শ্রমিকের মজুরি উৎপাদিত দ্রব্যের বিপণনে কী ভূমিকা রাখে, ন্যায্য মজুরি আসলে কতো হবে, মুনাফা আসে কোথা থেকে, মুনাফা বৃদ্ধিতে মালিকের তৎপরতা কতো ধরনের, শ্রমিক কেনো মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে অংশ নেয়, শ্রমিকের জীবন এবং ভবিষ্যৎ শ্রম শক্তি তার সন্তানদের জীবন কেমন হবে? এরকম অসংখ্য প্রশ্নের ঘনীভূত রূপ হিসেবে দাবি উঠেছিলো ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস চাই।

এই দাবীর অন্তরালে ছিলো আর একটি দাবি– ৮ ঘণ্টা কাজ করে এমন মজুরি চাই যেনো তা দিয়ে আমার পরিবার নিয়ে মানসম্পন্ন জীবনযাপন করতে পারি। কিন্তু, শ্রমিকদের দাবি যতোই ন্যায়সঙ্গত মনে হোক না কেনো, মুনাফা ও মজুরির সংঘাত এতো তীব্র যে আলোচনার পথে নয় বরং নিষ্ঠুর দমন ও রক্তাক্ত পথে সরকার ও মালিকরা সেই আন্দোলন দমন করতে চেয়েছিলো।

১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে লাখ-লাখ শ্রমিক সমবেত কণ্ঠে দাবি তুলেছিলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত নয়, ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস চাই। মে মাসের ৩ এবং ৪ তারিখে সেই আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমন করাই শুধু নয় আন্দোলনের নেতা অগাস্ট, এঞ্জেলস, স্পাইস, ফিসারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়।

শিকাগো শহরের সেই রক্তাক্ত আন্দোলন শ্রমিকের বেদনা ও বিক্ষোভের রূপে ছড়িয়ে পড়েছিলো সারা পৃথিবীতে আর মে দিবস পরিণত হয়েছে আন্তর্জাতিক দিবসে।

ফরাসি বিপ্লবের আকাঙ্খা এবং সাম্য প্রতিষ্ঠার চেতনার মধ্যে জন্ম নিয়েছিলো মে দিবসের চেতনা। ফরাসি বিপ্লব শুধু সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতা, ভ্রাতৃত্বের স্লোগান তুলেনি সাথে সাথে মত প্রকাশের, মত প্রচারের, মত প্রতিষ্ঠার অধিকারের আকাঙ্খার জন্ম দিয়েছিলো।

১৭৮৯ সালের পরের পৃথিবী তাই আর আগের মতো থাকেনি। মানুষ বাঁচবে কীভাবে, মর্যাদা আর অধিকার ছাড়া মানুষের জীবন কি পশুর জীবনের মতো হয়ে যায় না? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে শ্রমের ভূমিকার কথা ভাবতে হয়েছে। এডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকারড দেখালেন মানুষের শ্রমের ফলেই মূল্য তৈরি হয়। মূল্যের শ্রমতত্ত্ব স্বীকার করলো শ্রমিকের শ্রমের ভুমিকার কথা। কিন্তু, তার বিনিময়ে শ্রমিক কী পাবে সে প্রশ্নের সমাধান হলো না।

গ্রাম থেকে উঠে এসে কারখানা-শ্রমিকে পরিণত হওয়া মানুষটি জীবন বাঁচাতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করছে। কিন্তু, তার জীবনের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। অথচ মালিকদের প্রাচুর্য ও জৌলুস বাড়ছে। এই বৈষম্য তাদের মধ্যে বিক্ষোভের জন্ম দিতে শুরু করলো যার ফলশ্রুতিতে কারখানা ভাঙ্গা, ম্যানেজার হত্যার মতো ঘটনা ঘটতে শুরু করলো। অভিজ্ঞতা থেকে শ্রমিক শ্রেণি বুঝেছিলো যে এ পথে তো সমাধান আসবে না তাই ১৮৭১ সালে পারি কমিউন প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করেছিলো তারা।

পারি কমিউনের পরাজয়ে সাময়িক থমকে দাঁড়ালেও শ্রমিকের সমস্যা যেহেতু সমাধান হয়নি তাই আন্দোলন ছড়িয়ে পরে দেশে দেশে। এরকম বহু আন্দোলন আর পরাজয়ের বেদনার মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছিলো ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের আন্দোলন।

১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ফ্রেদেরিক এঙ্গেলসের উপস্থিতিতে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সারাবিশ্বে মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। যদিও যে দেশে মে দিবস আন্দোলনের সূচনা সেই আমেরিকাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস পালিত হয় না। তারপরও পৃথিবীর অন্তত ৮০টি দেশে মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে স্বীকৃত। আর সারাদুনিয়ার শ্রমজীবী মানুষ গভীর আবেগে মে দিবস পালন করে তাদের শ্রমদাসত্ব থেকে মুক্তির আকাঙ্খা নিয়ে।

বাংলাদেশ ও মে দিবস
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মে দিবসের প্রধান দাবি ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ২২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলেও কোটি কোটি বেসরকারি শ্রমিক কর্মচারীরা এখনও ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের সুফল পায় না। বরং শ্রম আইনে কৌশলে ১০ ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিম্ন মজুরির ফাঁদে শ্রমজীবী মানুষকে এমনভাবে আটকে ফেলা হয়েছে যে শ্রমিকরা এখন বাধ্য হয় ওভার টাইম করতে, তা না হলে তার সংসার চালানো অসম্ভব।

কার্ল মার্ক্স হিসাব করে দেখিয়ে ছিলেন মালিকের মুনাফা বাড়ানোর পথ দুটি। শ্রমিকের শ্রম, সময় বাড়ানো আর যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো। ফলে কর্মঘণ্টা বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। বিপুল সংখ্যক বেকার শ্রম বাজারে রিজার্ভ আর্মির কাজ করছে বলে কম মজুরিতেই তাদের কাজ করানো সম্ভব হচ্ছে।

প্রতি বছর শ্রমবাজারে কাজ প্রত্যাশী ২০/২২ লাখ তরুণ-যুবক আসে যাদের মাত্র দুই লাখের মতো কর্মসংস্থান রাষ্ট্র করতে পারে। এরপর, সাত থেকে ১০ লাখ মানুষ পাড়ি জমায় বিদেশে কাজ করতে। আর বাকিরা দেশে কোনোমতে কাজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। দেশের ছয় কোটি ৩৪ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে প্রায় তিন কোটি কাজ করে কৃষিখাতে। যেখানে বছরে ৩ মাসের বেশি কাজ থাকে না ফলে বহু ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের মাধ্যমে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। এর বাইরে ৪০ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টসে; ৩০ লাখের বেশি নির্মাণ খাতে; ৫০ লাখ পরিবহন খাতে; ১০ লাখের বেশি দোকান কর্মচারী; পাট, চা, চামড়া, তাঁত, রি রোলিং, মোটর মেকানিক, লবন, চিংড়ি, সংবাদমাধ্যম, হাসপাতাল-ক্লিনিক, পুস্তক বাঁধাই, হকার, রিকশা–ভ্যান চালক, ইজি-বাইক চালক, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করছে।

শ্রম শক্তির ১ কোটি ২ লাখ প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকে। মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৪৩টি সেক্টরের শ্রমজীবীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি কোটি কোটি শ্রমিকের ‘কাজ নাই তো মজুরি নাই’ নীতিতে কাজ করানো হয়ে থাকে। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথে আইনি এবং আইন বহির্ভূত অসংখ্য বাধা। সে কারণে ২ লাখের মতো ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান থাকলেও ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৮ হাজারের কম। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টসে ৪ হাজারের বেশি কারখানা থাকলেও ট্রেড ইউনিয়ন আছে এমন কারখানা কাগজে কলমে ৬৬১টি। বাস্তবে সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা আরও কম। দেশের ৮টি ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই।

আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে অনুসমর্থন করলেও স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করা ও পছন্দমত নেতা নির্বাচনের অধিকার থেকে শ্রমিকরা বঞ্চিত। ট্রেড ইউনিয়ন হলো শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ ও শিক্ষিত হওয়ার একমাত্র উপায় যা না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শ্রমিকরা অসহায়। মালিকদের ক্ষমতা আর শ্রম আইনের সহায়তা নিয়ে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করা ও টিকিয়ে রাখাকে দুঃসাধ্য করে ফেলা হচ্ছে। এবং এ কারণেই স্বল্প মজুরি আর দীর্ঘ কর্ম সময়ের দুষ্ট চক্রে বাধা পরে রয়েছে বাংলাদেশের শ্রমিক। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মাথা পিছু আয় বাড়ছে। মাথা পিছু আয় বর্তমানে ১,৯০৯ ডলার। ডলার ৮৪ টাকা ধরলে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার ৩৫৬ টাকা অর্থাৎ মাসিক দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৩৬৩ টাকা। অথচ দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতের শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। ফলে উৎপাদনের প্রধান চালিকাশক্তি শ্রমিক মাথা পিছু আয়ের তুলনায় কম মজুরি পাচ্ছে এবং বৈষম্য ক্রমাগত আকাশচুম্বী হচ্ছে। মে দিবসের স্লোগানে এই বৈষম্যের কথাই মূর্ত হয়ে উঠছে।

কর্ম সময় কমছে না বরং আধুনিক যন্ত্র কেড়ে নিচ্ছে কাজ
যন্ত্রের শক্তি মানুষের শ্রমকে লাঘব করবে। ফলে অল্প সময়ে বেশি উৎপাদন হবে- এই প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে শ্রমিকের শ্রম সময় কমছে না। নারী শ্রমিকের শিল্পে আগমন বেড়েছে কিন্তু তাদের মাতৃত্ব, সংসারের কাজ নিয়ে দ্বিগুণ চাপ বহন করতে হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং একঘেঁয়ে সাংসারিক কাজ নিংড়ে নিচ্ছে নারীদের শ্রমশক্তি। দ্রুত হারিয়ে ফেলছে সে তার কাজ করার ক্ষমতা। তাই দেখা যায় যে, শিল্প কারখানায় ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারী শ্রমিক কাজ করতে পারছে না। অন্যদিকে কারখানার উচ্চপদে বা ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে নারী শ্রমিকদের উপস্থিতি কম। ওভার টাইম আর যন্ত্র মিলে অল্প শ্রমিক দিয়ে বেশি কাজ করানোর ফলে কর্মক্ষম যুবশক্তির একটি বড় অংশ বেকার। এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে বিশ্বব্যাপী। এর মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুচনা হয়েছে বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন তা এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মুনাফা এবং মজুরির যে বিরোধ- সেই বিরোধে শ্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দুর্বল এবং শোষিত। ফলে সারাদুনিয়াতে খাদ্য-পণ্য ও ব্যবহারিক পণ্য উৎপাদন সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ফেললেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আয়ের বড় অংশ খাদ্য, বাড়িভাড়া, পোশাক, চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে যাওয়ার ফলে সঞ্চয় যেমন থাকছে না তেমনি দক্ষতা অর্জনের জন্য বাড়তি খরচ করাও শ্রমিকের জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাহলে ডিজিটাল দক্ষতা শ্রমিকরা অর্জন করবে কিভাবে? চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কি তাহলে বেকারত্বের ভয়াবহতা নিয়ে আবির্ভূত হবে? উৎপাদন এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির এই দুষ্টচক্র সামাজিক সব শৃঙ্খলাকেই ভেঙ্গে ফেলবে। উৎপাদন বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা এবং আগ্রাসী পুঁজিবাদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ও ন্যায্য মজুরির কোনো বিকল্প নেই। ফাঁসির মঞ্চে দাড়িয়ে অগাস্ট স্পাইস যে উক্তি করেছিলেন– The time will come when our silence will be more powerful than the voices you strangled today.

বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের পটভূমিতে মে দিবস বার বার সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

পঠিত : ৭৮৮ বার

মন্তব্য: ০