Alapon

মিজানুর রহমান আজহারি এবং আমাদের বাড়াবাড়ি...


১.
বাংগালীর বৈশিষ্ট্যঃ
বাংগালীর স্বভাব চরিত্র নিয়ে একটা কৌতুক মনে পড়ে গেল।
এক জেলখানায় কয়েকজন বাংগালী, আমেরিকান ও রাশিয়ান বন্দীরা আছেন।
এক ইন্সপেক্টর এলেন সেই জেল পরিদর্শনে। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন, আমেরিকান ও রাশিয়ান বন্দীদের ক্ষেত্রে আছে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আছে সারভেইল্যান্স ক্যামেরা, উচু দেয়াল। তার উপরে শক্তিশালী ছাদ।পালানোর কোন সুযোগই নেই। কিন্তু বাংগালী বন্দীদের বেলায় ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন। উপরে ছাদ নেই, চারিদিকে উঁচু করে দেয়া কাটা তারের বেড়া। প্রহরীদেরও অত কড়াকড়ি নেই। ইন্সপেক্টর অবাক হয়ে এর কারণ জানতে চাইলেন।
জেলার হাসিমুখে বললেন “দাড়ান স্যার! আপনাকে দেখাচ্ছি”। জেলার ইন্সপেক্টরকে নিয়ে গেল মনিটরের সামনে। সিসিটিভিতে দেখা গেল, এক বাংগালী বন্দী কাটাতারের বেড়া বেয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করছে। যখন প্রায় বেড়ার শেষ মাথায় উঠে যাবে, এমন সময় নিচ থেকে তিন চার জন বন্দী তাকে টেনে হিচড়ে নিচে নামিয়ে ফেলল।
এবার জেলার ব্যাখ্যা করল “বাংগালীরা একে অন্যের সুখ সহ্য করতে পারে না। ওদের জন্য আমাদের প্রহরীদের দরকার পড়ে না। কাউকে টেনে নামানোর জন্য ওরা নিজেরাই যথেষ্ট।“

দৌড় প্রতিযোগিতায় কাউকে পেছনে ফেলার উপায় দুইটি। হয়তো তার চেয়েও আগে দৌড়ানো। নয়তো ল্যাং মেরে তাকে ফেলে দেয়া। বাংগালীর কেন যেন দ্বিতীয়টিই বেশি পছন্দ। বাংগালী অন্যের জনপ্রিয়তা, লোকপ্রিয়তা সহ্য করতে পারে কম।
কেউ একজন তার মেধা পরিশ্রম, কর্মদক্ষতা দিয়ে উন্নতি করলে, আরও দশজন তার পেছনে লাগে। নানাভাবে চেষ্টা করে, কিভাবে মানুষের সামনে তাকে হেয় করা যায়।
তার যে কোন অসম্মান/ক্ষতিতে তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেন।

২.
আজহারি কেন ব্যতিক্রমঃ
মিজানুর রহমান আজহারিকে আমি চিনতাম না। মাঠে ময়দানের ওয়াজ মাহফিল থেকে আগ্রহ হারিয়েছি অনেক আগেই। এখনকার বেশিরভাগ মাহফিল বিনোদনমুলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান। বক্তারা শ্রোতাদের কিছুক্ষন হাসান, কিছুক্ষন কাদান। কিছুক্ষন উদ্ভট উদ্ভট শব্দ গল্প ফেদে শ্রোতাদের মাতিয়ে রাখেন। অনেক বক্তা আবার সিনেমার নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকার অনুকরন করে লোক হাসান। শুনতে পাই, যিনি যত বড় কমেডিয়ান, ওয়াজের ময়দানে তার ডিমান্ড তত বেশি। অনেক বক্তা ঘন্টা হিসেব করে টাকা নেন।
শ্রোতাদের ঘন্টা খানেক হাসিয়ে কাদিয়ে, আসর মজিয়ে তারা বিদায় নেন। যাওয়ার সময় নিয়ে যান পকেটভর্তি সম্মানি।

কিন্তু যদি বলা হয়, আজকের মাহফিল থেকে কি শিখলেন, শ্রোতারা আধ ঘন্টা ধরে মাথা চুলকান। তারাপর মৃদু হেসে বলেন “হুজুর আজকে দারুন জমাইছে!” হঠাৎ করে ফেসবুকে মিজানুর রহমান আজহারির কিছু ওয়াজ ভাইরাল হল। তার কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হল তুমুল সমালোচনা। আজহারিকে নিয়ে কেউ অনুরক্ত, কেউ বিরক্ত। জনগনের বিরাট অংশ এ নিয়ে দ্বিধা বিভক্ত। একদিকে আজহারির মাহফিলে মানুষের উপচে পড়া ভীড়। আজহারি যেখানে যান, সেখানেই জনতার ঢল নামে। মানুষের স্রোত সামাল দিতে প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিরা হিমশিম খান। অন্যদিকে আজহারির বিরুদ্ধে ফতোয়ার তুফান বয়ে গেল। মাঠে ময়দানের অন্য বক্তারা তাকে কাফের, গোমরাহ নানা ফতোয়া দিলেন। তার বিরুদ্ধে গরম গরম হুংকার ছাড়লেন। ফেসবুকে ইউটিউবে চলল তীব্র বাদানুবাদ। ভাবলাম, ব্যাপার কি? আজহারি আসলে কি বলে আর কেনইবা তাকে নিয়ে এত সমালোচনা?

৩.
আজহারি কেন জনপ্রিয়ঃ

মনোযোগ দিয়ে তার কয়েকটা লেকচার শুনলাম। দেখলাম, সমসাময়িককালের অন্যন্য ওয়ায়েজদের চাইতে তিনি কিছুটা ব্যতিক্রম। তিনি প্রতিটা মাহফিলে বিষয়ভিত্তিক কথা বলার চেষ্টা করেন। ইসলামের আলোকে জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয় নিয়ে নসিহত করেন।
তার সুন্দর উচ্চারন, আকর্ষনীয় বাচন ভংগী, গতানুগতিক আলোচনার বাইরে গিয়ে সময়োপযোগী বিষয় নির্বাচন তাকে অল্প সময়ে জনপ্রিয় করে তুলেছে। আমার ভাল লেগেছে, তিনি কোন বক্তা কিংবা আলোচিত মানুষদের নাম ধরে সমালোচনা করেন না। কাউকে নিয়ে ট্রল করেন না। তার বাচনভংগিতে বিনয়ের বহিপ্রকাশ দেখা যায়। আমার মনে হয়, সাধারন মানুষ এই গুনটাকেই বেশি পছন্দ করে। বিনয়ী মানুষকেই মানুষ বেশি ভালবাসে। এই একটি গুণ আর সব বক্তাদের থেকে তাকে আলাদা করেছে। মানুষের মধ্যে তার গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়েছে।

তাকে নিয়ে করা বিভিন্ন সমালোচনাও খেয়াল করলাম। কিন্তু বেশিরভাগ সমালোচনাই আমার কাছে সারবত্তাহীন ও বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। উপস্থিত শ্রোতাদের বোঝাতে গিয়ে কোন কোন সময় তিনি এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন, যা না করলেই ভাল হত। যেমন, সিক্স প্যাক, ভার্জিন, তালাক খাওয়া ইত্যাদি। কিন্ত তাকে কেন্দ্র যেভাবে কাফের ফতোয়া দেয়া শুরু হল, তার কোন শরয়ী ভিত্তি খুঁজে পেলাম না। কিছু কিছু মানুষ অন্যের ত্রুটি খুঁজে পেতে ওত পেতে থাকেন। কোথাও একটা কিছু পেলেই হল। ব্যাস! দ্বীনের লেবাসে সর্বশক্তি নিয়ে তার বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।

৪.
সমালোচনার রকমফেরঃ

ইসলামী ফিকহে মাসয়ালা মাসায়েল নিয়ে বহু ক্ষেত্রে আলিম উলামাদের ইখতিলাফ রয়েছে।
এমনও আছে একই বিষয়ে চার মাজহাবের চার ইমাম ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। এরে বাইরেও ইমাম ইবনে তাইমিয়া সহ আরও অনেক মুহাক্কিক মুজতাহিদ আলিম রয়েছেন, যারা একই মাসয়ালায় ভিন্নমত পোষন করেছেন। কেউ যুক্তির নিরিখে কোন একটা মতকে প্রাধান্য দিতে পারেন। দলীল বিচারে কোন মতকে রদ করতে পারেন। তাই বলে ভিন্ন মতটাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে পারেন না। ভিন্ন মতের আলিমকে গালাগাল দেয়াতো দূর কি বাত! অথচ আমাদের দেশে এই চর্চাটাই হয়ে আসছে। বিভিন্ন মাসয়ালায় মিজানুর রহমান আজহারি যে অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তার কোনটাই তার একক মত নয়। তার আগেও আরও অনেক আলিম একই মত দিয়েছেন। অথচ আলোচনা সমালোনা কেবল আজহারিকে নিয়ে। নেকাবের কথাই ধরা যাক। নারীদের সতর নিয়ে আলিমদের মধ্যে ইখতিলাফ আছে। অনেক আলিম, মুজতাহিদ, ফকিহ বলেছেন পর্দার ক্ষেত্রে নারীদের মুখমন্ডল ও দু হাত খোলা রাখার অনুমতি আছে। তবে চেহারাকে হতে হবে প্রসাধনমুক্ত।
মিশরের প্রখ্যাত আলিম আব্দুল হালিম আবু শুক্কাহ চেহারা খোলা রাখার বৈধতা নিয়ে স্বতন্ত্র একটি বই রচনা করেছেন। রাসুলের যুগে নারী স্বাধীনতা (৪র্থ খন্ড) নামে বইটি বিআইটি থেকে বাংলায় অনুদিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠকেরা বইটি পড়ে দেখতে পারেন। অন্যদিকে আলিমদের একটা বিরাট দল নারীদের চেহারা খোলা রাখার বিপক্ষে। দলীল প্রমানের বাইরে তাদের যুক্তি হল, চেহারাই হল মানুষের আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু। নারিদের চেহারা খোলা রাখা হলে তা অসংখ্য ফিতনার দ্বার উম্মুক্ত করে দিবে।

আজহারি তার অভিমতে বলেছেন, নারীদের চেহারা খোলা রাখার অনুমতি আছে। তবে চেহারা ঢেকে রাখাই অধিক উত্তম। কিন্তু তার এই মতকে কেন্দ্র করে যেভাবে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ সমালোচনার ঢেউ বয়ে গেল তা রীতিমত বিস্ময়কর। নামাজে ক্বুরান দেখে পড়া নিয়েও একই কথা প্রযোজ্য। নফল নামাজে ক্বুরান দেখে পড়া না পড়া একটি ইখতিলাফি মাসয়ালা। এটা নিয়েও আলিমদের মধ্যে দুটো ভিন্ন মত আছে। হযরত আয়েশা রা থেকে একটি হাদিস পাওয়া যায়। হাদিসের ভাষ্য মতে তার গোলাম যাকওয়ান নফল নামাজে ক্বুরান দেখে দেখে পড়তেন। আলিমদের একদল বলেন, আয়েশা রা যেহেতু তার গোলামের ক্ষেত্রে এমন কাজের অনুমতি দিয়েছেন, তাই এটা বৈধ। আজহারি এই মতটার কথাই উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে আরেক দল আলিমের মতে, এটা একটা ব্যতিক্রমি ঘটনা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের লক্ষ লক্ষ সাহাবীদের জীবনে এই একটি ঘটনার বাইরে এরকম উদাহরণ আর পাওয়া যায় নি। যদি এটি বৈধ ও উত্তম হত, তাহলে আরও অনেক সাহাবী এর অনুসরণ করতেন। কিন্তু তা হয় নি। তাই এটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, অনুসরনীয় নয়।
অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, আজহারি তার মত ব্যক্ত করার সাথে সাথেই ব্যঙ্গ বিদ্রুপের তুফান শুরু হয়ে গেল।

অথচ, এই বাংলাদেশে মুফতি কাজি ইবরাহিম, ডকটর সাইফুল্লাহ সহ সালাফি পন্থি অনেক আলিম বহু আগেই একই ফতোয়া দিয়েছেন। ইউটিউবে সার্চ দিলে তাদের সে বক্তব্যের ক্লিপ দেখতে পাওয়া যায়।

৫.
আজহারি নিয়ে সমালোচনা কেনঃ

মিজানুর রহমান আজহারি নতুন কিছু বলেননি। আগ থেকেই প্রচলিত আলিমদের একটা অংশের অভিমত ব্যক্ত করেছেন মাত্র। তাহলে তাকে নিয়ে এত সমালোচনা কেন?
এর বহুমুখি কারণ আছে।

এক. বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে আজহারির ‘আকাশ্চুম্বী’ জনপ্রিয়তা। তার ফ্যান ফলোয়ার অনেক। শুরুতেই বলেছিলাম, বাংগালী অন্যের ভাল সহ্য করতে পারে না। কারও বিপুল জনপ্রিয়তা চোখে পড়লেই কিছু মানুষ তাকে হেয় করতে মাঠে নামে।

দুই. প্রচলিত মতের বাইরে ভিন্ন মত পোষন। আজহারি এই অঞ্চলের অধিকাংশ আলিম সমাজের মধ্যে প্রচলিত মতামতের বাইরে ফতোয়া/অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবনতা হল, প্রচলনের বাইরে কোন কিছুকে গ্রহন করতে না পারা। নবী রাসুলদের ইতিহাস থেকে জানা যায়, তারা তাদের জাতির লোকদের কাছ থেকে সব সময় প্রবল বিরোধীতার সম্মুখিন হয়েছিলেন। সবার যুক্তি ছিল একটাই ‘তুমি কি আমাদের বাপ দাদার রসম রেওয়াজ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাও?’

সেই সব লোকেরা নবীদের দাওয়াতের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নি। বলে নি, নবিদের কথা অযৌক্তিক। তারা শুধু এতদিনকার চলে আসা মতামত/রসম/রেওয়াজের বিরোধিতাকে সহ্য করতে পারে নি। সে কারনেই নবীদের বিরুদ্ধে তারা শত্রুতা শুরু করে।
.
৬.
শেষ কথাঃ
মিজানুর রহমান আজহারি একজন দ্বীনের দ্বায়ী। আল্লাহ অল্প সময়েই তাকে মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। আমাদের উচিৎ তার কল্যান কামনা করা, তার জন্য দোয়া করা।
শুধু তিনি নন, দ্বীনের প্রত্যেক আলিমের প্রতিই আমাদের এই মনোভাব রাখা উচিৎ।
একজন সাধারন মানুষ হিসেবে, তিনি ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে নন। কথায়, চিন্তায়, কাজে তার ভুল হতেই পারে। আমাদের উচিৎ যুক্তি প্রমানের ভিত্তিতে তার ভুলগুলো তুলে ধরা। যেক্ষেত্রে আলিমদের মধ্যে ভিন্ন মত আছে, সেক্ষেত্রে ভিন্ন মতের প্রতি সহনশীল হওয়া, শ্রদ্ধা রাখা।
কোন অবস্থাতেই কিছু ভুলের কারনে/ভিন্ন মত পোষন করার কারণে অন্য আলিমকে কটাক্ষ করা, তীব্র সমালোচনা করা বাঞ্ছনীয় নয়।

মনে রাখতে হবে, তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ অনেক বেশি সচেতন। অন্যকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করা হলে মানুষের মধ্যে তার প্রতি সহমর্মিতা বাড়ে, পরিচিতি বাড়ে। তার প্রতি মানুষ আরও বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে। অন্যদিকে অযৌক্তিক কটুক্তিকারি/সমালোচনাকারীদের গ্রহনযোগ্যতা কমে। সাধারন মানুষ তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষন করে। তাদের প্রতি আস্থা হারায়। অতি আবেগী অন্ধ সমালোচক ভাইয়েরা এই কথা যত দ্রুত বুঝতে পারবেন, ততই মংগল।

@Omar

পঠিত : ৮৫৮ বার

মন্তব্য: ০