পরিমিত আহার, সুস্থতার হাতিয়ার...
তারিখঃ ৩ মে, ২০২০, ১৪:৫২
হযরত ওমর রাঃ এর দরবারে খ্রিষ্টান চিকিৎসকদের একটি দল এসে মদিনায় একটা হাসপাতাল নির্মানের অনুমতি চাইলো। খলিফা জনগনের কল্যানে তাদেরকে অনুমতি দিলেন। হাসপাতাল চালু করার এক মাসের মাথায় চিকিৎসক দল পুনরায় খলিফার দরবারে এলেন। তারা অনুযোগের স্বরে বললো, আমরা এসেছিলাম চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্ত বিগত একটা মাসে এখানে একজন রোগীও পেলাম না। আপনাদের মদিনা শহরে কি একজন রোগীও নেই? এখানকার লোকজন কি অসুস্থ হয় না? তখন আমিরুল মোমেনীন জবাব দিলেন,আমাদের নবী মুহাম্মদ ﷺ বলে গিয়েছেন "পেটে ক্ষুধা রেখে তোমরা আহার শুরু কর এবং কিছুটা ক্ষুধা রেখেই আহার শেষ কর"।
হযরত আবু বকর রাঃ বলেন,আমি তিনটি জিনিস তিনটি জায়গায় খুঁজলাম। কিন্ত সেখানে পেলাম না। সেগুলি পেয়েছি অন্য তিনটি জায়গায়। আমি রিযিককে খুঁজেছি দুনিয়ার ভিতরে। কিন্তু রিযিকের সন্ধান পেয়েছি আসমানে। আমি চিকিৎসাকে খুঁজেছি ওষুধের ভিতরে। আর স্বাস্থ্যকে খুঁজেছি ওষুধের ভিতরে,কিন্ত স্বাস্থ্যকে আমি খুঁজে পেলাম কম আহারের ভিতরে।
(মুনাব্বেহাত:ইবনে হাজার আসকালানী রহ
এক ব্যাক্তি ইসলাম গ্রহনের পূর্বে খুব বেশী পরিমাণে আহার করতো। তিনি মুসলিম হওয়ার পর অল্প আহার করতে লাগলো।ব্যাপারটি নবী ﷺ এর কাছে উল্লেখ করা হলে তিনি বললেন: "মু’মিন এক পেটে খায়, আর কাফির খায় সাত পেটে।"
অন্য একটি হাদীসে রাসূল ﷺ বলেন,
"আমরা খাই। তবে একেবারে তৃপ্তি পর্যন্ত আমরা খাই না এবং নবী (সা.) মূলত তাঁর খাবারের পদ্ধতি যখন বলেছেন, মুমিন ব্যক্তি এক ভুঁড়িতেই খায়, একদম সাত ভুঁড়ি পরিপূর্ণ করে খায় না।"
আমাদের পাকস্থলী একটি থলের ন্যায়। এ থলের কাজ হলো—খাদ্যনালী হতে খাদ্য গ্রহণ করে ব্লেন্ডারের মত মেশানো,খাদ্যকণাগুলোকে চূর্ণবিচূর্ণ করা,
এসিড আর এনজাইম দিয়ে খাবার হজম করা, কিছু জিনিস শোষণ করে বাকি জিনিস ক্ষুদ্রান্ত্রের দিকে ঠেলে দেয়া। আর এসব কাজের জন্য পাকস্থলীকে আল্লাহ নানা জটিল ডিজাইন দিয়ে তৈরি করেছেন।
এখানের মাংসপেশীগুলো মেশিনের মত কাজ করে। এই থলেকে যদি পুরো কিংবা অর্ধেকটা খাবার দিয়েই ভরে ফেলি, তখন মাংসপেশীর নড়াচড়া সঠিকভাবে হয় না।
স্থিতিস্থাপকতাও কমে যায়। ফলে সহজে খাবার হজম হয় না, পেট অনেক ভারী লাগে, আর আমরাও এর ফলে নানা রোগে আক্রান্ত হই।পৃথিবীতে নানা টাইপের থলে আছে। খাবার রাখার থলে, টাকা পয়সা রাখার থলে, বিভিন্ন রকম। আমরা থলেগুলো খালি রাখতে চাই না, সবাই ভরে ভরে রাখতে চাই।এসব ভরা থলির মধ্যে জানেন কোনটি সবচেয়ে বেশি খারাপ?আমাদের নবী মুহাম্মদ ﷺ বলেছেন-
"যে ব্যক্তি পেট ভরে খাবার খায় তার ঐ পেট (আল্লাহর কাছে) সবচেয়ে নিকৃষ্ট পাত্র।"
চিকিৎসাবিজ্ঞান অধিক আহার সমর্থন করে না। কেননা অধিক পরিমানে খাবার খেলে ব্যাক্তি নিজের মেরুদণ্ড সোজা রাখতে পারে না। একেবারে গলা পর্যন্ত খাওয়া মূলত ইসলামী পদ্ধতি নয়। সেজন্য ইসলাম পরিমিত খাবার খেতে নির্দেশ দেয়। একজন মানুষের জন্য ওজন করে খাদ্যের পরিমাপ ইসলাম নির্ধারিত
করে দেয়নি এবং এটি পরিমাপ করে দেয়াও সম্ভবও নয়। তাই ব্যক্তির পাকস্থলীকে পরিমাপের একক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নবী কারীম ﷺ ইরশাদ করেছেন:
"মানুষ যত পাত্র পূরণ করে, তার মধ্যে সবচেয়ে মন্দ পাত্র হচ্ছে তার পেট। আদম সন্তানের জন্য তো কয়েকটি লোকমাই যথেষ্ট। যা তার শিরদাঁড়া সোজা রাখতে পারে। আর যদি তৃপ্ত হয়েই খেতে হয়, তা হলে পেটের এক ভাগ খাদ্য, এক ভাগ পানীয় আর এক ভাগ শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য রাখবে।"(সুনানে তিরমিজী)
একজন দার্শনিকের নিকট যখন রসূলের এ নির্দেশ শুনান হল তখন সে বলতে লাগল, এর থেকে উত্তম ও শক্তিশালী কথা আমি আজ পর্যন্ত শ্রবণ করিনি।
সুস্থ-সবল শরীরে আল্লাহর ইবাদত করার উদ্দেশ্যে সাধ্যমতো উত্তম ও সুস্বাদু খাবার গ্রহণে ইসলামের কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তবে ইসলামে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ ও অপচয় করা থেকে নিরুৎসাহ করা হয়েছে।মহান আল্লাহ বলেন, "পানাহার করো, কিন্তু অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।" (সুরা আরাফ:৩১)
অতিভোজের ফলে বাড়তি মেদ ও অতিশয় মোটা হয়ে যাওয়ার দরুণ দুর্বিষহ জীবনযাপনের নজিরও পৃথিবীতে কম নয়। এ ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমার দেয়া পবিত্র সামগ্রী থেকে আহার করো, তবে এতে সীমা লঙ্ঘন করো না। তা হলে তোমাদের ওপর আমার অসন্তোষ নেমে আসবে। আর আমার অসন্তোষ বা ক্রোধ যার ওপর আপতিত হয়, সে বরবাদ হয়ে যায়।’(সূরা ত্বহা:৮১)
একদা হযরত ওমর রা: এর সাথে বাজারে মস্তবড় পেটওয়ালা এক ব্যাক্তির সাক্ষাৎ হলো। তখন ওমর রা: লোকটির পেটের দিকে আঙুল দ্বারা নির্দেশ করে বললেন:এটা কি?
লোকটি জবাব দিল: 'এটা আল্লাহর রহমত সমূহের মধ্যে অন্যতম রহমত'। তখন ওমর রাঃ বললোঃ "এমন কথা তোমাকে কে বললো? এটি (মেদবহুল পেট) হলো জাহান্নাম সমূহের মধ্যে একটা জাহান্নাম।"
প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খেলে তা স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। খাবার খেতে বসলে অনেকে দুজন এমনকি তিনজনের খাবারও একাই ফেলে। এভাবে খেতে থাকলে তার জন্য বরাদ্দকৃত রিযিক সমূহ দ্রুত ফুরিয়ে যেতে থাকে। রাসূল ﷺ খাবার ভাগ করে খাওয়ার প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেছেন। হাদীসে এসেছে-"একজনের খাবার দু’জনের জন্য যথেষ্ট, দু’জনের খাবার চারজনের জন্য আর চারজনের খাবার আটজনের জন্য যথেষ্ট।" (সুনানে তিরমিজী)
মুসলিমরা খাদ্য ও পানীয়কে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য মনে করে না। তারা শারীরিকভাবে সুস্থ থাকার জন্যেই মূলত আহার করে। যাতে তারা আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করতে সক্ষম হয়। আর এই ইবাদত তাকে পরকালের সম্মান ও সৌভাগ্য অর্জনের জন্য যোগ্য করে তুলে। তাই সে ক্ষুধার্ত না হলে খায় না এবং পিপাসার্ত না হলে পান করে না। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: “আমরা এমন এক জাতি— ক্ষুধা না লাগলে আমরা খাই না; আর যখন আমরা খাই,তখন পেট ভরে খাই না।"
পেটভর্তি খাবার খেয়ে অন্যের সামনে গিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা উচিত নয়। ইসলাম সকল ধরনের দৃষ্টিকটু বিষয়কে এড়িয়ে চলার প্রশিক্ষন দেয়। এক ব্যক্তি মুহাম্মদ ﷺ এর সামনে এসে ঢেঁকুর তুলতে লাগলো।তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, "আমাদের সামনে এসে ঢেঁকুর তোলা তোমার ঠিক হচ্ছে না। তোমার ঢেঁকুর সংযত করো। কেননা, এই জমিনে যারা বেশি বেশি পেটপুরে খায় পরজীবনে (কিয়ামতের দিন) তারা বেশি ক্ষুধার্ত থাকবে।" (সুনানে তিরমিজী)
আল্লাহর রাসূল ﷺ এর সাহাবায়ে কেরামও অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ পছন্দ করতেন না। হযরত আতিয়্যাহ বিন আমির আল-জুহানি থেকে বর্ননা করেছেন, তিনি বলেন-আমি হযরত সালমান (রা.)-এর নিকট শুনেছি, তাঁকে আহার করতে পীড়াপীড়ি করা হলে তিনি বলতেন, আমার জন্য যথেষ্ট যে,আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, দুনিয়াতে যেসব লোক ভূরিভোজ করে, তারাই হবে কিয়ামতের দিন অধিক ক্ষুধার্ত। (ইবনে মাজাহ)
বেশী খাবার খেলে যে সকল রোগ সৃষ্টি হয় তার একটি তালিকা প্রণয়ন করেছেন প্রফেসর রিচার বার্ড।নিম্নে তা দেয়া হলঃ
১। মস্তিষ্কের ব্যাধি। ২। চক্ষু রোগ। ৩। জিহ্বা ও গলার রোগ। ৪। বক্ষ ও ফুসফুসের ব্যাধি। ৫। হৃদ রোগ। ৬। যকৃত ও পিত্তের রোগ। ৭। ডায়াবেটিস। ৮। উচ্চ রক্ত চাপ। ৯। মস্তিষ্কের শিরা ফেটে যাওয়া। ১০। দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা। ১১। অর্ধাঙ্গ রোগ। ১২। মনস্তাত্ত্বিক রোগ। ১৩। দেহের নিম্নাংশ অবশ হয়ে যাওয়া। (“সান” উইকলি সুইডেন)
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন শুধু খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে বছরে ২৩.৬ শতাংশ বা এক কোটি ১৬ লাখ লোকের অকালমৃত্যু ঠেকানো যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে,মানুষের ৮০ শতাংশ রোগব্যাধি খাবারের কারণেই হয়ে থাকে। অপরিমিত খাবারই মানুষকে দিন দিন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ল্যানসেটে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দৈনন্দিন যে খাদ্য তালিকা সেটিই ধূমপানের চেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটায় এবং বিশ্বব্যাপী প্রতি পাঁচটি মৃত্যুর মধ্যে একটির জন্য এই ডায়েট বা খাবারই দায়ী। (বিবিসি)
-মুহাম্মদ মাহদী হাসা
মন্তব্য: ০