Alapon

পাশবিক সত্তা এবং মানবিক সত্তার দ্বন্দ্ব...


বর্তমান পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে করোনা ভাইরাস। ভাইরাসজনিত মহামারী পরবর্তীতে কিছুটা হলেও দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। অনেক চিন্তাবিদ বলছেন, এই মহামারীর ফলে বিশ্ব ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে। পরিবর্তন হলে কারা নয়া সভ্যতার নেতৃত্ব দেবে? তাদের নেতৃত্ব কেমন হবে? আর সভ্যতার পরিবর্তন হতেই হবে কেনো? যদি পরিবর্তন হয় তাহলে বর্তমান সভ্যতার চেয়ে ভবিষ্যত সভ্যতা কিংবা বিশ্বব্যবস্থা কী মানুষের জন্য ভালো হবে নাকি অধিকতর মন্দ হিসেবে দেখা দেবে?

আজকে পৃথিবীর যে রূপ তা তো এর সূচনালগ্নে ছিলো না। ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে অত্যাধুনিক সভ্যতায় পৃথিবী উপনীত হয়েছে। অতীত থেকে আজ অবধি অনেক সভ্যতার উত্থান এবং পতন হয়েছিলো তা প্রমাণিত সত্য। এখন প্রশ্ন হলো, একটি সমবৃদ্ধ সভ্যতার পতন হয় কেনো এবং কীভাবে?

উপর্যুক্ত প্রশ্নসমূহ সামনে রেখে আলোচনা এগিয়ে গেলে বর্তমান পরিস্থিতি বুঝতে সুবিধা হবে বলে আশা করি।

ক্রমান্বয় একটি সভ্যতা বিকশিত হতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে এ বিকাশ পরিপূক্ত অবস্থায় বা চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছলে সভ্যতার অধঃপতন শুরু হয়। অর্থাৎ চরম শিখরে উপনীত হবার মধ্য দিয়ে সভ্যতা লালনকারী জনগোষ্ঠী তাদের বুদ্ধিমত্তা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা তথা যাবতীয় কর্ম প্রেচেষ্টা প্রয়োগের মাধ্যমে নিঃশেষিত হয়ে যায়। এমন অবস্থায় তাদের পক্ষে সভ্যতাটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় থাকে না। তখনই সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। সভ্যতার বহিরঙ্গ ও অভ্যন্তরের শক্তির অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে সার্বিক শ্রীহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেখা দেয় বিভিন্ন ধরনের অন্তঃদেশীয় ও আন্তঃদেশীয় সমস্যা। এবং দুর্বল রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সেগুলো মোকাবিলায় ব্যর্থতা। এরূপ ক্ষয়িষ্ণ পরিস্থিতি কিছু দিন থাকার মধ্য দিয়ে সভ্যতার পতন ঘটে। অবশ্যই প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আবহাওয়া-জলবায়ুতে মারাত্মক পরিবর্তন, নদ-নদীর গতি প্রবাহে পবির্তন, বতিঃ আক্রমণ প্রভৃতি কারণেও সভ্যতার পতন ঘটতে পারে।

বিশ্বসভ্যতার উত্থান-পতনকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি মতবাদ বা তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই তা জানেন।
সমাজ বিজ্ঞানী, ঐতিহাসিক ও দার্শনিকগণ সভ্যতার উত্থান পতন সম্পর্কে পাঁচ ধরনের তত্ত্ব প্রধান করেছেন। এসব তত্ত্বর আলোকে বর্তমান সভ্যতা পতনের হুমকীতে রয়েছে কিনা আমি পরবর্তীতে আলোচনা করবো।

রাষ্ট্রের উত্থান-পতন সম্পর্কিত ইবনে খালদুনের দৃষ্টিভঙ্গি সভ্যতার উত্থান-পতন বিষয়ক ধারণাটি অনুধাবনে সহায়ক। ইবনে খালদুন রাষ্ট্রের উৎপত্তি, বিকাশ, উত্থান-পতন, অবক্ষয় প্রভৃতিকে কালিক ক্রমিকতার সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি রাষ্ট্রের আয়ুস্কাল ১২০ বছর নির্ধারণ করে একে ৪০ বছর ব্যাপি তিনটি পর্বে বিভক্ত করেন। প্রথম পর্বে মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে শাসকের প্রতি অনুগত থাকে। দ্বিতীয় পর্বে সূচিত হয় সভ্যতা। এ পর্বে শিথিল হয় আদিম ঐক্যর প্রেরণা। এবং শাসকের কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্যেরও দেখা যায় ফাটল। তৃতীয় পর্বে এসে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায় আদিম এক্যবোধ। এবং অনিবার্য হয়ে পড়ে রাষ্ট্রের মৃত্যু তথা সভ্যতার পতন।

বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উপনিবেশ থেকে মুক্তি পায়। আর ইবনে খালদুনের তত্ত্ব অনুযায়ী এখন চলছে তাদের আদিম ঐক্যর শিথিলতার পর্ব। এখন সাম্রাজ্যবাদী বৃটেন থেকে শুরু করে বড় বড় রাষ্ট্রগুলোতে ভাঙ্গনের সুর বেজে ওঠছে। এই বিষয়গুলোও পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করবো।

আমরা বর্তমান যে সভ্যতায় বাস করছি এই সভ্যতা হলো মানবিক অনুভতিশূন্য বস্তুবাদী সভ্যতা। আর একে যারা পত্তন করেছে এবং নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা হলো পাশবিক চরিত্রের অধিকারী। নিজেদের পাশবিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এমন কোনো হীন পন্থা নেই যা তারা প্রয়োগ করে না। বিশ্বে বর্তমান অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তিতে বলিয়ান রাষ্ট্রসমূহের পাশবিক কার্যকলাপ সম্পর্কে কিছু মাত্র ধারনা না থাকলে করোনা ভাইরাসের রাজনীতি এবং ফলাফল বুঝা সম্ভব হবে না। আর বর্তমান সভ্যতার অনিবার্য পতনকে কেনো ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয় তাও হৃদয়ঙ্গম করা যাবে না। এর জন্য ধারাবাহিকভাবে বিস্তারিত আলোচনা এবং তথ্য উপাত্তর বিশ্লেষণের প্রয়োজন বোধ করছি। পাঠককেও ক্রমান্বয়ে এগোতে হবে। কী কী বিষয়ে আলোচনা হবে নিচে একটি সূচীপত্র উল্লেখ করছি-

১. বর্তমান বস্তুবাদী সভ্যতার প্রাণহীন দেহ। ২. আধুনিক সভ্যতার পতন হবে কেনো। ৩. সভ্যতার গোড়াপত্তনকারীদের অসভ্যতা। ৪. কুকুরের মতো সভ্যতার পরাশক্তিদের প্রতিযোগিতা। ৫. ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় ওরা এগিয়ে থাকতে চায়। ৬. পশ্চিমাদের সৃষ্ট মানবতাবিরোধী যুদ্ধ। ৭. পশ্চিামাদের মানবতাবিরোধী অপরাধ। ৮. মানুষের প্রতি পশ্চিমাদের ঘৃণা বিদ্বেষ। ৯. মিডিয়া যুদ্ধ। ১০. সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। ১১. বাণিজ্য যুদ্ধ। ১২. সভ্যতার নৈতিক অধঃপতন। ১৩. চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লড়াই: কে দেবে আগামী বিশে^র নেতৃত্ব। ১৪. চৈনিক সভ্যতা। ১৫. চীনের সা¤্রজ্যবাদী নীতি এবং ভবিষ্যত লক্ষ্য। ১৬. পশ্চিমাদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ ১৭. জীবাণু যুদ্ধ। ১৮. করোনা ভাইরাসের যুদ্ধ এবং তা মানবসৃষ্ট নাকি প্রাকৃতিক। ২০. প্রকৃতির প্রতিশোধ নাকি আল্লাহর গজব? ২১. আল্লাহ কখন গজব-আযাব নাযিল করেন? ২২.অতীত সভ্যতার পতনের ভেতরে নিহিত রয়েছে আধুনিক সভ্যতার পতনের সূত্র। ২৩. সভ্যতার উত্থান-পতন সম্পর্কে মনীষীদের তত্ত্ব। ২৪. বতর্মান বিশ্ব জলাবাযু এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা। ২৫. কমিউনিস্ট সভ্যতার পতন হলে পুঁজিবাদী সভ্যতার পতন হবে না কেনো?

উপর্যুক্ত বিষয়ে কারো পরামর্শ থাকলে বলতে পারেন। কিংবা এর কোনোটা বাদ দেয়া দরকার কিনা অথবা অন্য বিষয় যোগ করা যায় কিনা তাও বলতে পারেন। আর আপনি এই লেখাটি ধারাবাহিকভাবে পড়তে আগ্রহী কিনা তাও কমেন্টে এবং আমার ইনবক্সে জানাবেন। যদি শেয়ার করার প্রয়োজন বোধ করেন তাহলে করবেন। এবার আলোচনা শুরু করা যাক-
পৃথিবীর অস্তিত্ব মানুষের দ্বারা। মানুষের গতি যে দিকে বিশ্বের গতিও সে দিকে। মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই জগতের উন্নতি অবনতির ইতিহাস রচিত হয়েছে। এর কল্যাণ অকল্যাণও অল্প-বিস্তুর সবাই ভোগ করে। পৃথিবীর সামগ্রিক প্রকৃতির মধ্যে মানবিক একতা ও সমতা রয়েছে। প্রকৃতি প্রদত্ত আলো বাতাস কোনো বর্ণ গোত্রের মানুষের জন্য সংরক্ষিত নয়। সমস্ত মানুষ তো একটি পরিবারের মতো, তারা পরস্পরে ভাই বোন। মানুষ কেউ কারো শত্রু কিংবা প্রতিপক্ষ না। স্রষ্টার সৃষ্টির চিরন্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সবার ক্রমবিকাশ। পৃথিবীর ভাল মন্দের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে মানুষের মঙ্গল-অমঙ্গল জড়িত। বিশ্বের মধ্যে যতো আরাম আয়েশের উপায়-উপকরণ আছে তাতে সকল মানুষের সম অধিকার রয়েছে। কিন্তু মানুষের মধ্যে একটি গোষ্ঠী যখন বিশ্বের মালিকানা এক চেটিয়াভাবে দাবী করে এবং স্বীয় প্রবৃত্তির অবৈধ স্বার্থ অর্জনের জন্য নিজের গোত্রের লোকজনকে প্ররোচনা দিয়ে দলবদ্ধ হয়ে বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণভাবে অপর দলের উপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তখনই দেখা দেয় মানবতার দ্বন্দ্ব। ফলশ্রুতিতে আরম্ভ হয় পৃথিবীর সংকট। এমন সংকট কেবল পৃথিবীর এক প্রান্তে সীমাবদ্ধ থাকে না, দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য প্রান্তরে। ফলে পক্ষ হয় দুটি, এক মানবশক্তি অপরপক্ষ মানবরূপি হিংস্র পাশবিক অপশক্তি। এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্বের সমস্ত মানুষ কি সংকটের মধ্যে আছে? এই প্রশ্নের উত্তরের প্রারম্ভে মনে রাখতে হবে, মানুষে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কিংবা দেশে জাতিতে কিংবা উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে বসবাস করলেও সবাই মানুষ। আর মানব বসতির এক প্রান্তে কিছু হলে অপর প্রান্তে এর খবর এবং ফলাফল দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এর নেতিবাচক কিংবা ইতিবাচক উভয় দিক দিয়ে মানুষ প্রভাবিত হয়। মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তরে বাস করলেও তারা পরস্পরে সুখ-দুঃখের অংশীদার। সব মানুষ একটি পরিবার, তাদের বাসস্থানও একটি ঘরের মতো। এর এক প্রান্তে ঢেউ ওঠলে অপর প্রান্তে গিয়ে মিশে যায়। একজনের বিপদে অপরজনের মন প্রাণ চেতনে অবচেতনে কেঁদে ওঠে। মানুষ মাত্র মানবিক ঐক্য অনুভূতি বোধ করে। ওই ঐক্য অনুভূতির কারণেই মানুষ পরস্পরে সাহায্য সহযোগিতা করে। এই অনুভূতির অভাব যেখানে পরিলক্ষিত হয় সেখানেই মানবতার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আরম্ভ হয় সংঘাত-সহিংসতা। মানুষের উৎপত্তি এবং আজ অবধি তার ক্রমবিকাশ। এবং সভ্যতার নতুন নতুন সংস্করণ মানুষের পারস্পরিক ঐক্য অনুভূতি এবং সহযোগিতার ভিত্তিতেই হয়েছে। বিশ্ব সভ্যতা কোনো একক জাতি গোষ্ঠী নির্মাণ করেনি। মানুষ যখন একে অপরকে শত্রু জ্ঞান করে তখন নতুন কিছু নির্মাণের পরিবর্তে নিজেদের মধ্যে ধ্বংসক্রীড়া আরম্ভ করে। মানুষের মানবিক অনুভূতিতে পাশবিক চাহিদা যখন আঘাত করে এবং মানব সত্তার ওপর পাশবিক সত্তা বিজয় লাভ করে তখন মানব-দানব এই দুই শ্রেণিতে মানুষ বিভক্ত হয়ে যায়। মানুষ হয়ে যায় একে অপরের প্রতিপক্ষ। একজনকে অপরজন ধ্বংস করার মধ্যেই নিজের কল্যাণ দেখতে পায়। এটাই পৃথিবীর সংকট।

মানুষের জীবন যাত্রা সচল রাখার জন্য পারস্পরিক লেনদেন গুরুত্বপূর্ণ। লেনদেন ছাড়া কোনো দেশের অর্থনীতি সচল থাকতে পারে না। তাই দেখা যায়, কোনো দেশে অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা দিলে এর প্রভাব অন্য দেশে, বিশেষ করে বৃহত্তর শক্তিধর রাষ্ট্রের এমন সংকটের প্রভাব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পড়ে।

বিশ্বের বৃহৎ কোনো রাষ্ট্রে বা সংস্থায় রাজনৈতিক অস্তিরতা দেখা দিলেও অনেক দেশ এর দ্বারা আক্রান্ত হয়। হিটলারের উগ্রজাতিয়তাবাদী মেজাজের ফলে পৃথিবীতে নেমে এসেছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো অভিশাপ এবং ধ্বংস। আবার প্রথমে একটি অঞ্চলে পুঁজিবাদের উৎপত্তি হলেও ক্রমান্বয়ে গোটা পৃথিবীকে গ্রাস করেছে এই ডাকাতি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা।

সংকটের উৎপত্তি:

বর্তমান পৃথিবীতে যে সমস্ত মতবাদ ও এর বাস্তবায়নের ফলে সংকট আরম্ভ হয়েছে, এর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো, পুঁজিবাদ, এর সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে সাম্রাজ্যবাদ, এর সঙ্গে জড়িত আছে অবাধ ভোগবাদ। এই দু’টির সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট পুঁজিবাদ। মানবিক স্বভাব এবং অনুভূতি বিরোধী উগ্রজাতীয়তাবাদ এবং এর সাথে আছে বর্ণবাদ, এ দুটির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে সাম্রজ্যবাদ। এসবের বিকাশ ঘটানো হয়েছে কোথাও সাংস্কৃতি এবং বৃদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে, কোথাও শিক্ষার নামে আবার কোথাও সরাসরি অস্ত্রের মাধ্যমে। পুঁজিবাদ, অবাধ ভোগবাদ, উগ্রজাতিয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এসব উৎপত্তির মূলে রয়েছে কিছু সংখ্যক মানুষের পাশবিক মানসিকতা।

মানবতার দ্বন্দ্বের বিকাশঃ
মানুষের সহযোগিতা ও দ্বন্দ্ব সম্পর্কে পূর্বে কিঞ্চিত আভাস দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর সংকট এবং মানবতার দ্বন্দ্ব সম্পর্কে জানার পূর্বে প্রথমে জানা প্রয়োজন মানুষ কাকে বলে। কারণ, বিশ্বে যা কিছু আছে এবং হচ্ছে সবকিছু একমাত্র মানুষকে কেন্দ্র করেই। প্রথমে অনুধাবন দরকার মানবজাতী এবং জীব জগতের অন্যান্য প্রাণির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এবং সাদৃশ্য কী। মানুষ কোন মানদণ্ডের মাধ্যমে নিজকে প্রাণি জগতের শ্রেষ্ঠ মনে করে। নিজ সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করে। বিশেষ করে নিজের বাহ্যিক অস্তিত্ব ও অধ্যাত্মিক সত্তা এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতি সম্পর্কে তার ভাবনা কী? নিজের উৎপত্তি ও নিষ্পত্তির চূড়ান্ত ফলাফল কী?
এই নিগূঢ় তত্ত্বকথা হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হলে যে কেউ বুঝতে পারবে যে, মানুষ জীব সর্বস্ব অন্যান্য প্রণির মতো কোনো প্রাণি নয়। এবং পূর্ণাঙ্গ মানব কাঠামো কেবল বাহ্যিক অবয়বের নামও নয়। জৈবিক চাহিদা নিবৃত্তি তার শেষ কথা নয়। খাওয়া, পরা, আমোদ প্রমোদের জন্য বিলাস বহুল অট্টালিকা নির্মাণ করা। এবং এসবকে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য বানিয়ে, তা পূর্ণরূপে অর্জন করার জন্য অর্থ-সম্পদের পেছনে জীবনের সময় ব্যয় করাই তার একমাত্র কাজ নয়। এসবের পেছনে সময় ব্যয় করার জন্য তার জীবনের সমস্ত সময় বরাদ্দ নয়। কেবল বেঁচে থাকার জন্য আমৃত্যু খাদ্যের অন্বেষণ করা। এবং যে কোনো উপায়ে তা অর্জন করে উদর পূর্তি করা। যৌনতা চরিতার্থ করার জন্য রাস্তার কুকুর, দলবদ্ধ সঙ্গমকারী শুকুর, কিংবা বন-জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারের মতো যারে সামনে পায় তার ওপরই লাফ দেয়া। এবং এভাবে সারা জীবন পেট-উরুর উপাসনা পূরণ করা কেবল পশুদের কাজ। একই কাজের পেছনে যদি একজন মানুষ স্বীয় জীবনের সময় ব্যয় করে তবে তার এবং পশুর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকে না। আর পশুপ্রবৃত্তি এবং মানব প্রবৃত্তির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নিরূপন না করে পশুবৃত্তির ওপর মানব প্রবৃত্তি বিজয় না হলে নিজেকে মানুষ দাবী করার অধিকার কারো নেই। মনে রাখতে হবে, পশুকে পশু হবার জন্য কোনো বিদ্যালয়ে কিংবা শিক্ষকের কাছে গিয়ে শিক্ষা লাভের প্রয়োজন হয় না, এর বিকাশ ধারাই ক্রমান্বয়ে নিজস্ব স্বভাবের দিকে নিয়ে যায়। কিন্তু মানুষ সম্পূর্ণ এর ব্যতিক্রম। মানব সন্তানকে মানুষ হতে হলে শিক্ষা-সাধনার প্রয়োজন। এটা এমন শিক্ষা যার দ্বারা সে নিজের মানবিক স্বরূপ পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। তখন বুঝতে পারবে তার জ্ঞান, সমস্ত প্রচেষ্টা পশু শাবকের মতো কেবল খাদ্য অন্বেষণের শিক্ষা, যৌনতার জন্য উত্তেজনা, শরীরের সুখ অন্বেষণে করার জন্যই নয়।

জৈবিক চাহিদা পূরণ করার জন মানবিক সত্তার সাথে তার প্রবৃত্তির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সরাসরি সংঘর্ষ রয়েছে। প্রবৃত্তির চাহিদাকে মানব মানদ-ের আলোকে বিচার করে মানবিকতার সাথে যতোটুকুু সামঞ্জস্য ততোটুকু প্রয়োগ করতে হবে। প্রবৃত্তির চাহিদা আসা মাত্র তা পূরণ করার জন্য উত্তেজিত হওয়া এটা ¯্রফে পশুপ্রবৃত্তির আলামত। এখানে মানব জীবনের প্রশ্ন, নিজের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বৈধতার সীমা কতোটুকু। এবং এটা মানব স্বভাবের কতটুকু উপযোগী? তা চরিতার্থ করার ফলে এর প্রতিক্রিয়া কোন দিকে বেশি মোড় নেয়। মানবিক জীবনের দিকে গেলে তা পূর্ণভাবে আত্মস্থ করতে হবে। এবং পাশবিক স্বভাবের দিকে গেলে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেন কোনোক্রমে মানবজীবনের সঙ্গে সংঘর্ষ না বাঁধে।

একটা পশু আরেকটি পশুর সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়। প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে জন্ম হয় আরেকটি পশুর। নির্দিষ্ট একটি সময়ের পর আর মা পশুর সাথে বাচ্চার কোনো সম্পর্ক থাকে না। এর প্রয়োজনও নেই। প্রত্যেকে নিজকে নিয়ে ব্যবস্থ থাকে, নিজের উদর পূর্তির চিন্তায় দিবা রাত্র পার করে। এখানে বিশ্বাস কিংবা মনস্তাত্তিক কোনো বিষয় নেই। এটা পশুর জন্য কোনো দোষণীয় ব্যাপার না। কারণ, তা কেবল পাশবিক স্বার্থ চিন্তা চেতনা থেকেই আসে। পাশবিক জীবনের বিকাশ ও নিরাপত্তার জন্য যতোটুকু ঐক্য এবং সহানুভূতির দরকার তা পূর্ণমাত্রায় আছে প্রণিজগতের মাঝে। মানুষের মাঝেও যদি এরূপ স্বার্থ ও আত্মকেন্দ্রিক ধারণা আসে তাহলে তা বাহ্যিক অবয়ব সম্পন্ন মানুষকেও পশুত্বে রূপান্তর করে। মানুষের তো কিছু স্বার্থ থাকবে, তবে তা হবে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পারস্পরিক সংশ্লিষ্ট। মানুষের মূল স্বার্থকতা নিহিত রয়েছে; সে অপর মানষের কল্যাণ কতোটুকু করেছে এর উপর। যে ব্যাক্তি নিজের মানবিক সত্তাকে পাশবিক সত্তা থেকে পৃথক করতে পেরেছে তার দ্বারা কেবল অপর মানুষের কল্যাণ হয়। মানবিক অবস্থা ব্যতীত মানুষ অপর মানুষের কল্যাণ দূরে থাক কেউ নিজের কল্যাণই নিজে করতে পারে না।

বিশ্বে যা কিছু আছে তা কেবল আমি ভোগ করব, এমন মনোবৃত্তি মানুষকে বিকারগ্রস্ত করে মানবিক শক্তিকে পাশবিক শক্তিতে পরিণত করে। ভোগ এটাতো কেবল শারীরিক। দৈহিক ক্ষুধা পূর্ণ করার মধ্যে প্রকৃত শান্তি নেই। এর দ্বারা সাময়িক একটা সুখ সুখ ভাব আসে কিন্তু স্থায়ী নয়। শরীর বৃত্তিয় সুখের চেয়ে মানুষের বেশি প্রয়োজন মানসিক প্রশান্তির।

এখানে আধ্যাত্মিক কিংবা ইন্দ্রিয়ানুভূতির স্বরূপ উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে প্রশান্তির মাত্রা। প্রশান্তি অনুধাবন করা নির্ভর করে কে কতোটুকু পাশবিক স্তর থেকে মানবিক স্তরে উন্নীত হয়েছে এর ওপর। মানুষের মানসিক প্রশান্তির আরেকটি স্তর পাস্পরিক সম্পর্ক। এই স্তরটা যদি হয় মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির এবং অনুপ্রেরণার আলোকে তাহলে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব নিরসন হয়ে শান্তি আসে। তবে এর জন্য প্রয়োজন হলো পারস্পরিক বিশ্বাস, নির্ভরতা এবং আত্মিক টান। শরীর সর্বস্ব সুখ শান্তির জন্য পশুদের মধ্যেও একটা একতা দেখা দেখা যায়। স্ত্রী পশুর ডাক ওঠলে সে সঙ্গী কামনা করে চিৎকার করে নিজের প্রয়োজন জানান দেয়। ঠিক পুরুষ পশুও নিজের সাময়িক প্রয়োজনে স্ত্রী পশুর সন্ধান করে। তাদের সম্পর্কটা কেবল স্বার্থ নির্ভর, কারণ এটাই পাশবিক জীবনের ধর্ম। তাছাড়া এর বাইরেও নিস্বার্থ একটা দয়া-মায়া, ভালোবাসা প্রাণিদের মধ্যে রয়েছে। যেমন নিজের সন্তানকে একটা পর্যায়ে মা আগলে ধরে সমস্ত প্রতিকূলতা থেকে বাঁচিয়ে রাখে। সেই শাবকটি একাকী চলা ফেরার বয়স হয়ে নিজের মা বাবাকে চিনে না। পাশবিক ধর্ম অনুযায়ী চেনারও দরকার নেই। কিন্তু মানুষের মায়া-মমতা পারস্পরিক ভালোবাসা এতটুকু পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না।

পশুদের মতো কেবল সাময়িক দরকারে একে অপরের কাছে আসা, প্রয়োজন ফুরালে আরা না চেনা, এটা মানবিক স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরিত। এরূপ আত্মস্বার্থপর সমাজে মানবিক সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, সম্পর্কের পূর্বে হিসেব করা হয় লাভ লোকসানের। তাদের সমস্ত সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় স্বার্থকেন্দ্রিক। নিজের মা বাবা, রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় স্বজনের সাথেও স্বার্থ ব্যতীত সম্পর্ক হয় না। ফলশ্রুতিতে সামজিক ঐক্য কাঠামোতে দ্রুত ভাঙ্গন দেখা দেয়, তখন সামষ্টিভাবে অশান্তি আরম্ভ হয়। ক্রমান্বয়ে তারা গোটা বিশ্বটা দেখে স্বার্থের দৃষ্টিতে। তাদের সমস্ত লেনদেন রাজনেতিক, অর্থনৈতিক, সাংকৃতিক সব কিছুর কেন্দ্র বিন্দু হয়ে দাঁড়ায় স্বার্থ, সর্বক্ষেত্রে দৃষ্টি দেয় লালসার।

মানুষ যেমন কোনো জীব সর্বস্ব প্রাণি নয়, তেমনি কোনো যন্ত্র কিংবা কেবল বস্তু পদার্থও নয়। দেহ আত্মার সমন্বয়েই পূর্ণ মানুষ। বাহ্যিক অবয়বে যেমন মানুষের সাথে পশুর পার্থক্য আছে ঠিক তেমনি আধ্যাত্মিক সত্তায়ও পার্থক্য রয়েছে।

যন্ত্রকেন্দ্রিক ধ্যান-ধারণা হলো উৎপাদন কেন্দ্রিক। মানুষ কেবল উৎপাদন এবং ভোগের যন্ত্র নয়। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক শিল্প কিংবা অর্থনৈতিক নির্ভর হতে পারে না। কারণ, এসব হচ্ছে স্বার্থ, আর স্বার্থ দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি করে। মানুষের সম্পর্ক হবে মানবিকতার আলোকে। যেখানে মানবিক মায়া মমতা প্রবল হবে অন্যসব হবে গৌন। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে বাহ্যিক স্বার্থ দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পারে না। মানবিক ধ্যান-ধারণা পূর্ণরূপে উপলব্ধি এবং অন্তর দিয়ে বিশ্বাসই মানুষের মধ্যে মানবিক অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। নিরসন করে পরস্পরে ভ্রাতৃঘাতি দ্বন্দ্ব-সংঘাত।

পশু তার পশু-ইন্দ্রয় দ্বারা যা অনুভব করে, তার বাইরে কিছুই উপলব্ধি করে না। পক্ষান্তরে মানুষ এ কথা বোঝে যে, পশু ইন্দ্রিয় কিংবা পশু ইন্দ্রিয় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির আওতায় যে ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ পরিমন্ডল বিরাজ করে, তার তুলনায় সৃষ্টি জগত অনেক বড় ও বিশাল। এটা আসলে মানুষের চিন্তা ও কল্পনা জগতে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের সূচনা করে। এ দ্বারা সে গোটা সৃষ্টি জগত, নিজ সত্তার এবং এই বিশ্বজগতে ক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর প্রকৃত রহস্য উপলদ্ধি করতে পারে। বিশ্বজগত ও বিশ্বজগতের অন্তরালে বিরাজমান ক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনাকেও সে অনুভব করতে পারে। মানুষের পার্থিব জীবনেও তা সদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। যে ব্যক্তি নিছক নিজের ইন্দ্রিয়ানুভূতির আওতাধীন সীমিত পরিসরে জীবন যাপন করে, তার অবস্থা সেই ব্যক্তির মত হতে পারে না, যে স্বীয় অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম দৃষ্টি দ্বারা পরিদৃষ্ট বৃহত্তর জগতে অবস্থান করে। এবং স্বীয় অন্তরাত্মা দ্বারা গভীরভাবে তার প্রতিধ্বনি ও ইশার ইঙ্গিত অনুধাবন করে। সে বুঝতে পারে যে, তার এই সীমিত জগতের পরিসর সময়ও স্থানের বিচারে তার চেয়ে বেশি প্রশস্ত ও ব্যাপক।

পূর্বেই বলা হয়েছে মানুষের রয়েছে দু’টি দিক। মানবিক এবং পাশবিক সত্তা। একটি দৃশ্যমান অপরটি অদৃশ্যমান। পাশবিক জীবন এবং এর কার্যাবলী দৃশ্যমান। মানবিক জীবনের সারসত্ত্বা অদৃশ্যমান, এরই মধ্যে রয়েছে মূল মানবিক চেতনা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা। এসব মানুষের বাস্তব কাজে প্রকাশিত হয়। সুপ্ত মানবিক গুণাবলি যখন কারো মধ্যে প্রকাশ হয় তখনই তাকে মানুষ বলা যায়। মূলত যারা মানুষের বাহ্যিকতা স্বীকার করে কিন্তু ইন্দ্রিয়ানুভূতি অস্বীকার করে তারাই মানুষকে পাশবিকতার দিকে ঠেলে নিয়ে প্রগতির বদলে দুর্গতির মধ্যে নিক্ষেপ করে।

দৃশ্যমান জৈবিক সত্তাকে অদৃশ্য মানবিক সত্তার আলোকে নিয়ন্ত্রণ করে পাশবিক জীবনের ওপর মানবিক জীবনকে বিজয় করতে হয়। যদি পাশবিক সত্তা মানবিক সত্তার ওপর বিজয় হয়, তাহলে আরম্ভ হয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত। এই সংঘাত কোন একটি পক্ষ ধ্বংস না হওয়া অবধি চলতে থাকে।

পাশবিক ও মানবিক সত্তার দ্বন্দ্ব:

পৃথিবীতে চলমান বিভিন্ন দ্বন্দ্ব সংঘাত, যুদ্ধ-বিগ্রহকে বিভিন্নজন বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। কেউ বলছেন, সভ্যতার দ্বন্দ্ব, কেউ বলছেন, প্রাচ্য-প্রাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব। মূলত আসল দ্বন্দ্ব হলো মানবিক এবং পাশবিক সত্তার দ্বন্দ্ব। সভ্যতা তো মানুষের সৃষ্ট, এটা নিজে নিজে উৎপত্তি হয়নি এবং নিজে সংঘাতে জড়াতে পারে না। মূলত এর অন্তর স্থলে যে মানবতাবিরোধী ভাবাদর্শ রয়েছে এটাই দ্বন্দ্ব তৈরী করে। যেখানে পাশবিক স্বার্থের অবৈধ প্রশ্ন আসে সেখানে সংঘাত সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বে এক পক্ষ মানবিক অপর পক্ষ পাশবিক। মূলত পাশবিকরা মানবিকের কাছে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে এই দ্বন্দ্বের সূচনা করে। মানব যখন পাশবিকে রূপান্তর হয় তখন সে হয় জালেম, লোভী, হিংস্র। তার একমাত্র চিন্তা-ধারা এবং বাস্তব কাজ হয়ে দাঁড়ায় কী করে পেট ভরবে, এই তাগিদে সে তার প্রয়োজন অন্বেষণ করে, আপোসে না পেলে হয় অত্যাচারী। লুণ্ঠন করার জন্য শুরু করে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ। লুণ্ঠিত দ্রব্যে অন্য কেউ ভাগ বসাতে এলে রূপ ধারণ করে হিংসুকের। নিজের সমকক্ষ অন্য কেউ হোক এটা সে কখনো বরদাশ করে না। সবাইকে পদানত করে তাবেদার বানিয়ে নিজে প্রভু হয়ে বসে। তার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, আমি যে ভাবে বলবো সবাই সে ভাবে চলবে। আমার যখন যা প্রয়োজন তা বলা মাত্র দাসরা পূরণ করতে এগিয়ে আসবে। মূলত দাসনুদাস বানানোর প্রতিযোগিতা বনের পশুদের মধ্যেও নেই।

যেভাবে দ্বন্দ্ব সংঘাতের সৃষ্টিঃ

পুঁজিবাদ, অবাধ ভোগের পশুসূলভ স্বভাব, উগ্রজাতিয়তাবাদ, ফলশ্রুেিত উদ্ভুব সাম্রজ্যবাদ। এবং এদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মতবাদের বাস্তবায়ন এবং যখন ক্রমবিকাশ শুরু হয়, তখন থেকে মানবতার মধ্যে বিভাজনের উৎপত্তি। এখান থেকে আরম্ভ হয় সভতার দ্বন্দ্ব, সংকট- সংঘাত। যখন মানবতার অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হয়, তখন সব কিছুর মধ্যে সংঘাত দ্বন্দ্বের সূচনা ঘটে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, এর আগে কোনো দ্বন্দ্ব, সংঘাত ছিল না। কিন্তু আজকের মতো এতো সর্বগ্রাসী ছিল না।

দ্বন্দ্ব সংঘাত উৎপত্তির প্রেক্ষাপট:

পুঁজিবাদ, অবাধ ভোগবাদ, উগ্রজাতিয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, এসবের উৎপত্তির একটা প্রেক্ষাপট রয়েছে, প্রথমে এর আলোচনায় আসা যাক। অন্ধকার পাশ্চাত্য জগতে সভ্যতার নতুন বিন্যাস পরিলক্ষিত হয় রেনাসাঁ আন্দোলনের পর। রেনেসাঁ পদটি দ্বারা পশ্চিমা সভ্যতার ইতিহাসের মোটামুটি ৩০০ বছরের [১৩০০-১৬০০] একটি পর্যায়কে বুঝানো হয়ে থাকে যে সময়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প সাহিত্যে, কলায় এক অভূতপূর্ব নব জাগরণ ইউরোপকে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উন্নীত করে। এই আন্দোলনের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ পরিত্যাগ করা। এবং প্রাচীন গ্রীস ও রোমের অনুসরণ এবং জয়গান করা। প্রগতির সাধারণ অর্থ সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু পাশ্চাত্য সভ্যতা রেনেসাঁর দ্বারা সামনের দিকে এগিয়ে যাবার পরিবর্তে রোম এবং গ্রিসের পুরাতন কুসংস্কারের দিকে ফিরে যায়। যদিও বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার তারা সম্ভব করেছে। পাশাপাশি এটাকে কাজে লাগিয়ে গণবিধ্বংসী এমন ভয়ংকর মারণাস্ত্র তৈরি করেছে যার মাধ্যমে পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করা সম্ভব। এবং নিরিহ মানুষের উপর নির্মমভাবে এর কার্যকরিতা পরীক্ষা করা হয়েছে হাসতে হাসতে আনন্দের সঙ্গে। এটা বিজ্ঞানের দোষ নয়। যাদের দ্বারা এসব অভাবনীয় আবিষ্কার হয়েছিল তাদের মন মস্তিষ্কে মানবিক অনুভতির বদলে পাশবিক চিন্তা চেতনায় আচ্ছন্ন ছিল। ফলশ্রুতিতে আকৃতি মানুষ হওয়া সত্ত্বেও মানব সভ্যতা সমূলে ধ্বংস করার অস্ত্র উদ্ভাবন তারা করেছে।

রেনেসাঁর ফলে ব্যক্তিমানসের আবেগ-অনুভূতি, তার আশা-আকাক্সক্ষা, তার অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি। এবং প্রতিষ্ঠান মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যের স্থলাভিসিক্ত হয়। অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা পারলৌকিকতার পরিবর্তে বাস্তব পৃথিবী ও মানব আত্মার প্রতি নবতর আগ্রহের সৃষ্টি হয়। রেনেসাঁ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে প্রথমে ইতালিতে। ইতালির নগরগুলো ছিল মূলতঃ সামন্ততান্ত্রিক পশ্চাদপদতা মুক্ত। এ কারণে ইতালির প্রায় সকল শহরে এক ধরণের বস্তুবাদী জীবনের স্বাস্থ্যকর বিকাশ ঘটেছিল। এ কারণে এখানে ব্যক্তিত্বের বিকাশ সহজতর হয়েছিল। গির্জা ও সামন্ততন্ত্রের প্রভাবমুক্তি এবং বস্তুবাদী জীবনের বিকাশ ইতালিতে রেনেসাঁ আন্দোলনের সূচনা করেছিল। তবে ইতালিতে রেনাসাঁর উদ্ভব ঘটলেও এর বিস্তার ইউরোপের প্রায় সব দেশেই ঘটেছিল।

নবজাগরণের পর ইউরোপের মাটিতে যে দুষ্ট বীজ বপন করা হয়েছিল, কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই তা এক বিরাট বিষবৃক্ষের রুপ ধারণ করে ফেলে। এবং স্বাভাবিক ফল দিতে শুরু করে, যা বাইরে সুন্দর, কিন্তু ভিতরে তিতা ও বিষে ভরা, যার শাখা-প্রশাখা সবুজ পাতায় ছাওয়া, কিন্তু তা অক্সিজেন নির্গত করে না, বিষাক্ত গ্যাস ছড়ায়। এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানবদেহে রক্তে মিশে যায়। পাশ্চাত্য জাতি, যারা নিজেরাই এ দুষ্ট বৃক্ষ রোপন করেছে, এর বিষাক্ততায় আজ অতিষ্ঠ ও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কেননা, জীবনের সর্বক্ষেত্রে তা অসংখ্য সমস্যা ও সঙ্কট সৃষ্টি করেছে এবং করে চলছে। তারা হয়তো একটি সমস্যার সমাধান করে, কিন্তু সেখান থেকে নতুন নতুন সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

রেনেসাাঁর মাধ্যমে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি বিরূপতা হ্রাস পায়। এবং বুর্জোয়া নিজ নিজ ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। ফলে পুঁজিবাদ বিকাশের পথ সুগম হয়।

পুঁজিবাদের এই জাগরণ সারা পৃথিবীর সবকটি দেশকে প্রভাবিত করে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজ নিজ উপনিবেশে এক প্রকার জোর করে এই অর্থনীতি চালু করেছিল। দীর্ঘদিনের শাসন-পোষণে সেই সব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীতি হয়েছিল যে, পরবর্তীতে তারা স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিক গোলামী এবং পুঁজিবাদ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারেনি।

পুঁজিবাদের উৎপত্তি এবং মানবতার দ্বন্দ্বমানুষ যখন কোনো সংকটের মধ্যে থাকে তখন এর থেকে উত্তরণের জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালায়। আর এই কাজে অগ্রণী ভৃমিকা পালন করে জাতির বুদ্ধিজীবি, চিন্তাবিদ ও মনীষীগণ। তারা তাদের মেধা মনন দিয়ে বিদ্যমান সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য নতুন একটি মতবাদ মানুষের নিকট উপস্থাপন করেন। তাদের ধ্যান-ধারণা যখন সমাজের মানুষের কাছে পেশ করে এবং মানুষ তাতে নিজেদের কল্যাণ দেখতে পায় তখন তাদের মন-মগজ উপর্যুক্ত তথ্য ও তত্ত্বে উজ্জীবিত হয়। এরপর সমাজের কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে কর্মক্ষেত্রে নেমে তা বাস্তবায়ন করার জন্য জীবন উৎর্সগ করতেও দ্বিধা করে না।

প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজিবাদের সূচনার প্রেক্ষাপট যদি আলোচনা করি তাহলে সামান্য হলেও এর পূর্বের অবস্থা একটু পর্যবেক্ষণ করা আবশ্যক। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বুর্জোয়ার উত্থানের ফলে ইউরোপে পুঁজিবাদের সূচনা হয়। মুনাফার সমস্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বুর্জোয়া ইউরোপে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতির পূর্ণ বিকাশ সর্বপ্রথম ইংল্যাণ্ডে সংঘটিত হয়। অতঃপর ইউরোপের অন্যান্য দেশ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাতে পুঁজিবাদ বিস্তৃত হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে প্রায় সমগ্র বিশ্বই পুঁজিবাদের আওতাভুক্ত হয়। ফলশ্রুতিতে সেখানে বিকাশ হয়েছিল পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা, যার সারকথা হলো, চুরি-ডাকাতি, জোর-জবরদস্তি কিংবা যে কোনে প্রকারে অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করা। চলমান বিশ্বে এর প্রমাণ আছে, পরবর্তীতে প্রমাণসহ এর আলোচনা করবো। পশ্চিমারা পুঁজিবাদী মতবাদ শুধু নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি, তারা অর্থনীতিকে এমনভাবে বিন্যাস করেছে যে, অন্যসব রাষ্ট্রকে বাধ্য করেছে এই ব্যবস্থা গিলতে। আর এর বীচ তারা বপন করেছে সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমেও। মূলত পুঁজিবাদ উষা লগ্নেই ডাকাতের ভূমিকা গ্রহণ করে। পশ্চিমাদের যে সমস্ত সাম্রাজ্য কলোনী ছিল, তারা ছিল তাদের উৎপাদনের কাচামালের যোগান দাতা। এবং এগুলোও নিয়েছে এক প্রকার লুঠ তরাজের মাধ্যমে। আজও উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত আছে তৃতীয় বিশ্বের জনশক্তি। আর মুনাফা লুটছে দৃশ্য ও অদৃশ্য মহাজন পুঁজিবাদী উন্নত বিশ্ব। এই ব্যবস্থার দ্বারা যদি অনন্নত দেশ ধনী হতো তাহলে তো ভালই হতো। কিন্তু পশ্চিমা এবং তাদের অন্য মহাদেশীয় দোসরা হলো এর মহাজন বাকী সবাই খাতক। এরা নিজেদের স্বার্থ ব্যতীত কাউকে কানাকড়িও ঋণ কিংবা সহায়তা দেয় না। ফলশ্রতিতে পৃথিবীতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আকাশসম বৈষম্য তৈরী হয়েছে। এবং হাতে গুণা কয়েজন ডাকাতের হাতে মানুষের সম্পদ পুঞ্জবীত হয়ে পড়েছে। এই শোষণের ধারা বিভিন্নমুখী, কোথাও প্রকাশ্যে, কোথাও গোপনে অর্থাৎ পুঁজিবাদ যেখানে যে রূপ ধারণ করার দরকার সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদল করে ভিন্নবেশ ধারণ করে। কী মানব সেবা, কী ঋণ, কী সহায়তা, কী ব্যাংক ঋণ সবখানে চালায় ওরা পাশবিক লুণ্ঠন।।

ডাকাতি পুঁজিবাদী মতবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবাধ ভোগবাদ। এ দু’টি মতবাদ মানবতার প্রাণ সত্তাকে হরণ করে তদস্থলে পাশবিক স্বার্থের অভিশপ্ত কালিমা লেপন করে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে মানুষের জন্ম।

@সালাহ উদ্দিন খান

পঠিত : ৭২৪ বার

মন্তব্য: ০