Alapon

এক বিস্ময়কর উট ও একটি জাতি ধ্বংস হওয়ার গল্প



একটি আরব জাতি তাদের নাম সামুদ। বেশ সমৃদ্ধশালী। কোন কিছুর অভাব নেই। তাদের মধ্য থেকে এক যুবককে আল্লাহ তায়ালা নবুয়্যত দিলেন এবং বললেন তিনি যেন তার জাতির লোকদের তাওহীদের দাওয়াত দেন আর শিরক বর্জন করতে বলেন। ঐ যুবকটির নাম সালেহ।

সালেহ আ. সামুদ জাতির লোকদের কাছে সারাক্ষণ দাওয়াত দিতে থাকেন। তাদের বুঝান। কিন্তু সামুদের লোকেরা মোটেই বুঝতে রাজি না। সালেহ আ. বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা করতে থাকেন। তিনি হাল ছাড়েন না। সামুদের লোকেরা খুব বিরক্ত হয়ে গেল। এ কেমন কথা! একটা লোকরে এতো অপমান করি তারপরও শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর! তারা হযরত সালেহ আ.-এর নিরন্তর দাওয়াতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো।

এরপর সামুদের নেতারা মিটিং ডাকলো কীভাবে এই সালেহর লেকচার বন্ধ করা যায়। তারা সিদ্ধান্ত নিলো সালেহর কাছে এমন একটা বিষয় দাবি করতে হবে, যা পূরণ করতে সে ব্যর্থ হবে এবং এর ফলে তার লেকচারও বন্ধ হয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত অনুসারে তারা এসে সালেহ আ.-এর নিকট দাবি করল যে, তুমি যদি আল্লাহর সত্যিকারের নবী হও, তবে আমাদেরকে নিকটবর্তী ‘কাতেবা’ পাহাড়ের ভিতর থেকে একটি দশ মাসের গর্ভবতী স্বাস্থ্যবতী উট বের করে আনো।

সালেহ আ. দাবি মেনে নিলেন এবং একইসাথে তাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, যদি তোমাদের দাবি পূরণ করা হয়, তবে তোমরা আমার নবুয়্যতের প্রতি ও আমার দাওয়াতের প্রতি ঈমান আনবে। সালেহ আ. সতর্ক করে দেন, মুজেযা প্রদর্শনের পরেও যদি তোমরা ঈমান না আনো, তাহলে আল্লাহর গযবে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে’। এতে সবাই রাজি হলো ও ঈমান আনার অঙ্গীকার করলো। তখন সালেহ আ. নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন। আল্লাহ পাক তার দো‘আ কবুল করলেন এবং বললেন, ‘আমরা তাদের পরীক্ষার জন্য একটি উষ্ট্রী প্রেরণ করব। তুমি তাদের প্রতি লক্ষ্য রাখো এবং ধৈর্য ধারণ করো’। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের গায়ে কম্পন দেখা দিল এবং একটি বিরাট প্রস্তর খন্ড বিস্ফোরিত হয়ে তার ভিতর থেকে সামুদ নেতাদের দাবির অনুরূপ একটি গর্ভবতী তরতাজা উষ্ট্রী বেরিয়ে এলো।

এই বিস্ময়কর ঘটনায় সবাই চমকিত হয়ে গেলো। সামুদ জাতির অনেকেই সালেহ আ. এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনলেন। কিন্তু অল্প কিছু ছাড়া প্রকাশ্যে মুসলিম হওয়ার ঘোষণা অনেকে দিতে পারেন নাই। কারণ প্রধান ধর্মনেতা ও অন্যান্য সমাজ নেতাদের বাধা শুরু হয়ে গেল। কাফিররা উল্টা বলল, ‘আমরা তোমাকে ও তোমার সাথে যারা আছে তাদেরকে অকল্যাণের প্রতীক মনে করি। (নামল ২৭/৪৭)। হযরত সালেহ আ. কওমের নেতাদের এভাবে অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে দেখে এবং পাল্টা তাঁকেই দায়ী করতে দেখে দারুণভাবে শঙ্কিত হলেন। কারণ বেঈমানির কারণে যেকোন সময়ে এরা আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে যাবে। তিনি তাদেরকে সাবধান করে বললেন,‘দেখ, তোমাদের মঙ্গলামঙ্গল আল্লাহর নিকটে রয়েছে। বরং তোমরা এমন জাতি, যাদেরকে পরীক্ষা করা হচ্ছে’।

এই বেঈমানির পরও সালেহ আ. তাদের আরেকটু সুযোগ দিতে চাইলেন। তিনি জাতির প্রভাবশালী লোকদের বললেন, সাবধান! এটি আল্লাহর উষ্ট্রী। তোমাদের জন্য নিদর্শন স্বরূপ। একে আল্লাহর জমিনে স্বাধীনভাবে চরে বেড়াতে দাও। সাবধান! একে অসৎ উদ্দেশ্যে স্পর্শ করো না। তাহলে তোমাদেরকে দ্রুতই যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে’।

আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে উষ্ট্রীর জন্য এবং লোকদের জন্য পানি বণ্টন করে দিয়েছিলেন সালেহ আ.। সামুদ জাতির লোকেরা যে কূপ থেকে পানি পান করতো ও তাদের গবাদি পশুদের ঐ কূপ থেকেই পানি পান করাত। সমস্যা হলো বিস্ময়কর উষ্ট্রী যেদিন পানি পান করতো সেদিন সে একাই কূয়ার সব পানি শেষ করে ফেলত। সালেহ আ. আল্লাহর নির্দেশে ঘোষণা দিলেন যেদিন উষ্ট্রী পানি পান করবে সেদিন কেউ কূপ থেকে পানি নিতে পারবে না। সে মোতাবেক একদিন উট আরেকদিন সামুদবাসী পানি সংগ্রহ করবে। যেদিন সামুদরা পানি পাবে না সেদিন তারা বিস্ময়কর উটের দুধ দিয়ে পানি চাহিদা পূরণ করবে। ঐ উট প্রচুর দুধ দিতো যা দিয়ে সামুদদের পানির চাহিদা পূর্ণ হয়ে যেত। সামুদরা তো খুব খুশি। পানির বদলে তারা দুধ পাবে।

এভাবে অনেকদিন চললো। সামুদের নেতারা দেখলো এই উটের কারণে মুসলমানদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাই তারা উটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করলো। তারা একদিন পানি না পাওয়াকে অসুবিধার কারণ হিসাবে গণ্য করল ও সামুদবাসীকে ক্ষেপিয়ে তুলতে লাগলো। তারা আরো অভিযোগ করলো, উষ্ট্রী যখন ময়দানে চরে বেড়াত, তখন তার বিশাল দেহ দেখে অন্যান্য গবাদি পশু ভয় পেত। ফলে তারা উষ্ট্রীকে মেরে ফেলতে মনস্থ করল। কিন্তু আল্লাহর গযবের ভয়ে কেউ সাহস করল না।

পরে সামুদের জনৈক সুন্দরী ও সম্পদশালী নারী নিজেকে ‘মিসদা’ নামক ব্যক্তির সামনে এবং অপর ধণবতী নারী উনায়যা তার সুন্দরী কন্যাকে ক্বাদার নামক ব্যক্তির সামনে এ কথা বলে পেশ করল যে, তারা যদি উক্ত উটকে মেরে ফেলতে পারে, তাহলে এরা তাদের মালিকানাধীন হয়ে যাবে। তাদেরকে বিবাহ করে আনন্দ উপভোগ করবে। তাদের এই উত্তেজনাকর প্রস্তাবে কিদার ইবনে সালিফ ও মিসদা উদ্ধুদ্ধ হয়ে এর জন্য প্রস্তুতি নিলো। তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, উষ্ট্রীর চলাচল পাথে আত্মগোপন করে বসে থাকবে। উষ্ট্রীটি যখন মাঠের দিকে যাওয়ার জন্য বের হবে, তখন অতর্কিত তার উপর আক্রমণ করবে। এ ব্যাপারে তারা আরো কয়েকজনের সহায়তা কামনা করলো এবং তারা তাতে সম্মত হলো। ক্বাদার সামুদদের মধ্যে একজন প্রভাবশালী লোক ছিলো।

‘অতঃপর তারা তাদের প্রধান নেতাকে ডাকল। অতঃপর সে উষ্ট্রীকে ধরলো ও বধ করলো। এই হত্যার ঘটনায় খুবই কষ্ট পেলেন সালেহ আ.। তিনি তার জাতিকে আল্লাহর নির্দেশ জানিয়ে দিলেন এখন থেকে তিনদিন তোমরা তোমাদের ঘরে আরাম করে নাও। এর পরেই আজাব আসবে এবং এই সময়সীমার কোন ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু এই হতভাগারা এরূপ কঠোর হুঁশিয়ারির কোন গুরুত্ব না দিয়ে বরং তাচ্ছিল্যভরে বলল, সালেহ তুমি যার ভয় দেখাচ্ছ, তা নিয়ে আস দেখি, যদি তুমি সত্যিকারের নবী হয়ে থাকো। তারা বলল, আমরা জানতে চাই, এ শাস্তি কিভাবে আসবে, কোত্থেকে আসবে, এর লক্ষণ কি হবে? সালেহ আ. বললেন, আগামীকাল বৃহষ্পতিবার তোমাদের সকলের মুখমন্ডল হলুদ হয়ে যাবে। পরের দিন শুক্রবার তোমাদের সবার মুখমন্ডল লালবর্ণ ধারণ করবে। অতঃপর শনিবার দিন সবার মুখমন্ডল ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে যাবে। এটাই হবে তোমাদের জীবনের শেষ দিন।

একথা শোনার পর হঠকারী ও বেঈমান জাতি আল্লাহর নিকটে তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনার পরিবর্তে স্বয়ং সালেহ আ.-কেই হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা ভাবল, যদি আযাব এসেই যায়, তবে তার আগে একেই শেষ করে দিই। কেননা এর নবুয়্যতকে অস্বীকার করার কারণেই গযব আসছে। অতএব এই ব্যক্তিই গযবের জন্য মূলত দায়ি। আর যদি গযব না আসে, তাহলে সে মিথ্যার দণ্ড ভোগ করুক। সামুদের নয়জন নেতা এ নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব দেয়।

তারা যুক্তি দিল, আমরা আমাদের কথায় অবশ্যই সত্যবাদী প্রমাণিত হব। কারণ রাত্রির অন্ধকারে কে কাকে মেরেছে, তা আমরা নির্দিষ্টভাবে জানতে পারব না। নেতৃবৃন্দের এ সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ও চক্রান্ত অনুযায়ী নয় নেতা ক্বাদার বিন সালিফ-এর নেতৃত্বে রাতের বেলা সালেহ আ.-কে হত্যা করার জন্য তাঁর বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা পথিমধ্যেই তাদেরকে প্রস্তর বর্ষণে ধ্বংস করে দিলেন।

যাই হোক নির্ধারিত দিনে গযব নাযিল হওয়ার প্রাক্কালেই আল্লাহর হুকুমে হযরত সালেহ আ. স্বীয় ঈমানদার সাথীগণকে নিয়ে এলাকা ত্যাগ করেন। যাওয়ার সময় তিনি স্বীয় কওমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আমার জাতি! আমি তোমাদের কাছে স্বীয় পালনকর্তার বার্তা পৌঁছে দিয়েছি এবং সর্বদা তোমাদের কল্যাণ কামনা করেছি। কিন্তু তোমরা তোমাদের কল্যাণকামীদের ভালবাসো না’।

হযরত সালেহ আ.-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ভোরে অবিশ্বাসী কওমের সকলের মুখমন্ডল গভীর হলুদ বর্ণ ধারণ করল। কিন্তু তারা ঈমান আনল না বা তওবা করল না। বরং উল্টা হযরত সালেহ আ.-এর উপর চটে গেল ও তাঁকে হত্যা করার জন্য খুঁজতে লাগল। দ্বিতীয় দিন সবার মুখমন্ডল লাল বর্ণ ও তৃতীয় দিন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ হয়ে গেল। তখন সবই নিরাশ হয়ে গযবের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। চতুর্থ দিন রবিবার সকালে সবাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সুগন্ধি মেখে অপেক্ষা করতে থাকে। এমতাবস্থায় ভীষণ ভূমিকম্প শুরু হলো এবং উপর থেকে বিকট ও ভয়াবহ এক গর্জন শোনা গেল। ফলে সবাই যার যার স্থানে একযোগে উপুড় হয়ে মরে রইলো এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হ’ল এমনভাবে, যেন তারা কোনদিন সেখানে ছিল না’। আল্লাহ বলেন আমরা তাদের প্রতি একটিমাত্র শব্দ পাঠিয়েছিলাম। তাতেই তারা শুষ্ক খড়কুটোর মত হয়ে গেল।

সামুদ জাতির উপরে আপতিত গযব থেকে ‘আবু রেগাল’ নামক জনৈক অবিশ্বাসী নেতা ঐ সময় মক্কায় থাকার কারণে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু হারাম শরীফ থেকে বেরোবার সাথে সাথে সেও গযবে পতিত হয়। রাসূল সা. সাহাবাদেরকে মক্কার বাইরে আবু রেগালের উক্ত কবরের চিহ্ন দেখান এবং বলেন যে, তার সাথে একটা স্বর্ণের ছড়িও দাফন হয়ে গিয়েছিল। তখন কবর খনন করে তারা ছড়িটি উদ্ধার করেন। তায়েফের প্রসিদ্ধ সাকীফ গোত্র উক্ত আবু রেগালের বংশধর। শুধু তাই নয় রাসূল সা. বলেন সাকীফ গোত্র থেকে একজন মিথ্যেবাদী ও একজন রক্ত পিপাসু বের হবে। মিথ্যাবাদী লোকটি হলো মিথ্যা নবী দাবীদার মুখতার সাকাফী আর রক্তপিপাসু লোকটি হলো উমাইয়া সেনাপতি হাজ্জাজ বিন ইউসুফ।

সামুদ জাতির কথা কুরআনে বিশটিরও বেশি সূরায় আল্লাহ তায়াল বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে আল আরাফ, হুদ, আল হিজর, আন নমল, আল মুরসালাত, আন-নাজম, আল কামার, আল হাক্কাহ, আশ-শাম্‌স ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই কাহিনী বিশ্ববাসী কুরআন দিয়ে জানেনি। আগে থেকেই জানতো। কুরআন নাজিলের পূর্বে এদের কাহিনী সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। জাহেলী যুগের কবিতা, ও খুতবা সাহিত্যে এর ব্যাপক উল্লেখ পাওয়া যায়। আসিরিয়ার শিলালিপি, গ্রীস, ইসকানদারীয়া ও রোমের প্রাচীন ঐতিহাসিক ও ভুগোলবিগণও এর উল্লেখ করেছেন।

উত্তর পশ্চিম আরবের যে এলাকটি আজো 'আল হিজর' নামে খ্যাত সেখানেই ছিল এদের সামুদ জাতির বসবাস। আজকের সউদী আরবের অন্তর্গত মদীনা ও তাবুকের মাঝখানে হিজায রেলওয়ের একটি ষ্টেশন রয়েছে, তার নাম মাদায়েনে সালেহ। এটিই ছিল সামুদ জাতির কেন্দ্রীয় স্থান। প্রাচীনকালে এর নাম ছিল হিজর। সামুদ জাতির লোকেরা পাহাড় কেটে যেসব বড় বড় ঘরবাড়ি নির্মাণ করেছিল এখনো বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সেগুলো অবস্থান করছে। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশ অনুযায়ী কেউ এখানে অবস্থান করে না। তবে এটা দর্শনীয় স্থান হিসেবে খোলা রয়েছে।

মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বিশ্বাসীদের মধ্যে এবং আত্মসমর্পনকারীদের মধ্যে শামিল করুন। আমরা যাতে সামুদদের মতো পথভ্রষ্ট না হই। আমরা যাতে আমাদের নবী সা.-এর সব নির্দেশনা সঠিকভাবে মান্য করি আল্লাহ আমাদের সে তাওফিক দান করুন।

* সামুদদের একটি বিশাল স্থাপনার ছবি দেওয়া হলো। এথেকে অনুমান করা যায় বহু পূর্বের জাতি হলেও তারা শিল্পে ও সভ্যতায় সমৃদ্ধ ছিলো।

পঠিত : ১২৪৬ বার

মন্তব্য: ০