Alapon

অটোমান সাম্রাজ্য পতনের কারণ এবং অজানা ইতিহাস...


উসমানীয় সুলতান তৃতীয় সেলিম(শাসনকাল:১৭৮৯-১৮০৭ খ্রিস্টাব্দ) উসমানীয় খিলাফতকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইলেন। কেননা, ততদিন ইউরোপের তথাকথিত রেনেসাঁ যুগ তথা শিল্পবিপ্লব শুরু হয়ে গেছে ও উসমানীয় খিলাফত তার ৫০০ বছর অতিক্রান্ত করে তার আলোকচ্ছটায় স্তিমিত হতে শুরু করেছিল।আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশে ইউরোপের সামরিক শক্তির সাথে তাল মিলিয়ে উসমানীয় সামরিক শক্তিগুলোও সুদৃঢ়ভাবে শক্তিশালী করার প্রয়োজন পড়ে ইসলামী খিলাফতের স্বার্থে।

সুলতান সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করতে প্রতিটি সৈন্যকে ব্যয়নেটযুক্ত রাইফেল বিতরণ করলেন।

উলামায়ে কেরাম আওয়াজ তুললেন, "এটা তো কাফেরদের হাতিয়ার। এজন্য এটা ব্যবহার করা হারাম।"

সুলতান সিপাহীদের জন্য নতুন ডিজাইনের সামরিক পোশাকের ব্যবস্থা করলেন। উলামায়ে কেরাম আওয়াজ তুললেন, "এটা তো তাশরীহ বিন নাসারা হয়ে গেছে। আর কাফের সম্প্রদায়ের সাথে সদৃশ্য বজায় রাখা শরীয়াহতে নিষেধ।"

সুলতান সেলিমের এসব কার্যক্রমকে বেদ্বীনি আখ্যা দেওয়া হল। সাধারণ মানুষকে একথা বলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হল, "এই সুলতান মুসলমানদের মাঝে কাফেরদের রেওয়াজ চালু করে ইসলামের বিকৃতি ঘটাচ্ছে।"

এমনকি শাইখুল ইসলাম আতাউল্লাহ আফেন্দী ফতোয়া জারি করলেন, "সুলতান সেলিম কুরআনের খেলাফ কাজ করছেন। আর যে বাদশাহ কুরআনের খেলাফ কাজ করে, সে বাদশাহ থাকার যোগ্যতা রাখে না।"

সে সময় তুরস্কের সাধারণ মানুষদের উপর আলেমদের অতুলনীয় প্রভাব ছিল। তাদের কথায় পুরো মানুষ খেপে গেল। পুরো দেশ জুড়ে প্রচণ্ড বিদ্রোহের মুখে ১৮০৭ সালে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা হোক এটা তিনি চান নি।

সুলতান সেলিমের পর ১৮২৬ সালে সুলতান মাহমুদ দ্বিতীয়বার চেষ্টা করেন, তুর্কি সেনাবাহিনীকে ঢেলে সাজাতে। কিন্তু তুর্কি আলেমরা এটাকে বিদআত বলে ঘোষণা দিলেন। তারা বললেন, "এই সুলতান বেদ্বীন হয়ে গেছে। তোমরা ফৌজে ভর্তি হয়ো না।"

তুর্কি শায়খগণ নতুন পৃথিবীর দ্বারপ্রান্তে বসেও সেখানকার বিপুল পরিবর্তনের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। ইখলাস ও তাকওয়ার কারণে তারা চাচ্ছিলেন তুরস্ককে সেই সোনালী যুগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে। তাদের এই ইখলাস কতটা তাকওয়া প্রসূত আর কতটা যুগ সম্পর্কে বেখবর ও এইসব কারণগুলোর সুদূরপ্রসারী ফলাফলে হিসেবে উসমানীয় খিলাফতের সামরিক শক্তি কিভাবে আমেরিকা, রাশিয়ান সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটিশ, ফ্রান্স, জার্মানীদের চাইতে পিছিয়ে পড়ল ও একসময় পৃথিবীর বুক থেকে মুছে গেল,যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সামরিক শক্তির পরাজয়ের ইতিহাসেই বিচার করবে।

ধর্মীয় মহলের এইরূপ কঠোর অবস্থান দেখে তুরস্কের নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই চিন্তা বদ্ধমূল হয়ে গেল, "ইসলাম জাগতিক উন্নতির জন্য প্রতিবন্ধক। ইসলামের মধ্যে নতুন যুগের সাথে চলার যোগ্যতা নেই।

১৯০৮ সালে এই তরুণ তুর্কিদের একটা দলের হাতে সুলতান আব্দুল হামিদ খান ক্ষমতা হারান। এদের হাত ধরেই কামাল পাশা ক্ষমতায় আসতে সক্ষম হয়। তুরস্কের এই পতনের জন্য যে উলামায়ে কেরামের অনঢ় অন্যদৃষ্টিভঙ্গিকেই দায়ী তা নয় তারচেয়ে বহুলাংশে শেষের দিকে খলিফাদের ভোগবিলাস আর ১৮৩৭-১৮৭৬ সাল পর্যন্ত তুরস্কের তানজিমাতের জাতীয়তাবাদও দায়ী যার সময় তুরস্কে কামাল আতার্তুকের মত নাস্তিক ও ইহুদীরা মাথা চড়া দিয়ে উঠে ও যেই সময়ে দুই-তিনজন নামেমাত্র উসমানীয় খলিফা ইউরোপ থেকে শিক্ষা নিয়ে এসে তুর্কি জাতিয়তাবাদকে প্রশ্রয় দিয়ে এর মধ্যে ১৮৫৮ সালে সমকামিতাকে বৈধতা দিয়ে প্রথমবারের মতো আল্লাহর কুরআনের আইনকে লঙ্ঘন করে । অবশ্য তার পর আরও দায়ী স্যালোনিকার ইহুদীদের ফ্রি মেসনের গোপন কার্যক্রম ও উসমানীয় খিলাফতের মধ্যে তাদের শিকড় গেড়ে বসা যারা সুলতান দ্বিতীয় বায়োজিদ কর্তৃক স্পেনে খ্রিস্টানদের ইনকুইজিশনের থাবা থেকে উদ্ধার হয়েছিল ও ইহুদী বংশোদ্ভূত কামাল আতার্তুকের উত্থান তারই ফলস্বরুপ আসে ইসলামী খিলাফতের বুকে ছুরির ফলার মত। আরও দায়ী আরব জাতীয়তাবাদ যারা ব্রিটেনের সাথে হাত মিলিয়ে খ্রিস্টান লরেন্সের মিষ্টি কথায় অতিভূত হয়ে ইসলামের একমাত্র ঢালস্বরূপ উসমানীয় খিলাফাতের বুকে একের পর এক ছোবল মারতে থাকে ও ওহাবী মতবাদকে রাজনৈতিক রূপ দিয়ে আরবদেরকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির হয়ে খিলাফতের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে কাফেরদের কথামত খেলনার পুতুল হয়।এখন তাদের হাতবদল ব্রিটিশদের থেকে আমেরিকাতে হয়েছে। প্রেক্ষাপট ঠিকই যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা হয় ইহুদীদের বন্ধু যখন আলসৌদেরা তাদের বন্ধু হয়েছিল ঠিক তদ্রুপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা হয় ইহুদীদের বন্ধু যখন আল সৌদ হাতবদল করেছিল।

উসমানীয় সাম্রাজ্যে ছিল জগদ্বিখ্যাত নৌবহর। এর ভয়ে সমগ্র ইউরোপে ক্রুশেডার শক্তিগুলো থরথর করে কাঁপত। কিন্তু যুগ বদলের সাথে সাথে অবস্থারও বদল হয়। ইউরোপ বাষ্প-শক্তিকে কাজে লাগানো শিখে গেল ও এর হাত ধরে বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কার করে বসলো। তুর্কি নৌবহর বাষ্পীয় ইঞ্জিনের কাছে মার খেতে শুরু করল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, নতুন পদ্ধতির এই বাষ্পীয় ইঞ্জিন সংগ্রহ করে নিজেদের বহরে যোগ করাটা উসমানীয়দের কাছে বিপজ্জনক কাজ হিসেবে বিবেচিত হতে লাগল। সুলতান আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় (১৯৭৬-১৯০৮)যাকে শেষদিকের সেরা উসমানীয় সুলতানদের মধ্যে একজন বলা হয়; তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাষ্প ইঞ্জিন সম্বলিত নৌবহর প্রস্তুত করেন (এবং তার সময়েই বিশ্বে সর্বপ্রথম সাবমেরিনের দ্বারা বোম নিক্ষেপ করার আবিস্কার করা হয় যা দেখে ইউরোপের সবাই ভয়ে কাপতে শুরু করে।) প্রথম প্রথম যখন এই বাষ্প ইঞ্জিন নৌবাহিনীর সাথে যোগ করা হলো তখন তুর্কি আলেমগণ এটার বিরোধিতায় লিপ্ত হলেন। শেষে তারা অদ্ভুত এক শর্ত জুড়ে দিলেন, "এই বুখারী (বাষ্পীয়) ইঞ্জিন চালু করতে হলে প্রথমে ইঞ্জিনগুলোর উপর বুখারী শরীফ খতম করতে হবে। এছাড়া নৌযানগুলো সাগরে নামানো নিরাপদ হবে না। "

আলেমদের পীড়াপীড়ি যখন বেড়ে গেল তখন কিছু বেয়াড়া অফিসার বলে উঠল,
" আরে এই ইঞ্জিনগুলো বুখারের(বাষ্প) সাহায্যে চলে, বুখারী (শরীফ) দিয়ে নয়। "
তুর্কি আলেমদের এই দখল দেওয়াটা যদিও অবৈধ ছিল না কিন্তু যুগের চাহিদা বুঝা উচিত ছিল। নতুন যুগের চাহিদা বুঝার মাধ্যমে ইসলামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যারা যায় তাদেরকেই বলা হয় দ্বীনের নকীব। প্রতি শতাব্দীতে এইরকম নকীব আসে কিন্তু ঐসব আলেম তাদেরকে কাফের ফতোয়া দিয়ে একঘরে করে ফেলে। কিন্তু পরে সব শেষ হওয়ার পর বুঝতে পারে যে তার সংস্কার ঠিক ছিলো।

® আহমেদ মুসা উসমানী

পঠিত : ২৮৫৬ বার

মন্তব্য: ০