Alapon

সভ্যতার ইতিহাস এবং কিছু কথা...


আমরা বিশ্বাস করি যে, ইসলাম শুধু তার বিগত সমৃদ্ধিশালী সভ্যতার কাহিনী শুনানোকে যথেষ্ট মনে করে না। ইসলাম সমসাময়িক কালে স্বীয় সভ্যতা বিনির্মাণে কাজ করে। ইসলাম বর্তমান সভ্যতার যা কিছু উৎকৃষ্ট বিষয় আছে, তা গ্রহণ করে। যেমন: বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, উন্নত পরিচালনা ও প্রশাসন ব্যবস্থা। যেমনটি, ইতিপূর্বে ইউরোপীয়রা আমাদের সভ্যতা থেকে গ্রহণ করেছিল। মূলত, প্রকৃতিগত দিক থেকে জ্ঞান হলো বিশ্বজনীন। জ্ঞান ধর্ম,দেশ ও জাতির পার্থক্যের কারণে ভিন্ন হয় না। পক্ষান্তরে, সংস্কৃতি জাতি,ধর্ম, ঐতিহ্য ও জীবন দর্শনের পার্থক্যের কারণে ভিন্ন হয়ে থাকে।

এ ব্যাপারে আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, আমাদের কাঙ্ক্ষিত ইসলামি সভ্যতা উদারতার সাথে অন্যান্য সভ্যতা থেকে জ্ঞান গ্রহণ করে। তবে, এ সভ্যতার মূলনীতির সাথে খাপ খায়না এমন কোনো সংস্কৃতি অন্যদের থেকে গ্রহণ করে না। ইসলাম সব সময় স্বীয় মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তা বজায় রাখে। এ সভ্যতা এমন এক সভ্যতা, যেখানে আসমানের সাথে যমিনের সম্পর্ক সূচিত হয়েছে। এ সভ্যতায় ইলাহী মূল্যবোধের সাথে মানবিক মূল্যবোধের মিলন ঘটেছে। এ সভ্যতায় ইসলামের মৌলিকত্বের সাথে যুগের প্রাণসত্ত্বা স্পষ্টতা পেয়েছে। এ সভ্যতায় ইলম ও ইমান একত্র হয়েছে। এ সভ্যতায় সত্য ও শক্তির মিলবন্ধন রচিত হয়েছে। এ সভ্যতায় বস্তুগত উন্নয়ন ও আখলাকি উৎকর্ষতার ভারসাম্য তৈরী হয়েছে। এ সভ্যতায় আকলের নূর ও ওহির নূর ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ইসলামি সভ্যতায় স্বীয় জীবনব্যবস্থার মূল উপাদানসমূহ ও বৈশিষ্ট্যাবলী স্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে এবং স্বীয় উদ্দেশ্য ও মানহাজ বাস্তব রূপ লাভ করেছে। আর এটি ঘটেছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই। যথা: ব্যক্তি গঠন, পরিবার গঠন, সমাজ বিনির্মাণ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতিকে পথনির্দেশকা প্রদানসহ অন্যান্য।

ইসলামি সভ্যতা বস্তুবাদী ও নাস্তিক্য সমাজতান্ত্রিক সভ্যতা এবং ভোগবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ পুঁজিবাদী সভ্যতা থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও উন্নত সভ্যতা। এ সভ্যতা ডান-বাম অন্য কোনো দিকে ধাবিত হয় না। এ সভ্যতা শুধু ইসলামের দিকেই ধাবিত হয়। এ সভ্যতা শুধু ইসলাম থেকেই তার উপাদান সমূহ গ্রহণ করে। এ সভ্যতা শুধু ইসলামের উপরই নির্ভরশীল। এ সভ্যতার উদ্দেশ্যও ইসলাম আর এর ভিত্তিতেই এটা পরিচালিত হয়। ইসলামের মাঝেই এ সভ্যতার প্রকাশ ও পরিস্ফুটন।

ইসলামি সভ্যতা স্বতন্ত্র উন্নত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, তা অন্যান্য সভ্যতার সাথে পারস্পারিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বাসী। ইসলামি সভ্যতা অন্য সভ্যতার সাথে পারস্পারিক আলোচনা-পরিচিতি ও সকল মানুষের মাঝে ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি করার নীতিতে বিশ্বাসী, তাদের ধর্ম বা বর্ণ যাই হোক না কেন । আল্লাহ তায়ালা বলেন: আমি তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পারো। [সূরা হুজুরাত: ১৩]

তবে, ইসলামি সভ্যতা অন্য সভ্যতার মাঝে বিলীন হয়ে যেতে প্রস্তুত নয়। এ সভ্যতা স্বকীয়তা ও স্বীয় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হারাতে কোনোভাবেই সম্মত নয়। এ কারণেই তা সকল ধরণের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ভিন্ন সভ্যতার দখলদারিত্ব ও বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার বিরোধিতা করে। ইসলামি সভ্যতা সে সকল ধরণের কূট পন্থার বিরোধিতা করে, যার মাধ্যমে বর্তমান আগ্রাসী হানাদাররা মুসলিম বিশ্বে প্রবেশ করতে চায়। এরা ইসলামের মৌলিকত্ব ও স্বকীয়তাকে মুছে দিতে চায়। তারা “গ্লোবাল কালচার” এ স্লোগানের আড়ালে ইসলামি জীবনব্যবস্থার প্রধান স্বকীয়তা “আকিদা” নষ্ট করে দিতে চায়। এটাই মূলত নব্য উপনিবেশবাদ। ইসলামী জীবনবিধানে বিশ্বাসী হিসেবে, আমরা এসবের বিরোধিতা করি।
আমরা নিমোক্ত বিষয়গুলোতে বর্তমান প্রভাবশালী পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরোধিতা করি।

১. পাশ্চাত্য সভ্যতার বস্তুবাদী দর্শন, যা কিনা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য বিষয় ছাড়া অন্য কিছু বিশ্বাস করে না। এ সভ্যতা গায়েব তথা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে না। এ সভ্যতার ধ্বজাধারীদের চিন্তা জগতে আল্লাহর কোনো স্থান নেই। মুহাম্মদ আসাদ বলেছিলেন: “যদি কোনো সভ্যতায় আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের ধারণা অনুপস্থিত থাকে; তাহলে সে সভ্যতার অনুসারীদের জীবনাচারে আল্লাহর সাথে সাক্ষাত, পরকালীন বিচার ও প্রতিদান দিবসের কোনো চিন্তা-ফিকিরই অবশিষ্ট থাকে না।

২. পাশ্চাত্য সভ্যতার স্বেচ্ছাচারী দর্শন, যা শুধু ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য উপভোগের উপর প্রতিষ্ঠিত। এখানে ধর্ম বা আখলাকের কোনো বিবেচনা নেই। এর কারণে, এ সভ্যতা এমন কিছু বিষয়কে বৈধ জ্ঞান করেছে, যা সকল আসমানি ধর্ম হারাম বলে ঘোষণা দিয়েছে। যেমন: যিনা ও সমকামিতা।

৩. পাশ্চাত্য সভ্যতার সুবিধাবাদী দর্শন, যা উন্নত মূল্যবোধ ও অনুকরণীয় আখলাকি আদর্শে বিশ্বাস করে না। পাশ্চাত্য সভ্যতা আখলাকি আদর্শকে আপেক্ষিক মনে করে। এ সভ্যতা আখলাকি আদর্শকে চিরন্তন বা স্থিতিশীল মনে করে না। গতকাল যা উন্নত চরিত্র ছিলো আজ তা নিন্দনীয় চরিত্র হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আবার আজ যা নিন্দনীয় মনে হচ্ছে, কালের পরিক্রমায় আগামীকাল তা উন্নত চরিত্র হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।

৪. পাশ্চাত্য সভ্যতার নিজেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করার প্রবণতা। এ কারণে, এ সভ্যতা জাতি ও বর্ণের ভিত্তিতে মানুষের মাঝে পার্থক্য করে। এ সভ্যতা মনে করে, সাদা চামড়ার লোকেরাই দুনিয়ার কতৃত্বশীল। এ সভ্যতা মনে করে, ইউরোপ যেন শুধু পৃথিবীকে শাসন করার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। পক্ষান্তরে, গোটা দুনিয়ার বাকি জাতিসমূহ যেন শোষিত হওয়ার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে। তাদের এ চিন্তাদর্শনের মূল ভিত্তি হলো জাতি বা বর্ণের ভিত্তিতে মর্যাদা লাভের চিন্তা দর্শন। এ দর্শন কোনো দৃঢ় জ্ঞান বা ধর্মীয় বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত না। অথচ ইসলাম মনে করে সকল মানুষ চিরুনির দাঁতের মতোই সমান। তাদের রব এক আর তাদের পিতাও এক।

৫. সর্বশেষ, পাশ্চাত্য সভ্যতার অহংকারী প্রবণতা। আর এ প্রবণতা পূর্বোক্ত নিজেকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান করার মানসিকতারই অংশবিশেষ বা তার ফলাফল। এ সভ্যতা গোটা দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। গোটা দুনিয়ার সমস্ত কাঁচামাল নিজেদের কল্যাণার্থে ব্যবহার করতে চায়। পাশ্চাত্য সভ্যতা গোটা দুনিয়ার সকল সম্পদ ও মানবতার ভাগ্যের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। স্বীয় জাতির কল্যাণার্থে পাশ্চাত্য বাকি দুনিয়াকে চুষে খেতে চায়। আর এ নীতির উপরই কিন্তু পুরোনো কলোনিজম প্রতিষ্ঠিত ছিলো।

মূল: আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভী

পঠিত : ৫৪০ বার

মন্তব্য: ০