Alapon

মাজহাব মানার প্রয়োজনীয়তা এবং কিছু কথা...


অনেকেই বলেন ইসলামে মাজহাব কেন মানব, আল্লাহ একজন, শেষ নবী একজন তাহলে ইসলামে মাজহাব কেন এতগুলা?

এই বিষয়ে বিজ্ঞজনেরা অনেক আলোচনা করেছেন, তবুও কিছুদিন পরপর ঘুরে ফিরে এই বিতর্কটা নতুন করে কুণ্ডলী পাকায়। মাজহাবের জন্য ইজতিহাদ বা গবেষণা প্রয়োজন। প্রত্যেকটা মাজহাব তৈরি হয়েছে গবেষণার ফলশ্রুতিতে। ব্যক্তির নামে মাজহাবগুলার নাম হলেও মাজহাব বা ধারা কখনো একজন মাত্র ব্যক্তির দ্বারা সৃষ্টি হয় না। ইজতিহাদ মানে হলো অথেনটিক সোর্সের ভিত্তিতে শরীয়তের প্রত্যেকটি বিধানের কারন, উদ্দেশ্যে এবং উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর উপায় গবেষণা করে বের করা।

যেমন বাংলাভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন হলো চর্যাপদ। এটা ভাষাবিজ্ঞানীদের আপাত সর্বসম্মত মতামত। আপাত বললাম এইজন্য যে, যদি চর্যাপদের চেয়েও প্রাচীন কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় আর সেখানে বাংলা ভাষার উপাদান বিদ্যমান থাকে তাহলে সেটাকেই ধরা হবে বাংলাভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন। এই চর্যাপদ বৈদ্ধদের ধর্মীয় গান। ঠিক কত শালের দিকে এই গানগুলা রচিত চর্চিত হতো এই নিয়ে ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় আর ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। শহীদুল্লাহ বলেছেন, সপ্তম শতাব্দী আর সুনীতি কুমার বলেছেন দশম শতাব্দীতে এগুলার অস্তিত্ব ছিল। এই মতবিরোধের কারণে বাংলা ভাষার জন্ম কত শতাব্দী তা নিয়েও মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।

দুইজনের পক্ষেই যথেষ্ট দলীল প্রমাণ আছে। বাংলা ভাষার জন্ম শতাব্দী নিয়ে তাহলে দুইটা মাজহাব পেলাম। একটা সুনীতি কুমারের, আরেকটা শহীদুল্লাহর। পরবর্তীতে কিছু পণ্ডিত রিসার্চ, ইজতিহাদ, গবেষণা ইত্যাদি করে শহীদুল্লাহর মতকেই গ্রহণ করেছেন, যেমন বাংলাদেশের ভাষাবিদদের অধিকাংশ এই মাজহাবেরই অনুসারী। আবার কিছু পণ্ডিত সুনীতি কুমারের মাজহাবের অনুসারী, জর্জ আব্রাহাম গিয়ার্সন এই মাজহাবের। এতো গেলো ভাষার মাজহাব

এইবার একটা ধর্মীয় মাজহাবের উদাহরণ দেই।

হানাফি মাজহাব ছাড়া অন্যান্য মাজহাবে ক্রয়বিক্রয় নষ্ট হওয়ার বিধান দুই ভাগে বিভক্ত।

ক. বাতিল
খ. মাকরুহ

হানাফি মাজহাবে ক্রয়বিক্রয় নষ্ট হওয়ার হুকুম তিন ভাগে বিভক্ত।

ক. বাতিল (মূল চুক্তিতে সমস্যার কারণে হয়)
খ. ফাসিদ (চুক্তিতে শাখাগত সমস্যার কার‍্যনে হয়)
গ. মাকরুহ (চুক্তির বহিরাগত কারণে সরাসরি টেক্সট থাকার কারণে হয়)

ক. এর উদাহরণ হলো, কেউ অন্যের সম্পদ নিজের বলে আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিলে সব মাজহাব অনুযায়ী সেটা হবে বাতিল ক্রয়বিক্রয়।

গ. এর উদাহরণ, জুমার আজানের পর ক্রয়বিক্রয় করা সব মাজহাব অনুযায়ীই মাকরুহ হয়।

থাকল বাকি ফাসিদ ক্রয়বিক্রয়। হানাফি মাজহাবেই কেবল ফাসিদ ক্রয়বিক্রয়ের ধারণাটা আছে। অন্য মাজহাবে নেই। হানাফি মাজহাবের পণ্ডিতগণ ইজতিহাদ ও গবেষণা করে পেয়েছেন যে ক্রয়বিক্রয় চুক্তির মধ্যে শাখাগত সমস্যা হওয়ার কারণেও সমস্যার সৃষ্টি হয়। যেমন ধরুন, ঢাবির যেকোনো একটি হলে কোনো কারণে মোবাইল চালানো নিষিদ্ধ করা হলো, এই নিষেদ্ধের সময়ে সেই হলেরই দুই ছাত্র নিজেদের মধ্যে মোবাইল ক্রয়বিক্রয় করল তাহলে সেটা হবে ফাসিদ ক্রয়বিক্রয়।

এখানে ক্রয়বিক্রয়ের মূল চুক্তিটা হয়ে যাবে, মূল চুক্তি এবং পণ্য শরীয়তের দৃষ্টিতে সমস্যাও নয়, কিন্তু আপাত নিষিদ্ধ জিনিসের ক্রয়বিক্রয় করার জন্য চুক্তির শাখাগত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং এই জন্য গুনাহগার হবে। এটাকে সরাসরি বাতিল বা ক. এর হুকুমে ফেললে শরীয়তের মূল একটা উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় সেটা হলো যা মৌলিকভাবে অবৈধ না তাকে ভিন্ন একটি কারণে অবৈধ করা। অন্যান্য মাজহাবে এই ক্রয়বিক্রয়কেও প্রথমটি অর্থাৎ বাতিল হিসাবে মত দিয়ে থাকে। এবং দুই পক্ষের কাছেই রয়েছে দলীল প্রমাণ। এই ক্ষেত্রে যেকোনো একটা মেনে আমল করলেই হবে। তাতে কোনো সমস্যা নেই।

এইভাবে ইজতিহাদ ও গবেষণার মাধ্যমে ভিন্নমত ও ভিন্ন ধারার সৃষ্টি হয়। জ্ঞান সমৃদ্ধ হওয়ার পথে এটা খুব অপরিহার্য বিষয়। গবেষণার মাধ্যমেই মানবসভ্যতা এতো দূর এসেছে। আর গবেষণা হলেই ভিন্ন মত হবেই। ভিন্নমতকে আমাদের ইতিবাচক ও স্কলাস্টিক আপত্তির মাধ্যমে ডিল করতে হবে। মারামারি, গালিগালাজ দিয়ে নয়।
@Mehrab

পঠিত : ৭২১ বার

মন্তব্য: ০