Alapon

মুসলিম বিদ্বেষ ভোগাচ্ছে ভারতীয়দের



বিদেশে অবস্থানরত কিছু ভারতীয় নাগরিক সম্প্রতি সোশাল মিডিয়ায় তাদের মুসলিম-বিদ্বেষী গোঁড়ামি মনোভাব প্রকাশ করার কারণে চাকরি হারিয়েছে। গত সপ্তাহে কানাডাতে রবি হুদা নামের এক ব্যক্তিকে তার রিয়েল এস্টেট ফার্ম থেকে চাকরিচ্যুত করা হয় এবং অন্টারিওর বোল্টনে স্থানীয় স্কুল কাউন্সিলে তার পদ থেকেও তাকে বাদ দেয়া হয়।

অন্টারিওর ব্রাম্পটনের মেয়র সম্প্রতি মসজিদগুলোকে রমজানের সময় স্পিকারে মাগরিবের আজান দেয়ার অনুমতি দেয়। রবি হুদা নোংরাভাবে এই সিদ্ধান্তের বিরোধী করার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। মেয়রের এই সিদ্ধান্তকে সাধারণভাবে স্বাগত জানানো হয়েছে, কারণ মহামারি-কেন্দ্রিক বিধিনিষেধের কারণে মুসলিমরা মসজিদে যেতে পারছেন না।

এই সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করে মি. হুদা টুইটারে লিখেছেন: “এর পর কি? উট আর ছাগলের সওয়ারিদের জন্য লেন আলাদা করে দেয়া হবে নাকি যাতে কোরবানির নামে পশু জবাই সহজ হয়ে যায়। এর পর কি আইন করে নারীদেরকে তাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাবুতে ঢাকতেও বাধ্য করা হবে?” এই ঘটনার আগে আরও প্রায় ১০ ভারতীয়কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে চলতি মাসে - সংযুক্ত আরব আমীরাত ও কুয়েতে। সোশাল মিডিয়ায় তাদের মুসলিম বিরোধী পোস্টগুলোকে তাদের চাকরি দাতাদের গোচরে আনা হয়।

এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতে আরব আমীরাতে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মি পবন কাপুর ২০ এপ্রিল এক টুইটে আমীরাতে অবস্থানরত প্রবাসী ভারতীয়দেরকে সতর্ক করে দেন যাতে কেউ এই ধরণের আচরণ না করেন। এক দিন আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক টুইটে বলেন, কোভিড-১৯ ‘কোন জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, বিশ্বাস, ভাষা বা সীমান্তকে বিবেচনায় নেয় না”।
তথ্য-যাচাইকারী ওয়েবসাইট আল্ট নিউজের প্রতিষ্ঠাতা মি. প্রতীক সিনহা অবশ্য বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হলেও সেটা ভারতে অনলাইনে ইসলামভীতি ছড়ানো বন্ধ করতে পারেনি। আল্ট নিউজ বেশ কিছু ভিডিও ও ছবিকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে, যেগুলো ব্যবহার করে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে নোংরাভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে করোনাভাইরাস ছড়ানোর অপপ্রচার চালানো হয়েছে।

তিনি দ্য স্ট্রেইট টাইমসকে বলেন, “ভারতের মানুষ সেই একই আচরণ করে যাচ্ছে। কিছু ভারতীয় অনলাইনে যেভাবে ইসলামভীতি ছড়াচ্ছে, সেটা নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা শুরুর প্রেক্ষিতে সরকারও এ ধরণের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে বলে মনে হচ্ছে। ২৮ এপ্রিল সরকার টুইটারকে একশ’র বেশি আপত্তিকর টুইট সরিয়ে নিতে বলে। ভারতীয় নিউজ পোর্টাল দ্য ওয়্যার এই টুইটগুলোর বিশ্লেষণ করে বলেছে যে, এই টুইটগুলোর ৬০ শতাংশকেই ইসলামভীতিমূলক আখ্যা দেয়া যায়। আবার কাছাকাছি পরিমাণ টুইটকে ইসলামপন্থী, হিন্দু-বিরোধী ও বিজেপি-বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করা হয়েছে”।

গত কয়েক সপ্তাহে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), কুয়েত সরকার, সংযুক্ত আরব আমিরাতের এক প্রিন্সেস এবং সেইসাথে বেশ কয়েকজন আরব অ্যাক্টিভিস্ট করোনাভাইরাস বিস্তারের জন্য ভারতীয় মুসলিমদের দায়ী করাকে ভারতীয়দের ইসলামফোবিক বিদ্বেষমূলক প্রচারণা হিসেবে অভিহিত করেছেন। উপসাগরীয় এলাকার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল সংখ্যক টুইট ও বিবৃতি প্রদান করে সামাজিক মাধ্যমের পোস্টের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ (তিনি টুইটারে বলেছেন যে কোভিড-১৯ কোনো বর্ণ বা ধর্মকে দেখে না) ভারত সরকার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে বাধ্য হয়।

মার্চে দিল্লিতে তাবলিগি জামাতের একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজনের মধ্যে করোনাভাইরাস ধরা পড়ার পর ভাইরাসটি বিস্তারে ষড়যন্ত্র করার জন্য ভারতীয় মুসলিমদের অভিযুক্ত করার মধ্য দিয়ে এর শুরু। #CoronaJihad -এর মতো হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড হয়, টেলিভিশন বিতর্কে একে মানববোমা হিসেবে অভিহিত করা হয়। অনেকে তাবলিগকে নিষিদ্ধ করারও আহ্বান জানান। সংগঠনটির নয়া দিল্লি অফিস বন্ধ করে দেয়া হয়।

গত ১৯ এপ্রিল ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ওই দিন পর্যন্ত ১৫ হাজার শনাক্ত লোকের মধ্যে চার হাজারের বেশি তাবলিগি জামাতের লোক। সংগঠনটির প্রধান সাদ কান্ধলভির বিরুদ্ধে ‘নরহত্যার চেষ্টা’ ও অর্থ পাচারের মামলা করা হয়। তাবলিগ ইস্যুর পর উগ্রবাদী হিন্দুরা সামাজিক মাধ্যমে ইসলামফোবিক পোস্টের বন্যা বইয়ে দেয়। এসব পোস্টের অনেকগুলো দেয় উপসাগরীয় দেশগুলোতে বসবাসকারীরা।

দুবাইভিত্তিক ভারতীয় সৌরভ উপাধ্যায় ‘তারাই যে মহামারীটির উৎস তা স্বীকার করে নেয়ার জন্য’ মুসলিমদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি তাবলিগ সদস্যদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন তারা সন্ত্রাসী। তবে উপসাগরীয় ও ভারতের অনেক সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে তিনি তার টুইটগুলো সরিয়ে ফেলেন।

মোদির বিজেপির তরুণ এমপি তেজস্বী সূর্যের একটি পুরনো টুইটও সামনে চলে আসে। এতেও আরো ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সূর্য ২০১৫ সালে এক কানাডিয়ান-পাকিস্তানি লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেন যে গত কয়েক শ’ বছর ধরে আরব নারীরা কখনো অর্গ্যাজমের স্বাদ পায়নি। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. ফারহান মুজাহিদ চক বলেন, হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্টদের অহংকারের মাত্রা বিশ্বজুড়ে লোকজনকে কষ্ট দিচ্ছে, আগের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিচ্ছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজপরিবারের সদস্য প্রিন্সেস হেন্দ আল-কাসিমি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, উপসাগরে প্রকাশ্যে বর্ণবাদী ও বৈষম্যমূলক আচরণকারী ভারতীয়দের জরিমানা করা হবে, দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে। গত মাসে উপসাগরীয় অঞ্চলে কর্মরত অন্তত ছয় হিন্দু সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেয়ার কারণে চাকরি হারিয়েছেন বা অভিযুক্ত হয়েছেন। উপসাগরীয় দেশগুলোতে প্রায় ৮৫ লাখ ভারতীয় বাস ও চাকরি করে, তাদের একটি বড় অংশ হিন্দু।

জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর (বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত) সাথে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুবই ভালো হয়েছে, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। কুয়েতভিত্তিক অ্যাক্টিভিস্ট আবদুর রহমান নাসর টুইটে বলেন, প্রতিবছর উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি ভারতে হস্তান্তরিত হয় এবং বছরে সব মুসলিম দেশ থেকে ১২০ বিলিয়ন ডলার যায় ভারতে। এসব দেশে ভারতীয়দের (প্রধানত হিন্দু) সাথে ভালো আচরণ করা হয়। তিনি বলেন, এর বিনিময়ে তারা ভারতে মুসলিমদের সাথে কেমন আচরণ করছে? কুয়েতের নাগরিক, আইনজীবী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপ মেজবেল আল-শারিকা টুইটে বলেন, তিনি জেনেভাস্থ জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে ভারতীয় মুসলিমদের জন্য বিনা পয়সায় লড়বেন।

আরব বিশ্বে উত্তেজনা বাড়ার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কুয়েত ভারতীয় মুসলিমদের প্রতি আচরণ নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করে এবং হস্তক্ষেপ করার জন্য ওআইসির প্রতি আহ্বান জানায়।
কুয়েত মন্ত্রিসভার সচিবালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে এবং তাদের অধিকার লঙ্ঘন করছে, তারা কি মনে করছে যে বিশ্বের মুসলিমরা এসব অপরাধের বিরুদ্ধে নীরব থাকবে এবং তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে ও আইনগতভাবে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না? এর আগে ১৮ এপ্রিল ওআইসি এক বিবৃতিতে ভারতে ইসলামফোবিয়ার ক্রমবর্ধমান স্রোত বন্ধ করতে জরুরিভিত্তিকে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নয়া দিল্লির প্রতি আহ্বান জানায়।

ভারতে ইসলামফোবিয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার খ্যাতিমান কণ্ঠ প্রিন্সেস আল-কাসেমি গত সপ্তাহে গালফ নিউজে এক কলামে বলেন, বিশ্বের আরেকটি হিটলারের প্রয়োজন নেই, বরং বিশ্বের প্রয়োজন মার্টিন লুথার, নেলসন ম্যান্ডেলা বা গান্ধীর মতো নায়ক। তিনি লিখেন, তোমার ভাইকে হত্যা করা তোমাকে নায়ক বানাবে না, এমন কাজ তোমাকে স্বৈরাচার বানাবে, খুনিতে পরিণত করবে। একটি ছোট ও মৃদু আন্দোলন শুরু হয়েছে, এটি আরববিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হবে। কাতারের দোহা ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড হিউমেনিটেরিয়ান স্টাডিজের পরিচালক সুলতান বারাকাত করোনাভাইরাস মহামারীর জন্য ভারতীয় মুসলিমদের দায়ী করায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে জানান।

তিনি বলেন, আরব বিশ্বে যুগের পর যুগ ধরে লাখ লাখ ভারতীয় বাস করছে। তারা কখনো বৈষম্যের শিকার হয়নি। আবার উপসাগরীয় এলাকায় বাস করে কাজ করছে, এমন লোকের ইসলামফোবিক মন্তব্য আরো বেশি কষ্টদায়ক। অবশ্য বিজেপির মুখপাত্র জিভিএল নরসীমা রাও আলজাজিরাকে বলেন, এই ইস্যু আরব দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। কারণ এটি প্রপাগান্ডার অংশ, আসল নয়। তিনি বলেন, এগুলো হলো বৈরী লোকদের ভারতবিরোধী ও হিন্দুবিরোধী প্রপাগান্ডা।

মঙ্গলবার ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম ধর্মীয় স্বাধীনতার মারাত্মক লঙ্ঘনের জন্য বিশেষ উদ্বেগজনক দেশ হিসেবে ভারতকে চিহ্নিত করার জন্য পররাষ্ট্র দফতরের প্রতি আহ্বান জানায়। ভারত যদিও মার্কিন প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে একে পক্ষপাতপূর্ণ হিসেবে অভিহিত করেছে, কিন্তু তবুও তা ভারতের মুসলিমদের টার্গেট করা নিয়ে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক উদ্বেগ অগ্রাহ্য করা দেশটির হিন্দু জাতীয়তাবাদী সরকারের জন্য কঠিন করে তুলবে।

পঠিত : ৭৮৫ বার

মন্তব্য: ০