Alapon

সুমার মৃত্যু ও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দমবন্ধ পরিস্থিতি



গত কয়েকবছর বাংলাদেশের নিউজগুলোর শীর্ষস্থানে ছিলো স্বাস্থ্যবিভাগের মহাদুর্নীতির খবর, বিশ টাকার গ্লাভস কিনেছে ৫৫০০০ টাকায়। সাড়ে তিন হাজার টাকার পর্দা কিনেছে ৩৭৫০০০০ টাকায়। পাঁচ হাজার টাকার বই ৮৫০০০ টাকায়, বালিশ ৫০০০০ টাকায়। এরকম বহু খবরে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। এগুলো তো সে বিষয় যেগুলোর দাম সাধারণ মানুষ জানে। আর যেসব মেডিকেল ইকুইপমেন্টের দাম সাধারনণরা জানে না সেখানে সমুদ্রচুরি করেছে স্বাস্থ্যখাতের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী পর্যন্ত।

আজ প্রথম আলোতে একটি শিশুর করুণ মৃত্যুর কথা ছাপা হয়েছে। শিশুটির নাম সুমা। বয়স ১ মাস ২৮ দিন। কেরানীগঞ্জে গাড়িচালক বাবার ঘরে যমজ বোন সুমাইয়ার সঙ্গে তার জন্ম। কিন্তু জন্মের পরই তার ‘হার্টের সমস্যা’ দেখা দেয়। তার শ্বাস নেওয়ার কষ্ট বাড়লে তাকে শিশু হাসপাতালে আনা হয়। বড় চাচা আতাউলও গাড়িচালক। তিনি নিজেই একটি পিকআপে সুমাকে নিয়ে আসেন। তাঁর কথায়, তিন-চার রকম টেস্ট করান তাঁরা। সব মিলিয়ে আট হাজার টাকার মতো খরচ হয়। তবে হাসপাতাল স্টাফরা পরামর্শ দেন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কারণ, তাকে আইসিইউতে রাখতে হবে। শিশু হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি নেই। তাই তারা একটি অ্যাম্বুলেন্সে শিশু হাসপাতাল ছাড়েন। এভাবে এক হসলিটাল থেকে অন্য হসপিটালে ঘুরাঘুরি করতে করতে চিকিৎসা না পেয়ে অবশেষে ঢাকা মেডিকেলে শিশুটি মারা যায়।

এই মৃত্যুটির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ি চিকিৎসা ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বহীনতা, অবহেলা ইত্যাদি। করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে দেখা গিয়েছে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের নগ্ন চেহারা। হাসপাতাল, হাসপাতালের বেড এবং ভেন্টিলেটর নিয়ে উদ্বেগের সঙ্গে আরেক উপসর্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে অক্সিজেন সরবরাহে ঘাটতি। নীরবে-নিভৃতে পরিস্থিতি এমন মাত্রায় পৌঁছেছে যে, ২৯ টাকার অক্সিজেন এখন ২৬ হাজার টাকায়ও পাওয়া যাচ্ছে না। অক্সিজেন উৎপাদনকারী ও বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

এরকম একটি প্রতিষ্ঠান লিন্ডে বাংলাদেশ। বাণিজ্যিকভাবে অক্সিজেন উৎপাদন ও বিক্রয়কারী এই প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১০০ টন। সরবরাহ করছে স্টিল, ফুড, প্যাকেজিং, বেভারেজ এবং স্বাস্থ্য খাতে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অক্সিজেন সরবরাহে লিন্ডে বাংলাদেশের দুটি নিয়মের একটি ‘রেন্টাল সিস্টেম’। এর আওতায় মাত্র ২৯ টাকার ভাড়ার বিনিময়ে সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়। জামানত হিসেবে ফেরতযোগ্য ২৬ হাজার টাকা নেয়া হয় এবং সিলিন্ডারটির প্রতিবার রিফিলে নেয়া হয় ১০০টাকা। তবে করোনার প্রাদুর্ভাবে অক্সিজেনের বাড়তি চাহিদার মুখে প্রায় বন্ধ এখন ওই রেন্টাল সার্ভিস। নেহাৎ জরুরি বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে দেয়ার সুযোগ রয়েছে তাও দিনে একটির বেশি নয়।

সিলিন্ডার সেট বিক্রিতেও হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। দ্বিতীয় এই নিয়মটির আওতায় ২৬,৮১৫ টাকায় ফুল সেট সিলিন্ডার কেনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সিলিন্ডার ঘাটতি থাকায় এই সুযোগটিও বন্ধ রয়েছে বলে জানান সূত্রটি। তিনি বলেন, ১.৫ কিউবিক মিটার অক্সিজেন ধারন ক্ষমতার প্রতিটি সিলিন্ডার স্বাভাবিক একজন রোগির ক্ষেত্রে ১১ ঘন্টা চললেও অবস্থা বেশি খারাপ রোগির ক্ষেত্রে সেটা ৬/৭ ঘন্টায়ই শেষ হয়ে যায়। ১০০ টাকায় রিফিল করা যায় কিন্তু করোনাকালে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় হাঠাৎ সিলিন্ডারের সংকট দেখা দিয়েছে।

সাবেক বাংলাদেশ অক্সিজেন লিমিটেড থেকে জার্মান সংস্থার সহযোগে লিন্ডে বাংলাদেশে রূপ নেয়া এই সংস্থার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে-তাদের মোট সিলিন্ডারের সংখ্যা ১৫ হাজার। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বলেন, সংখ্যা আরও বেশি কিন্তু চাহিদা তার চেয়েও বেশি। ১৫ জুনের আগে ফুল সেট সিলিন্ডার বিক্রির কোন সুযোগ নেই।

এ সংকট ব্যক্তিগত পর্যায়ে। এর বাইরে রয়েছে হাসপাতালের চাহিদা। ঢাকাতে করোনা চিকিৎসার জন্য ৯টি হাসপাতাল রাখা হয়েছে। সেখানে রয়েছে ভেন্টিলেটরের রোগির জন্য অক্সিজেনের চাহিদা। লিন্ডে বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা বলেন, অক্সিজেন উৎপাদনে কোন ঘাটতি নেই। প্রশ্ন এখন অবকাঠামোর। সেই অবকাঠামো পর্যাপ্ত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা সরকার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিষয়।

এদিকে শুধু শিল্পে ব্যবহারের জন্য দিনে ২৬০ টন অক্সিজেন উৎপাদন করছে আবুল খায়ের স্টিল মিল। যার পুরোটাই স্টিল উৎপাদনে ব্যবহার হয় কিন্তু করোনাকালে অক্সিজেনের বাড়তি চাহিদা পুরনে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে প্রতিষ্ঠানটি। অক্সিজেন সরবরাহে ইতোমধ্যে একটি হেল্পলাইন খুলেছে। গত ১২ মে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে ১০টি অক্সিজেন ভর্তি সিলিন্ডার হস্তান্তর করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ১৩ ও ১৪ মে ১ দশমিক ৪ কিউবিক মিটারের ১০টি করে আরও ২০টি সিলিন্ডার সরবরাহ করেছে যার সবগুলোই চট্টগ্রাম এলাকায়। এসব তথ্য জানিয়ে আবুল খায়ের স্টিল মিলের এক কর্মকর্তা বলেন, এই মূহুর্তে ঢাকা কিংবা দেশের অন্যান্য জেলায় সিলিন্ডার সরবরাহের অগ্রগতি জানা নেই। তবে সিদ্ধান্ত রয়েছে দেশের সরকারি সব হাসপাতাল যেখানে করোনার চিকিৎসা হচ্ছে সেখানে অক্সিজেন সরবরাহের। জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি প্রাথমিকভাবে ২০০টি সিলিন্ডার সরবরাহ করবে। এছাড়া হাসপাতালের সকল খালি সিলিন্ডার অক্সিজেন ভর্তি করে দেবে।

করোনাকালে অক্সিজেনের এই ঘাটতিকে দেশের স্বাস্থ্য খাতের ‘চরম দুর্বলতা’ বলে উল্লেখ করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, শুরুর দিকে সবাই যখন ‘ভেন্টিলেটর’ নাই বলে চিৎকার করছিল তখন আমি বলেছিলাম-তোমাদের অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক আছে কিনা সেটা দেখ! হাসপাতালগুলোতে যেখানে অবকাঠামোগত দুর্বলতা সীমাহীন সেখানে অক্সিজেনের সরবরাহে ঘাটতি থাকারই কথা।

স্বাস্থ্য আন্দোলনের এই পুরোধা ব্যক্তি আরও বলেন, করোনায় আক্রান্ত নির্দিষ্ট সংখ্যক রোগীর ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হয়। কিন্তু এর বাইরে গড় সংখ্যক রোগি যারা নরমাল বেডে থাকেন তাদেরও অক্সিজেনের দরকার হয়। কারণ তারাও ভয়ে হাঁপাতে থাকেন। কিন্তু অক্সিজেনের সরবরাহেই যেখানে ঘাটতি সেখানে ঝুঁকির মাত্রাতো আরও বেশি।

আর একে প্রস্তুতিহীনতার প্রমাণ বলে উল্লেখ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নাসির উদ্দীন। তিনি বলেন, ডিসেম্বরেই আমরা যেনে গেছি এ ধরনের একটি মহামারী আসছে। আমাদের মহামারীবিদরাও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ সেই নেতৃত্বটা নিতে পারেনি। বিদেশ থেকে যারা এসেছেন তাদেরকে আমরা অবাধে ছেড়ে দিয়েছি, ফ্রন্টলাইন প্রফেশনালস যারা আছেন তাদের প্রশিক্ষণ দিতে পারিনি, তাদের সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারিনি, এরপরে রয়েছে অবকাঠামোগত দুর্বলতা। অক্সিজেন ঘাটতি সেটারই প্রমাণ। অথচ, হাসপাতালে হাপাতালে বড় বড় ট্যাঙ্ক লাগিয়ে ফেলা যেত, ছোট সিলিন্ডার আমদানি করা যেত। এর মাসুল আমাদের দিতে হবে।

পঠিত : ৫১৮ বার

মন্তব্য: ০