Alapon

ইসলামের দৃষ্টিতে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব...


ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী জ্ঞান অর্জন ফরয (অবশ্য কর্তব্য)। এ ব্যাপারে একটা হাদীস শিক্ষিত মুসলিম মাত্রই জানেন-১১ঙ

"প্রত্যেক মুসলিম নরনারীর জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরয" -- হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)।

মধ্যযুগের একজন নামকরা ইসলামী পণ্ডিত ছিলেন আল-যারনুজি। মূল নাম তাজুদ্দিন নুমান ইবনে ইব্রাহিম ইবনে আল-খলিল আল-যারনুজি। তাঁর বিশেষ উপাধি ছিল বোরহান আল-দ্বীন এবং বোরহান আল-ইসলাম। আরবী বোরহান শব্দের অর্থ প্রমাণ বা ইংরেজীতে এভিডেন্স। তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা এবং পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁকে এই বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয় (দ্বীনের প্রমাণ বা ইসলামের প্রমাণ)। মূলত এই নামেই তিনি অধিক পরিচিতঃ বোরহান আল-দ্বীন আল-যারনুজি। মধ্য এশিয়ার বর্তমান তার্কিস্তানের অন্তর্ভুক্ত যারনুজ অঞ্চলে তাঁর জন্ম। দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর এই পণ্ডিতের ইন্তেকালের বছর কেউ বলেছেন ১২৪৩ খ্রীঃ, আবার কেউ বলেছেন ১২২৩। তিনি ছিলেন হানাফি মাযহাবের আলিম।

তো, কেন তাঁকে নিয়ে লিখছি? লিখছি এই কারণে যে, তিনি একটি ছোট্ট পুস্তক লিখেছিলেন ইসলামের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী জ্ঞান অর্জন বিষয়ে। জ্ঞান সম্পর্কিত তত্ত্বসমূহ শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে থিওরী অব নলেজ বা এপিস্টেমোলজি নিয়ে তাঁর বইখানা, যার শিরোনাম "তালিম আল-মুতায়াল্লিমঃ তারিক আত-তায়াল্লুম", অনেকের কাছে মূল্যবান গণ্য হতে পারে। আরবীতে লেখা বইখানা প্রথম ইউরোপীয়রাই ইংরেজীতে অনুবাদ করে, যার শিরোনাম Instruction of the Student: the Method of Learning। ইংরেজী গ্রন্থখানা ৬০/৭০ পৃষ্ঠার মত হবে। আমি খুঁজেছি পাওয়ার জন্য, তবে পাইনি। কিন্তু এই বইখানা এবং আল-যারনুজি'র জ্ঞান সম্পর্কিত আলোচনা নিয়ে গবেষণা আছে। আমি একটি আর্টিকেল পড়লাম সম্প্রতি, এক কথায় অসাধারণ। এই আর্টিকেলের আলোকেই এই লেখা (আর্টিকেলটি ছেপেছে SAGE Open জার্নাল; আমি কমেন্ট থ্রেডে লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি। আগ্রহী পাঠকগণ পড়ে দেখতে পারেন)।

আল-যারনুজি ইসলামের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী জ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করেছেনঃ

১। এক ধরণের জ্ঞান ফরযে আইন, যা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য অর্জন করা ফরয। তিনি এটাকে বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে অর্জিত জ্ঞান, অর্থাৎ, প্রত্যেক ব্যক্তিকে তা অর্জন করতে হবে। এই জ্ঞানের মধ্যে ইসলামের মৌলিক ইবাদত (ritualistic worship), কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত এবং প্রাত্যহিক জীবন যাপনের জন্য ন্যূনতম যে জ্ঞান, যেমন এটিকেট, ম্যানার, আত্মীয়স্বজন, পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী প্রমুখদের অধিকার এবং দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে জানা। এক কথায়, ফরযে আইনের অন্তর্ভুক্ত জ্ঞানের সীমা তুলনামুলকভাবে ছোট।

২। আরেক ধরণের জ্ঞান হল ফরযে কিফায়া, যা অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরয নয়, তবে মুসলিম কমিউনিটির কিছু মানুষকে তা অবশ্যই অর্জন করতে হবে। আল-যারনুজি এই জাতীয় জ্ঞান অর্জনকে বলেছেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের অর্জিত জ্ঞান (knowledge acquired by the community)। কমিউনিটির কোন কোন ব্যক্তিকে তা অর্জন করতে হবে। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর জ্ঞান, যা ফরযে কেফায়া বা কেউ কেউ পালন করলে সকলের পালন করা হয়ে যায়, হল ইসলামী আনুষ্ঠানিক মৌলিক ইবাদতের বাইরে জীবন যাপন করার জন্য যে জ্ঞান, যেমন, মেডিকেল সাইন্স, এগ্রিকালচারাল সাইন্স, সাইন্সের অন্যান্য যে শাখা আছে যা মানুষের জন্য কল্যাণকর ও দরকারী, ইঞ্জিনিয়ারিং, সামাজিক বিজ্ঞানের শাখাসমূহ, ব্যবসায়িক বিজ্ঞান প্রভৃতি।

আল-যারনুজি'র বক্তব্য হল, দ্বিতীয় শ্রেণীর এই জ্ঞান ইসলামের বাইরে নয়, বরং ইসলামের অন্তর্ভুক্ত জ্ঞান যা আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন মানুষকে দিয়েছেন। এই জায়গায় তিনি "ইসলামী জ্ঞান" (Islamic knowledge) এবং "জ্ঞানের ইসলামিকীকরণ" (Islamization of knowledge) এর কথা বলেছেন। এই জ্ঞান যদি অর্জিত না হয়, তবে মুসলিম সম্প্রদায় কিভাবে জীবন পরিচালনা করবে? আল-যারনুজি বলেন, এই উভয় শ্রেণীর জ্ঞানের ফাউন্ডেশন হবে তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ), এবং সাথে রিসালত এবং আখেরাত। অর্থাৎ, ইসলামী ধারণা অনুযায়ী জ্ঞান আল্লাহ্‌র একত্ববাদকে বাদ দিয়ে হবে না। জ্ঞানের বেডরক হবে, তাঁর ভাষায় tawhidic aspect। তিনি এই জন্য জ্যোতিষ বিদ্যাকে ইসলামের দৃষ্টিকোন অনুযায়ী ইসলামী জ্ঞান বলেন নি, কারণ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ্‌ই জ্ঞানী, এটাই ইসলামের বিশ্বাস। এমনকি ইসলামের ধারণা অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি ভবিষ্যৎ জানার জন্য কোন জ্যোতিষীর কাছে যায়, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তাঁর কোন ইবাদত কবুল হয় না (হাদীসের ভাষ্য মতে)। এই জাতীয় জ্ঞানের বাইরে ইসলাম বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ব্যবসায়/বাণিজ্য সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনকে ফরয করেছে (ফরযে কিফায়া)।

অতএব, কোরআন, হাদীস, ফিক্ক এর বাইরে অন্যান্য জ্ঞান কোন অনিসলামিক জ্ঞান না। শর্ত হল, এ ক্ষেত্রে ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও দর্শনের সাথে তা সাংঘর্ষিক হবে না। এই জন্যই তিনি এই জ্ঞানকে ইসলামিকীকরণের কথা বলেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান না থাকলে যখন একজন মুসলিম রোগাক্রান্ত হবে, তাঁর চিকিৎসা কিভাবে হবে? ঠিক তেমনি আবহাওয়া বিজ্ঞানের জ্ঞান দরকার কৃষিকাজের জন্য। তাঁর ধারণা অনুযায়ী, এই ফরযে কিফায়া জ্ঞানকে খাট করে দেখার অবকাশ নেই, যেহেতু তা অর্জন করাও ফরয। আমার অবাক লাগে, আজ থেকে ৮০০/৮৫০ বছর আগে কি চমৎকারভাবে একজন ইসলামিক স্কলার এভাবে জ্ঞান অর্জনের ব্যাখ্যা দিলেন। ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা তাঁর বই অনুবাদ করে উপকৃত হয়েছেন, অথচ আফসোস এই যে, ইসলামের অনুসারী কত জন মুসলিম এই বই'র খোঁজ রাখছে?

সবশেষে, একটা ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, বদরের যুদ্ধ এই রমজান মাসে হয়েছিল। সেই যুদ্ধে মুসলিম সেনাদের প্রতিপক্ষ অবিশ্বাসী দলের কিছু সেনা যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন, যারা ছিলেন নন-মুসলিম বা কোরআনের ভাষায় "কাফির" (লিটারেলি "অকৃতজ্ঞ" বা যারা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রাসুলের (সাঃ) উপর ঈমান আনে নি)। খেয়াল করুন, নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এই যুদ্ধবন্দীদের মুক্তির একটা শর্ত দিয়েছিলেন এই যে, বন্দীদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তাঁরা মুসলমানদেরকে শিখাবে। কথা হল, তাঁরা কী শিখাবে? কোরআন? হাদীস? ইসলাম? মোটেই না। কারণ, তাঁরা তো ইসলাম জানেই না। তাঁরা অমুসলিম। তাহলে তাঁরা কী শিখাবে? হ্যাঁ, সমাজ, ভাষা, সাহিত্য, যুদ্ধবিদ্যা, বা তৎকালীন ব্যবহার্য জ্ঞান যা ইসলামী আক্কিদা ও বিশ্বাস এবং দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক না, কিন্তু জীবন-যাপনের জন্য দরকারী। রাসুল (সাঃ) যদি এই জ্ঞান শিখানোর জন্য নির্দেশ দিতে পারেন, তবে সে জ্ঞান অর্জন করা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, এবং তা অনিসলামিকও নয়। এর আরেকটি দিক হল, নন-মুসলিম বা কাফির, মুশরিকদের কাছে থেকেও জ্ঞান অর্জন করা নাজায়েজ নয়। রাসুল (সাঃ) এর এই হাদীসটির (যা লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি) এত চমৎকার ব্যাখ্যা আমি আগে শুনি নি। আমাদের এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবনার দরকার আছে।

@Nazrul

পঠিত : ৪৯০ বার

মন্তব্য: ০