Alapon

কম্বোডিয়া গণহত্যা : সমাজতান্ত্রিক আদর্শের এক অদ্ভুত কেতাবি প্রয়োগ...


কম্বোডিয়া দেশটি ছিল খমের জাতির আঙ্কর সাম্রাজ্যের কেন্দ্র। আঙ্কর সাম্রাজ্য ৬০০ বছর ধরে সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া জুড়ে বিস্তৃত ছিল। ১৮৬৩ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত এটি একটি ফরাসি প্রটেক্টরট ছিল। ফরাসিরা রাজতন্ত্রের প্রবর্তন করে ও নরোদম পরিবারকে সিংহাসনে বসায়।

এই পরিবার কিছুটা দমনমূলক নীতি অবলম্বন করায় তাদের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট আন্দোলন দানা বেধে ওঠে। ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামী কমিউনিস্টদের সমর্থনে ও পলপটের নেতৃত্বে খেমাররুজ গেরিলারা রাজধানী নমপেন দখল করে নিলে নরোদম সিহানুক চীনে আশ্রয় নেন এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন।

শুরুতে নমপেনবাসিরা নেচেগেয়ে পলপটকে মুক্তিদাতা হিসেবে বরণ করে নিলেও শিগগিরই তাদের ভাগ্যে নেমে আসে এক ভয়ংকর অত্যাচারের খড়গ। ছাত্রজীবনে পলপট ফ্রান্সে গিয়েছিলেন লেখাপড়া করতে। সেখানেই তিনি কমিউনিস্ট আদর্শে দীক্ষিত হন।

শহুরে শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে গড়া প্রচলিত মার্ক্সিস্ট সমাজতান্ত্রিক মতবাদকে প্রত্যাখ্যান করে পল পট গ্রামের কৃষকশ্রেণীকে নিয়ে ভিন্ন ধরনের এক পাগলাটে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চিন্তা করেন। এই নতুন সমাজতান্ত্রিক ধারণাই কম্বোডিয়ার জনগণের জন্য উপযোগী বলে ঘোষণা করেন।

খেমার রুজ গেরিলাদের চোখে নমপেনবাসী ছিল পাতি বুর্জোয়া। যারা কি না সবসময় ভোগ বিলাসে ডুবে থাকে, মদ খায়, নাইট ক্লাবে নাচে, বার্গার খায়, পশ্চিমা পোশাক পরতে চায়, দেশের প্রতি যাদের বিন্দুমাত্র টান নেই, গ্রামে যেতে চায় না, গ্রামের মানুষের নিয়ে ভাবে না, এরা মহান বিপ্লবে অংশ নেয়নি। খেমার রুজরা নমপেনবাসীদের নামকরণ করে “The Great Whore on the Mekong” ।

এবার দেখা যাক রাজতন্ত্র ডিমোলিশ করে পল পট যে নতুন কমিউনিস্ট সরকার গঠন করলেন তার একেবারে শুরুর দিকে গৃহীত কিছু নীতি:

১) ধনী-গরিব মুক্ত শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের জন্য প্রথম দিনেই সমস্ত অর্থ (money) বাতিল ঘোষণা করা হয়।
২) সমস্ত প্রাইভেট ও পাবলিক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কারণ এই স্কুল গুলোই তো পশ্চিমা শিক্ষার আঁতুড়ঘর। এই স্কুল গুলোকে পরিণত করা হয় টর্চার সেল।
৩) সমস্ত বাজার, মার্কেট, কাপড়ের দোকান বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

৪) প্রাইভেট পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রাইভেট গাড়ি গুলো ভেঙ্গে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়।
৫) ব্যাক্তি সম্পত্তি অর্জন নিষিদ্ধ করা হয়। অর্জিত পূর্বের সম্পদ সরকার বাজেয়াপ্ত করে।
৬) ধর্মীয় স্থাপনা যেমন: প্যাগোডা, মসজিদ ও চার্চ নিষিদ্ধ করা হয়। ধর্ম পালন অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়।

৭) অ-বিপ্লবি এন্টারটেইনমেন্ট, খেলাধূলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
৮) পরিবার প্রথা বিলোপ করা হয়। পরিবারের সদস্যদের প্রতি ভালোবাসা, মায়া মমতা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়।
৯) একসাথে ৩ জন একত্র হলে গ্রেফতার করা শুরু হয়, অনেক ক্ষেত্রে স্পটেই হত্যা করা হয়।

পরিবার প্রথা বিলোপ করে বয়সের ভিত্তিতে মানুষদের ক্লাস করা হয়। যেমন: ৭ থেকে ১৭ ‘এ’ গ্রুপ ১৮ থেকে ২৮ ‘বি’ গ্রুপ। তারপর এই গ্রুপ গুলোর ১০০ বা ২০০ জনকে একত্রিত করে গড়ে তোলা হয় co-opretive। এই co-opretive গুলোর সদস্যরা আর কখনোই নিজের পরিবারের সাথে দেখা করতে পারে না। কখনো দেখা হয়ে গেলেও অপরিচিতদের মত আচরণ করতে হতো। মায়া-মমতার আভাস পাওয়া গেলেই হত্যা করা হতো।

co-opretive গুলোকেই ঘোষণা করা হয় এক একটি পরিবার হিসেবে। এইসব পরিবারে কোন পিতা মাতা থাকে না। কারণ সবার পিতা মাতা একজনই। সেটা হল পার্টি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে co-opretive গুলোর সদস্যদের অর্ধেক নারী আর অর্ধেক পুরুষ রাখা হতো। সমস্ত সদস্যদের গুচ্ছপদ্ধতিতে বিয়ে দেয়া হতো। কারো মতামত প্রকাশের কোন প্রশ্নই ছিল না।

এই মতবাদের বিরোধিতা করলেই তাদেরকে নিষ্ঠুর পদ্ধতিতে হত্যা করা হতো। সারা কম্বোডিয়া ভরে যায় অসংখ্য গণকবরে। কম্বোডিয়ার তৎকালীন 80 লাখ জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ এই ভয়ঙ্কর মতবাদের কবলে পড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

পল পটের এই নতুন খামখেয়ালী নীতি আর ধ্যান-ধারণার কারণে ভিয়েতনাম ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পল পট এবং তার দলের প্রতি বিরাগভাজন হয়, সরিয়ে নেয় সহযোগিতার হাত। তাই বলা যায় পল পট যখন মার্কসবাদের কথা বলছেন তা কি সহি মার্কসবাদ অর্থাৎ মার্কসের সহি ইন্টারপ্রিটেশন কি না সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম ১৯৭৯ সালের দিকে সোভিয়েত সমর্থনে কম্বোডিয়া আক্রমণ করে। ভিয়েতনামী বাহিনী সেসময় খেমাররুজদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে জঙ্গলের ক্যাম্পে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য করে। পল পট পালিয়ে যান এবং আত্মগোপন করেন। হাজার হাজার ক্ষুধার্ত মানুষ কম্বোডিয়া থেকে পালিয়ে থাইল্যান্ডের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়। এরই সাথে খেমাররুজদের ভয়াবহ শাসনামলের সমাপ্তি হয়।

একটি ভুল মতবাদের শেষ পরিণতি কি হতে পারে কম্বোডিয়ার গণহত্যা তার জলন্ত প্রমাণ।

@Barki

পঠিত : ৫০৬ বার

মন্তব্য: ০