Alapon

আদনান মেন্দেরেসঃ আতশি কাঁচের পর্যবেক্ষণ



গতকাল ছিল ২৭ শে মে। তুরস্কের গণতন্ত্রের ইতিহাসের জঘন্যতম একটি দিন। নিঃসন্দেহে তা ছিল প্রজাতান্ত্রিক তুরস্কের জন্য ভয়াল এক দিন।
কেননা ২৭ শে মে, ১৯৬০ সালে তুরস্কের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ ভোট(৫৭%) অর্জনকারী আদনান মেন্দেরেসের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে ক্যু করে দেশটির সেনাবাহিনীর নির্দিষ্ট একটি অংশ। পরবর্তীতে ১৭ ই সেপ্টেম্বর ১৯৬১ সালে তুরস্কের ইতিহাসে প্রথম এবং সর্বশেষ কোন প্রধানমন্ত্রীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়।

আমাদের কাছে কাহিনী বর্ণনা করা হয় যে- আযান চালু করার কারণে আদনান মেন্দেরেসকে ফাসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়
আমরাও আবেগে দিশেহারা হয়ে আপ্লুত হই, বন্যার বানের তোড়ের মতো চোখের জল ছুটে।

আসলেই কি তাই??? ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এর জবাব হয়তো পাওয়া যাবে।

তথ্যানুসারে, তুরস্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দেরেসের জন্ম ১৮৯৯ সালে। তুরস্কের সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারের সন্তান আদনান মেন্দেরেসের শৈশব পার হয় আয়দিন নামক শহরে। পরবর্তীতে ইজমিরের ‘আমেরিকান কলেজে’ অধ্যয়নের মাধ্যমে ইজমিরের জীবন শুরু হয়।
১৯৩১ সালে প্রজাতান্ত্রিক তুরস্কের স্বপ্নদ্রষ্টা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের আমন্ত্রণে তৎকালীন সময়ের একমাত্র রাজনৈতিক দল CHP তে যোগ দেন। আতাতুর্কের অধীনে খুব শীঘ্রই তার পদোন্নতি হতে থাকে। ১৯৩০ সালে আনকারার আইন বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৩৫ সালে ডিগ্রী অর্জন করেন। এরই মধ্যে ১৯৩১ সালে তিনি মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের দল CHP তে যোগ দেন এবং তাকে তার জন্মস্থান আয়দিন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেন মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক। এই ক্রমধারা বজায় রেখে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের অধীনে ১৯৩৫ সালে, পরবর্তীতে ১৯৩৯ এবং ১৯৪৩ সালেও CHP এর অধীনে তিনি তার জন্মস্থান আয়দিন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
মুলত তখনকার নির্বাচনকে নির্বাচন হিসেবে গণনা করা যায় না। কেননা একটি মাত্র দল ছিল। আর মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ছিলেন সর্বেসর্বা। তাই তার আশীর্বাদ নিলেই নির্বাচিত হওয়া যেত। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের সেক্যুলার দীক্ষায় আদনান মেন্দেরেসও দীক্ষিত হন।

আতাতুর্কের মৃত্যুর পরপরই ১৯৩৮ সালেই ইসমেত ইননু ক্ষমতায় বসেন এবং ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতার আসনে সমাসীন থাকেন। ইসমেত ইননু ক্ষমতায় এসে দ্বিগুন বেগে চাপ বাড়াতে থাকেন নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। সকল কিছু থেকে আতাতুর্কের নাম সরিয়ে নিজের নাম স্থাপন করেন, বিশেষ করে মুদ্রাব্যবস্থায় নিজের ছবি স্থাপন করেন। তৎকালীন আতাতুর্ক প্রিয় আদনান মেন্দেরেস সহ অনেকেরই ব্যাপারটি পছন্দ হয় নি।
অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইসমেত ইননুর অসাধারণ ভূমিকা তাকে এক অর্থে তুরস্কের জনগণের কাছে হিরো বানিয়ে দেয়। কেননা তার কূটনৈতিক ভূমিকার কারণে তুরস্ককে কোন পক্ষই ২য় বিশ্বযুদ্ধে জড়াতে পারে নি। তা না হলে মাত্র গুছিয়ে উঠা দেশটিকে আবারও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হতো।

১৯৪৩ সাল থেকে CHP এর মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয় ইসমেত ইননুর একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের দরুন। আদনান মেন্দেরেস নতুন একটি দল খুলতে চান। কিন্তু ইসমেত ইননু বাধ সাধেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সকল দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। অবশেষে ১৯৪৫ সালে আমেরিকা ও বহির্বিশ্বের চাপে বাধ্য হয়ে আদনান মেন্দেরেসকে নতুন দল গঠনের অনুমতি দেন ইসমেত ইননু। ১৯২৩ সালের পর এই প্রথম নতুন আরেকটি দলের দেখা পেল তুরস্কের জনগণ। আদনান মেন্দেরেস তার নতুন গঠনকৃত এই দলটির নামকরণ করেন ডেমোক্রেট পার্টি (DP) যেহেতু গণতন্ত্র তথা ডেমোক্রেসি সকলের কাছে নতুন এক ফ্যান্টাসির নাম।
একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, ১৯২৩ এর পর থেকে তুরস্কে নির্বাচন হতো না। তবে দল যখন একটি থাকে তখন মূলত কিছু করার থাকে না।

নতুন দল গঠন করেই তিনি নিজেকে ডানপন্থী হিসেবে ঘোষণা দেন। আয়রনি এখানেই যে, দীর্ঘ ১৫ বছর CHP এর মতো একটি দলকে সেবা দিয়ে সেই দলের প্রথম ৩ জনের মধ্যে একজন নেতা হয়েও নতুন দল গঠনের পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেকে ডানপন্থী হিসেবে ঘোষণা দেন।
১৯৫০ সালের নির্বাচনের পূর্বে তার যে ইশতেহারের কারণে তুরস্কের জনগণ তাকে ডানপন্থী একজন নেতা হিসেবে তাকে মেনে নেয়, সেটি হচ্ছে- নির্বাচনে বিজয়ী হলে প্রথম পদক্ষেপ হবে আযানকে পুনরায় আরবীতে চালু করা

অবশেষে ১৯৫০ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি ইসমেত ইননুর দীর্ঘ ১২ বছরের শাসনকালের অবসান ঘটান। আতাতুর্কের পর CHP তে জনপ্রিয়তার দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে ছিলে ইসমেত ইননু এবং তৃতীয় স্থানে ছিলেন আদনান মেন্দেরেস। তাই ১৯৪৫ সালে CHP এর এই ভাঙ্গনের ফলাফল ছিল ১৯৫০ সালে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন। কেননা একই দল ভেঙ্গে দুইটি দল তৈরী হয়েছে।

আযান পুনরায় আরবীতে চালুঃ
১৯৫০ সালের ২২ শে মে ক্ষমতায় বসেন আদনান মেন্দেরেস। সাথে সাথেই তার নির্বাচনের প্রথম ইশতেহার আযান পুনরায় আরবীতে চালু করার ঘোষণা বাস্তবায়ন করেন। ১৬ ই জুন তিনি সংসদে উত্থাপন করে হ্যা ভোটের মাধ্যমে পুনরায় আযান চালু করেন একই সাথে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেলাল বায়ারও আযান পুনরায় আরবীতে চালু করার ঘোষণাপত্রে সাক্ষর করেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে আদনান মেন্দেরেস বলেন আর জেলাল বায়ার বলেন সকলেই হচ্ছেন সাবেক CHP এর হর্তাকর্তা। এমনকি ইসমেত ইননু যিনি কিনা CHP এর প্রধান ছিলেন তারও এ ব্যাপারে কোন আপত্তি ছিল না।

সমস্যা হচ্ছে, মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ইজতিহাদী সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আযান আরবী থেকে তার্কিশ ভাষায় চালু করেন। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে মোস্তফা কামাল ছিলেন উসমানী আমলের পাশা তথা জেনারেল। আর একজন পাশাকে ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ঠ ভাল জ্ঞান রাখতে হত। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত কামাল পাশা এখানেই নিজের সকল বুদ্ধিমত্তা উজাড় করে দেন। আর সূক্ষ কৌশলে ইসলামের ফিকহী বিষয়কে সামনে নিয়ে এসে আলেমদের মাধ্যমে ইজতিহাদী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৯৩২ সালে আযান আরবী থেকে তার্কিশে চালু করেন। এমনকি কুর’আনও আরবী থেকে তার্কিশে রূপান্তর করেন এবং তার্কিশ ভাষায় কুর’আন হাফেজও তৈরী করেন।
হ্যা, মুসলিমদের কিছু কিছু অঞ্চলে কোন একসময় আযান নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য আরবীতে দেয়ার ইতিহাস আমরা জেনেছি, তবে সেটা ছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এবং খুবই অল্পসময়ের জন্য। বিশেষজ্ঞরা আন্দালুসিয়ার উদাহরণ দিয়ে থাকেন। যেটাকে রেফারেন্স হিসেবে নিয়েছিলেন কামাল পাশা।
কিন্তু এরকম আপেক্ষিক একটি বিষয়কে স্থায়ী বানিয়ে আযান ও কুর’আনের এই পরিবর্তন কেউ কখনো দেখেনি। তার এরকম উদ্ভট ও অযৌক্তিক কান্ড-জ্ঞানহীন আচরণ ইসলামের প্রতি বিরূপ মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।

দীর্ঘ ১৮ বছর পর তুরস্কের মাটিতে আবারও আল্লাহু আকবার ধ্বনি উচ্চারিত হতে থাকে। ইসলাম প্রিয় জনতার অন্তরে প্রশান্তির এক বাতাস বয়ে যায়। পুরো একটি প্রজন্ম এই আযান থেকে বঞ্চিত ছিল দীর্ঘদিন। যাদের জন্ম ১৯৩২ সালে তারা তো তাদের জীবনের ১৮ বছরই কাটিয়েছে আযানবিহীন এক পরিবেশে।
আযান শুধু একটি আহবানই নয়, তা মুসলিম সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ।
আদনান মেন্দেরেসের এই অবদানের কারণে তুরস্কের ইসলাম প্রিয় জনগণ ব্যাপক সমর্থন জানায় তাকে।

তুরস্ককে আতাতুর্ককরণঃ
ইসমেত ইননু ক্ষমতায় এসে বলা যায় মোস্তফা কামালের নাম প্রায় মুছে দিয়েছিলেন। এর পরিবর্তে সকল জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ইসমেত ইননু আতাতুর্কের সমসাময়িক ছিলেন বিধায় CHP এর পক্ষ থেকে অধিকাংশই বিরোধীতা করে নি। আরেকটি কারণ ছিল ইসমেত ইননুর জাঁদরেল স্বভাব। বিরোধীতা করেছিলেন আতাতুর্কের আদর্শে উজ্জীবিত CHP তৎকালীন তরুণ নেতা বলা যায় CHP এর তৃতীয় ব্যক্তি আদনান মেন্দেরেস ও তার সমর্থকেরা।

আদনান মেন্দেরেস ক্ষমতায় এসেই সকল ব্যাংকনোট ও স্ট্যাম্পে আতাতুর্কের ছবি পুনরায় প্রবর্তন করেন যা কিনা ইসমেত ইননু তুলে নিয়েছিলেন। জনগণের সমর্থনে ক্ষমতায় বসে তিনি তার রাজনৈতিক গুরু মোস্তফা কামালের প্রতি এই শ্রদ্ধা জানাতে বিন্দুমাত্র দেরী করেন নি।

ন্যাটোতে তুরস্কের যোগদান তার সময়েই হয়েছে এবং ইসরাঈলের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তার অবদান ছিল অসামান্য। তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা করেন। তার সময়ে জিডিপিও ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে অর্থনীতিতে দুরবস্থা দেখা দেয়।

আতাতুর্কের মাজার নির্মাণঃ
ক্ষমতায় এসেই ৩ বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে আদনান মেন্দেরেস মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের কবর প্রতিস্থাপন করে ভিন্ন এক জায়গায় নিয়ে যান এবং সেখানে আতাতুর্কের মাজার নির্মাণ করেন যা বর্তমানে আনিতকাবির হিসেবে বিখ্যাত। হাজারো মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য এখানে সমবেত হন কামাল পাশার জন্ম ও মৃতুবার্ষিকীতে। আদনান মেন্দেরেসের কারণেই সাবেক প্রেসিডেন্ট ইসমেত ইননুর পরিবর্তে পুরো তুরস্কে আবারও মোস্তফা কামালের নাম উচ্চারিত হতে থাকে।

তুরস্কের জনগণের মনে আতাতুর্ককে যদি কেউ সত্যিকার অর্থেই জাতি পিতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে থাকেন তাহলে সেক্ষেত্রে সবটুকুই অবদান বলা যায় আদনান মেন্দেরেসের।

তার এসকল কাজের দরুন পরবর্তী নির্বাচনে জনগণ তাকে তুরস্কের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৫৭% ভোট প্রদান করে জয়ী করে যা এখনো তুরস্কের ইতিহাসে রেকর্ড হয়ে আছে। আজ পর্যন্ত এই অংক কেউ ছুতে পারে নি।

আদনান মেন্দেরেসের পতনঃ
এককভাবে একজন ব্যক্তি যখন ৫৭% ভোট পান তখন ঐ ব্যক্তির মধ্যে স্বৈরাচারী মনোভাবের লক্ষণ দেখা যাওয়া অতি স্বাভাবিক। তার উপর এই নির্বাচনগুলোতে জনগণের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছিল। একদিকে ক্ষমতার আসনে শক্তভাবে অধিষ্ঠিত আদনান মেন্দেরেস অপরদিকে ভোটের পরিমাণ ৫৭%!! বাধা দেয়ার কেউ নেই। এরপরেই তিনি এমনকিছু কাজ করে বসেন ক্ষমতার মোহে যা তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।

প্রথমেই তিনি সংবাদমাধ্যমের উপর হস্তক্ষেপ শুরু করেন। আদনান মেন্দেরেসের দল ডেমোক্রেট পার্টি যখন ক্ষমতায় বিরোধীদল হিসেবে তখন CHP । সাবেক প্রেসিডেন্ট ইসমেত ইননু CHP এর প্রধান। ৫৭ সালের পর থেকে আদনান মেন্দেরেসের আক্রোশের শিকার হতে থাকেন CHP ও এর প্রধান ইসমেত ইননু।

মূলত অর্থনৈতিক দুরবস্থার দরুন CHP সরকারী দল ডেমোক্রেট পার্টির ব্যাপক বিরোধিতা শুরু করে।
মেন্দেরেস সরকারের ডলার বিপরীতে তুরস্কের মুদ্রার মান ৩ গুন হ্রাস পায়। পূর্বে যেখানে ১ ডলার= ২.৮ লিরা ছিল তা হুট করে বেড়ে দাঁড়ায় ১ ডলার= ৯ লিরা!!

মেন্দেরেস সরকার বিরোধীদলের কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। বিরোধীদলের ব্যাপক সমালোচনায় কোনঠাসা হয়ে পড়ে সরকার। এরই মধ্যে ১৯৫৯ সালের ১ম এবং ৪ঠা মে উশাক এবং ইস্তাম্বুলে পরপর দুই জায়াগায় বিরোধীদলীয় নেতা CHP এর প্রধান ইসমেত ইননুর উপর আক্রমণ করে মেন্দেরেসের সমর্থকরা। এই ঘটনায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বিরোধীদলীয় নেতারা। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো দেশ।

বিষয়টি ইসমেত ইননুর জন্য সাপে বর হয়ে উঠে কিন্তু আদনান মেন্দেরেসের পতন আরও তরান্বিত করে। যত যাই হোক না কেন ইসমেত ইননু ছিলেন তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট। সেনাবাহিনীর প্রধান থেকে শুরু করে সকলেই তার ছাত্র বা জুনিয়র বলা চলে। বিরোধীদলীয় প্রধান হিসেবেও সাংবিধানিকভাবে তার প্রতি সেনাবাহিনী অনুরক্ত ছিল।
অন্যদিকে আদনান মেন্দেরেস আতাতুর্ককে গ্লোরিফাই করার যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেটাকেও নিজের ফেভারে নিয়ে যান ইসমেত ইননু। কেননা দিনশেষে আতাতুর্কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দুঃসময়ের সাথী হিসেবে পরিচিত ছিলেন ইসমেত ইননু।

পরবর্তীতে ক্ষমতার মোহে আদনান মেন্দেরেস যে পদক্ষেপ নেন তা তার ক্ষমতার কফিনে শেষ পেরেক টুকে দেয়
তিনি ১৯৬০ সালের ১৮ এপ্রিল তাহকিকাত কমিশন নামে একটি রাজনৈতিক কমিটি গঠন করেন। কমিটির সদস্য ছিলেন আদনান মেন্দেরেসের এমপি, মন্ত্রী এবং আদনান মেন্দেরেসের দল ডেমোক্রেট পার্টির সদস্যরা। এই কমিটিকে অসম্ভব রকমের ক্ষমতা প্রদান করেন আদনান মেন্দেরেস। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
১) এই কমিশন সংবাদমাধ্যম এবং বিরোধীদলের বিরুদ্ধে আরোপিত সকল অভিযোগের তদন্ত করবে।
২) কমিশন সকল ধরণের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, মিটিং মিছিলে নিষেধাজ্ঞা জারী করার একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রদানে সক্ষম থাকবে।
৩) যেকোন ধরণের পাব্লিকেশন, মিডিয়া উইং, ডকুমেন্ট নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা এই কমিশনের আছে।
৪) এই কমিশনের সিদ্ধানতই চূড়ান্ত। কমিশনের নির্ধারিত আদেশকে সুপ্রিম কোর্টও চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না। অর্থাৎ এই কমিশন সুপ্রিম কোর্টে এবং সকল বিচার ব্যবস্থার উর্ধ্বে।
৫) এই কমিশনের সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করলেই ১ থেকে ৩ বছরের জেল প্রদান করা হবে।

এই কমিশন গঠনের সাথে সাথেই কমিশন কর্তৃক অতি দ্রুততার সাথে ২ টি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেগুলো হচ্ছে-
১) রাজনৈতিক দলসমূহের সকল ধরণের সভা-সমাবেশ, মিছিল মিটিং সহ সকল ধরণের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়।
২) এবং কমিশন কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্ত, কার্যক্রম ইত্যাদিন সকল বিষয়ে কোন ধরণের সংবাদ(নেগেটিভ) প্রচার করা যাবে না এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং তা জারী করা হয়।

এরপরের দিন ১৯ শে এপ্রিল সকল পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয়- “সকল ধরণের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ”।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাস্তায় নেমে পড়ে, বিক্ষোভে ফেটে পড়ে পুরো দেশ। সরকারও পুলিশ দিয়ে দমনের চেষ্টা করতে থাকে।
এরই মধ্যে সেনাবাহিনীও ক্ষেপে যায় সরকারের বিরুদ্ধে। এরকম একটি কমিশন গঠন ও সিদ্ধান্ত প্রণয়ন সংবিধান বিরুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং সত্যিকার অর্থেই এই কমিশন গঠন এবং কমিশনের সিদ্ধান্তসমূহ গণতান্ত্রিক কোন আচরণের মধ্যে পড়ে না।
পরবর্তীতে ২৭ শে মে ১৯৬০ সালে সেনাবাহিনী ক্যু করে আদনান মেন্দেরেসকে গ্রেফতার করে। এই ক্যু এর মুখপাত্র ছিলেন তুরস্কের জাতীয়বাদী দল MHP এর প্রতিষ্ঠাতা আলপারসলান তুর্কেশ। আদনান মেন্দেরেসের বিরুদ্ধে ক্যু এর মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বপালনকারী আলপারসলান তুর্কেশের দল MHP ই বর্তমানে রেজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সরকারী দল একেপির সাথে জোট করে ক্ষমতার আসনে বসে সরকার পরিচালনা করছে।
এর এক বছর পর ১৭ ই সেপ্টেম্বর তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড কার্যক্রম করে ইসমেত ইননুর সরকার।

সর্বশেষ কিছু কথাঃ
অনেকেই বলে থাকেন, আযান পুনরায় আরবীতে চালু করার কারণে নাকি আদনান মেন্দেরেসকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে!!!
এই দাবী উত্থাপন করলে অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি হয় যার সমাধান সত্যিকার অর্থেই খুজে পাওয়া মুশকিল। কেননা এই দাবী উত্থাপন করলে কয়েকটি প্রশ্ন থেকেই যায়-

১) আদনান মেন্দেরেস আযান পুনরায় আরবীতে চালু করেন ১৯৫০ সালে। অথচ তার বিরুদ্ধে ক্যু হয় ১৯৬০ সালে এবং তাকে ফাঁসি দেয়া হয় ১৯৬১ সালে। মাঝে ১১ বছরের ব্যবধান !!!!!
আযানের প্রতি যদি এতই এলার্জি থেকে থাকে সেনাবাহিনীর তাহলে কেন ওরা বিগত দশ বছরে আদনান মেন্দেরেসকে ক্ষমতা থেকে নামানোর চেষ্টা করে নি???

২) আযানই যদি মুখ্য বিষয় হয়েই থাকে তাহলে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত পুনরায় ক্ষমতার মসনদে বসা ইসমেত ইননু সরকার কেনই বা আবার আযান আরবী থেকে তার্কিশে প্রচলনের ব্যবস্থা করে নি??

৩) সেনাবাহিনী ১০ বছর কিছু করে নি। আদনান মেন্দেরেস কর্তৃক তাহকিকাত কমিশনকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেয়ার পর পরই কেন সেনাবাহিনী ক্যু করলো??

৪) সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এতোকিছু সত্ত্বেও ডেমোক্রেট পার্টিকে নিষিদ্ধ করে নি তুরস্ক সরকার। উলটো ৩ বছরের মাথায় ১৯৬৩ সালে ক্ষমতার আসনে আবারও আসে ডেমোক্রেট পার্টি এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন আদনান মেন্দেরেসের স্থালাভিষিক্ত হিসেবে উপাধিপ্রাপ্ত সুলেমান দেমিরেল। প্রশ্ন থেকে যায় যে- এখানে তাকে আযানের কারণে ফাঁসি দেয়া হয়েছে নাকি CHP এর প্রধান ইসমেত ইননু, পূর্বের সেই ১৯৪৫ থেকে ১৯৫০ এর ঘটনাবলীর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন?? নাকি ১৯৫৯ সালে আদনান মেন্দেরেসে সমর্থকদের দ্বারা তার উপর হামলার প্রতিশোধ নিয়েছিলেন??

সর্বশেষ আবারও দ্বিতীয় প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করছি-
আযান আরবীতে পুনরায় চালু করাই যদি আদনান মেন্দেরেসের বিরুদ্ধে ক্যু এবং ফাসির কারণ হয়ে থাকে তাহলে ১৯৫০ সালের পর থেকে আজ ২০২০ পর্যন্ত কেন আযান তার্কিশে প্রচলনের ব্যবস্থা গ্রহণের কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় নি??
অথচ ১৯৬০ সালে তুরস্কের ক্ষমতায় আসেন আদনান মেন্দেরেসের সাবেক রাজনৈতিক দল CHP এর প্রধান এবং তারই এক সময়ের সহযোগী ইসমেত ইননু যার সাথে তিনি কিনা কাধে কাঁধ মিলিয়ে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের অধীনে CHP এর নেতৃত্বের ভার সামাল দিয়েছিলেন ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত।

প্রশ্নসমূহের জবাব খুজে পাওয়া আজও দুস্কর!!!!!!

পঠিত : ১২০৫ বার

মন্তব্য: ০