Alapon

করোনা এবং বর্ণবাদবিরোধী চলমান আন্দোলনে চরম বিপর্যস্ত বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্র



এখন পুরো বিশ্বে চলছে 'জোর যার মুল্লুক তার' নীতি। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বশাসনে মুখ্য ভূমিকা রাখছে সামরিক শক্তি। সামরিক শক্তি দিয়েই গত তিন দশক ধরে আমেরিকা বিশ্বের একক পরাশক্তি হিসেবে পুরো বিশ্বকেই প্রচ্ছন্নভাবে চোখ রাঙ্গিয়ে যাচ্ছে। পরিসংখ্যান মতে, সামরিক শক্তির দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষে। তাদের মোট বাজেট বরাদ্দ হচ্ছে ৫৯৬ বিলিয়ন ডলার, যা পরবর্তী সাতটি দেশ—চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স ও জাপানের সম্মিলিত ব্যয় ৫৬৭ বিলিয়নের চেয়ে বেশি। ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে পলিটিকোতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ডেভিড ভাইন দেখিয়েছিলেন যে পৃথিবীর ৭০টি দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি আছে ৮০০! সময়ের পরিক্রমায় তা হয়তো এখন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বের যেখানেই সামরিক সংঘাত সেখানেই যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

তবে দিনদিন বিশ্ব রাজনীতিতে আমেরিকার প্রভাব ক্রমান্বয়ে খর্ব হচ্ছে। আমেরিকার আধিপত্য দিনদিন বিশ্বব্যাপী ছোট হয়ে আসছে। বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা বিশ্ব-দরবারে আমেরিকার আধিপত্য টিকিয়ে রাখাকে ধীরে ধীরে কষ্টসাধ্য করে তুলেছে। বর্তমানে পৃথিবী আর এক কেন্দ্রিক পৃথিবী নাই, পরিনত হয়েছে বহুমুখী পৃথিবীতে । এমনটি যদি চলতে থাকে, তাহলে সেই দিন দূরে নয়; যে দিন আমেরিকা তার আধিপত্য হারাবে এবং চীন, রাশিয়াসহ অন্যান্য উদীয়মান রাষ্ট্রগুলো বিশ্ব-দরবারে প্রভাবক হিসেবে আভির্ভূত হবে।

আমেরিকা সিরিয়ায় বড় ধরণের হোঁচট খাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই এখন করোনায় টালমাটাল। প্রাণঘাতী করোনায় এখন পর্যন্ত চরম বিপর্যস্ত দেশগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্র। ওয়ার্ল্ডোমিটারের সর্বশেষ তথ্যনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে এখন পর্যন্ত ১,৮১৫,৯০৩ জন করোনায় আক্রান্ত। এর মধ্যে মারা গিয়েছে ১০৫,৫৪৫ জন। গত ২৪ ঘন্টায় নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা ২২,৩৭৫ জন। (ওয়ার্ল্ডোমিটার, সর্বশেষ আপডেট, ৩১ মে ভোর ৬ টা)

দিনদিন দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। এই চরম বিপর্যয়ের মুখে ভেঙ্গে পড়ছে চিকিৎসাখাত সর্বোপরি রাষ্ট্রযন্ত্র। বর্তমান অবস্থাকে 'চরম বিশৃঙ্খলাপূর্ণ বিপর্যয়' হিসেবে আখ্যা দিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামা ট্রাম্প প্রশাসনের তুমুল সমালোচনা করেন। গত কিছুদিন আগে শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইনে প্রচারিত দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠান ‘শো মি ইয়োর ওয়াক, এইচবিসিইউ এডিশনে’ওবামা শিক্ষার্থীদের প্রতি আরও বলেছিলেন, ‘যৌনতাবাদ, জাতিগত কুসংস্কার, মর্যাদা, লোভ ইত্যাদি সকল পুরানো বিষয় পেছনে ছেড়ে দাও, যা আমাদেরকে একে অপরের থেকে আলাদা করেছে এবং বিশ্বকে একটি ভিন্ন পথে নিয়ে যাও।’

এই বক্তব্যের অল্প ক'দিনের মধ্যেই সারাবিশ্ব আমেরিকার এমন একটি ঘটনার স্বাক্ষী হলো যেটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বিশ্বমানবতার ধ্বজাধারি আমেরিকায় 'জাতিগত শ্রেষ্টত্বের কুসংস্কার' এখনো কতটা প্রকট। নিরস্ত্র একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার হাঁটু দিয়ে তার গলা চেপে ধরার পর ওই ব্যক্তির মৃত্যু দেশটিতে সংখ্যালঘু বর্ণ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পুলিশের নৃশংসতাকে আবার সামনে এনেছে।

ঘটনা সম্পর্কে জানা যায়, 'মিনিয়াপোলিস অঙ্গরাজ্যের একটি রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তা কর্মী হিসাবে কাজ করতেন ৪৬ বছর বয়স্ক জর্জ ফ্লয়েড। ২৫শে মে তারিখ সন্ধ্যায় সন্দেহভাজন একটি প্রতারণার ব্যাপারে কল পেয়ে পুলিশ তাকে ধরে।

একজন প্রত্যক্ষদর্শীর তোলা ১০ মিনিটের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায় জর্জ ফ্লয়েড নি:শ্বাস না নিতে পেরে কাতরাচ্ছেন এবং বারবার একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারকে বলছেন, "আমি নি:শ্বাস নিতে পারছি না"। তবুও শ্বেতাঙ্গ ওই অফিসার নির্লিপ্তভাবে পা দিয়ে গলা চেপে ধরে খুন নিশ্চিত করে।

এই ঘটনা যেদিন ঘটে সেইদিনই আর একটি ভিডিও ভাইরাল হয় যেটি ছিল নিউইয়র্কে এক শ্বেতাঙ্গ নারীর পোষা কুকুর নিয়ে তুচ্ছ একটা বিতর্কের জেরে পুলিশ ডাকার এবং এর জন্য পুলিশের এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির ওপর চড়াও হবার ঘটনার।
ওয়াশিংটন পোস্ট সংবাদপত্রের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে মারা গেছে ১০১৪ জন এবং বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে আমেরিকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান।

এই বর্ণবাদী আক্রোশের দরুন সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে পুরো যুক্তরাষ্ট্র। বিক্ষোভ প্রথমে মিনিয়াপোলিস অঙ্গরাজ্যে শুরু হলেও এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন শহরে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় মিনিয়াপলিস ও সেন্ট পল শহরে কারফিউ জারি করার পরেও বিক্ষোভকারীরা কারফিউ অমান্য করেই বিক্ষোভ করেন। এছাড়াও অনেক শহরেই পুলিশ স্টেশন, পুলিশের গাড়িসহ বেশি কিছু গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছেন বিক্ষুব্ধরা। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে। কাঁদানে গ্যাস ও পিপার স্প্রে ছোঁড়াসহ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা ও এক আন্দোলনকারীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। ব্যাপকহারে লুটপাট করা হচ্ছে রাস্তার আশপাশে সকল প্রতিষ্টানে। এমনকি কয়েক জায়গায় বিক্ষুদ্ধদের বিক্ষোভের মুখে ফায়ার অফিসাররা আগুন নেভাতে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেনা বলে মিডিয়া জানাচ্ছে। সর্বশেষ বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাপক হারে এই আন্দোলন ছড়িয়ে এখন অগ্নিগর্ভে রূপ নিয়েছে এই আন্দোলন। সবচেয়ে স্পর্শকাতর স্থাপনা হোয়াইট হাউজের পাশেই হাজারো আন্দোলনকারী অবস্থান নিয়েছে।



কিছু মিডিয়া এই আন্দোলনকে কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলন হিসেবে দেখাতে চাইলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #JusticeForGeorgeFlyod #BLACK_LIVES_MATTER হ্যাশট্যাগে ভাইরাল হওয়া আন্দোলনের ফুটেজ গুলোতে দেখা যাচ্ছে আমেরিকার সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতিশীল বহু শ্বেতাঙ্গ নাগরিকও এই আন্দোলনে স্বতঃস্পূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছে। বরঞ্চ অনেক শহরে শ্বেতাঙ্গদেরকেই বেশি পরিমাণ দেখা গেছে।

দিনদিন পরিস্থিতি আর উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এছাড়াও বড় একটি শঙ্কার কারণ হচ্ছে আন্দোলনে কোনপ্রকার শারীরিক দূরত্ব মানা হচ্ছেনা। যাতে করোনার হানা আরো ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে বলে সবার আশঙ্কা। যেটা ঘটলে হয়তোবা চলমান সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের যে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি তা অনেকাংশেই স্থবির করে দিয়েছে এই বিশ্বমোড়লকে। তবে শেষ কথা হলো রেসিস্ট ট্রাম্পের পতন যেমন জরুরী আপাতত মন্দের ভালো হিসেবে আমেরিকার হাতে বিশ্ব শাসনের ক্ষমতা থাকাটাও জরুরী। বাকি যে পরাশক্তি গুলো উঠে আসছে রাশিয়া, চীন, ভারত সবগুলাই নীতি-নৈতিকতাহীন একেকটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্র।

পঠিত : ৫২৬ বার

মন্তব্য: ০