Alapon

মাড়িয়ে যাওয়া গোলাপ

চৈত্রের দুপুর। মানুষের উপচে পড়া ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ কনকশ্রী গ্রামের বাজার। কোথাও একটু পা ফেলার জায়গা নেই। মাছের আঁশটে গন্ধ আর হাজারো মানুষের নি:শ্বাসে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসছে তরুর মায়ের। প্রাণটা যেন ভিড় খেকে পালিয়ে যেতে চাইছে তার। বাজার থেকে বেরিয়ে আসতেই মনে পড়লো বাড়িতে থাকা অসুস্থ মেয়ের আবদারের কথা। বিক্রেতাকে বড় একটি মাছের দাম জিজ্ঞাসা করলেন তরুর মা। ১৫০ টাকা দাম শুনে হাতে রাখা টাকার ব্যাগে চোখ বুলিয়ে নীরব হয়ে গেলেন তিনি। মাথার ওপর গণগণে সূর্য নিয়ে হাটা ধরলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।

রাত থেকে মেয়েটার জ্বর। হাটতে হাটতে ভাবছেন সেলিনা। সেলিনার একমাত্র মেয়ে তরু। বাড়ির কাছেই একটা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে সে। হলদে ফরসা গায়ের রঙ। টানা টানা সুন্দর চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, পৃথিবীর সব মায়া যেন মিশেছে ঐ চোখে।

ঘামে ভেজা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়িতে ফিরলেন সেলিনা। হাতের ভারি ব্যাগ থেকে ওষুধের শিশি নিয়ে ঢুকলেন তরুর ঘরে। তরুকে না পেয়ে জোরে জোরে ডাকতে লাগলেন। কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে খোঁজ নিলেন বাড়ির বাইরে। হন্তদন্ত হয়ে আশেপাশের সব বাড়িতে যেয়েও খোঁজ মিলল না তরুর। অজানা আশঙ্কায় অশান্ত মন নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সেলিনা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। বাজারের ব্যাগটা ওভাবেই পড়ে থাকলো বারান্দায়। অবিরাম কান্নায় ভেঙে পড়লেন সেলিনা। সন্ধ্যার আঁধারে কাজ শেষে বাড়ি ফিরলেন তরুর বাবা। বাড়িতে ঢুকে সবটা জেনে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলেন তিনি। প্রতিটি বাড়িতে খোঁজ নিয়ে অজানা আতঙ্কে দৌড়াতে লাগলেন সামনের দিকে। চারপাশে অন্ধকারের একমাত্র সঙ্গী তখন আকাশের সরু চাঁদ। এরই মাঝে কানে ভেসে আসলো শেয়ালের ডাক। কি যেন ভেবে সেদিকেই ছুটে গেলেন তরুর বাবা। ঝোপের মত একটা জায়গায় হন্য হয়ে খুঁজতে থাকলেন তরুকে। যেন মেয়ের গন্ধ মাতালের মত বাবাকে টেনে এনেছে ঠিক জায়গায়। চাঁদের ক্ষীণ আলোয় দেখতে পেলেন মাটিতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে থাকা একমাত্র মেয়েকে। এক মুহূর্তের জন্য নিশ্চিন্ত হয়ে সোজা বাড়ির দিকে ছুটলেন তিনি। বাড়িতে আনার পর তরুকে দেখে নিস্তব্ধ বাবা মা ভেঙে পড়লেন কান্নায়। তরুর সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত-রক্তাক্ত। ফুটফুটে চেহারাটা মলিন হয়ে গেছে। যেন একটি সদ্য ফোটা গোলাপকে মাড়িয়ে দিয়ে গেছে কেউ। তাদের মেয়ের সাথে কি ঘটেছে সেটা আর বুঝতে বাকি থাকল না। মুহূর্তেই মনে পড়ল তাদের শেষ সম্বল একখণ্ড জমির জন্য মোড়লের ছেলের বারবার দেয়া হুমকির কথা। আর এমনিতে মোড়লের দুশ্চরিত্র লম্পট ছেলেটার ভয়ে তটস্থ ছিল তরুর বাবা-মা। অসুস্থ মেয়েকে সুস্থ করার চেষ্টায় নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিল তরুর বাবা মা। পরদিন ভোরে জ্ঞান ফিরল তরুর। সকালের আলো ফুটতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন বাবা। সোজা থানায় যেয়ে পুলিশকে খুলে বললেন সব। মোড়লের ছেলের নামে মামলা করতে চাইলে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অস্বীকৃতি জানালেন। বিচার পাবার আশায় নিরুপায় হয়ে ছুটলেন স্থানীয় মেম্বারের কাছে। গ্রামের জনসাধারণের ভিড়ের মাঝে অনেকটা পরে মেম্বারের সাথে কথা বলার সুযোগ হল। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছু খুলে বললেন মেম্বারকেও। পুরো ঘটনা শুনে চুপ করে থাকলেন মেম্বার। তারপর নিচু স্বরে কঠিন গলায় তরুর বাবাকে বলেন, বিষয়টা নিয়ে আর যেন কোন কথা না হয়। এই বলেই, তার দিকে এক হাজার টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিলেন।

স্তব্ধ হয়ে গেলেন তরুর বাবা। তার চোখ ভর্তি জ্বল। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না তার। এক বুক কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে তরুকে বুকে চেপে ধরলেন। মেয়ের বিচার না পাবার কষ্টে জর্জরিত বাবা একদম চুপ হয়ে গেলেন। নানা চিন্তায় সেদিন রাতও নির্ঘুম কাটলো তার।
পরদিন সকাল। চারদিকে শান্ত পরিবেশ। উঠোনে দিনের স্বাভাবিক কাজকর্মে ব্যস্ত হয়েছেন তরুর মা। তরুর বাবা ঘুম থেকে উঠে চুপচাপ বসে আছেন। হঠাৎ তরুর মায়ের সামনে মেয়েকে কাঁধে তুলে নিয়ে বের হলেন তার বাবা। বাবার ঘাড়ে মেয়েকে দেখে বেশ আনন্দিত হল তরুর মা। সবুজ গ্রাম পেছনে ফেলে লাকসামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অনেকদিন পর বাবার ঘাড়ে উঠে বাধ ভাঙা আনন্দে ভাসছে তরু। রাস্তার দুপাশের গাছগুলোও যেন বাতাসে দুলছে সে আনন্দে। এদিকে মেম্বারের কথাটা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে তরুর বাবার। টাকা দিয়ে কি মানুষের সম্মানও কিনে নেয়া যায়? কোন উত্তর খুঁজে পান না তিনি। সমাজটাকে তার খুব অচেনা মনে হয়। একটা দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে তরুকে বললেন, অনেক দূরের দেশে নিয়ে যাব তোকে আজ। লাকসামের কাছাকাছি এসে চোখে পড়লো রেললাইন । দু পাশে ধানক্ষেত, প্রকৃতি যেন ঝিম মেরে বসে আছে। এরই মাঝে ঝড়ের গতিতে ছুটে আসা ট্রেন দেখে সেদিকে দৌড় দিলেন তরুর বাবা। ট্রেনে চড়ার খুশিতে তরুর চোখে মুখে আলো ঠিকরে পড়ছে তখন। আনন্দের রেশ না কাটতেই তরুকে নিয়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাবা।

ট্রেনের দীর্ঘ হুইসেলের শব্দের মাঝে চিরতরে হারিয়ে গেল তরুর কোমল কণ্ঠের আর্তচিৎকার। অন্যায়ের সাথে আপোষ না করতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হল তরুর বাবাকে। ট্রেনের নিচে শুধু অসহায় দুটি প্রাণ নয়, এক মুহূর্তে চাপা পড়লো এই সমাজের অন্যায় অবিচার আর নিষ্ঠুরতার গল্প।

নিশাত তাসনীম স্বস্তি
নবম শ্রেণী, রাজশাহী সরকারি পি এন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়


(একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)

পঠিত : ৬৫৬ বার

মন্তব্য: ০