Alapon

চিন এবং ভারতের মধ্যকার পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে...


ভারত পাকিস্তানের বেলায় কথায় কথায় যত বেশী সরব মারমুখি চিনের বেলা তার উল্টোটি। চিন যখন ভারতীয় ভুমি দখল করে এগিয়ে যায় লাদাখের দিকে ভারত তখন আলোচনার পথ খোঁজে।

সূত্রোক্ত প্রতিবেদনগুলিতে দেখা যায় চিনা বাহিনী এলএসি সীমানা খুটি, ব্রিজ, কালভার্ট, সেতু উপরে ফেলে গালওয়ান ও শিয়ক নদী, প্যাংঅং লেকের উত্তর তীর, হট স্প্রিং এলাকার ৩-৪ মাইল অভ্যন্তরে ঢুকে তাবু বানিয়েছে তার প্রায় দুই সপ্তাহ লুকোচুরির পর অবশেষে ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং স্বীকার করেছেন, চীনের পিপল’স লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) বিপুল সংখ্যক সদস্য চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) পেরিয়েছে। রাজনাথ সিং বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর মধ্যে আলোচনা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আগামী পরশু ৬ জুন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে লক্ষ্যনীয় ভারত পাকিস্তানের বেলায় কথায় কথায় যত বেশী সরব মারমুখি চিনের বেলা তার উল্টোটি। আনবিক শক্তিধর এই তিনটি দেশের সীমানা বিরোধ পৃথিবীর কোন আলোচনার টেবিলে সমাধান সম্ভব হবার নয়। কারণ এর মূলেই রয়েছে কাশ্মির। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বিলুপ্তির সাথে সাথে কাশ্মির আর ভারতের থাকে নাই। এই দুটি ঐতিহাসিক শর্তে এতদিন কাশ্মির ভারতের অংশ ছিলো। ধারা দুটি বিলুপ্ত করেই ভারত কাশ্মির দখল করে নিয়ে তার দুটি জেলা বানিয়েছে। পাকিস্তান, চিন ও ভারত তিন দেশের কাছেই কাশ্মিরের অংশ আছে। কাজেই আজ হোক আর কাল; যেকোন অযুহাতে এই তিন দেশের যুদ্ধ অনিবার্য্য। করোনার এই বৈশ্বিক অস্হিরতায় বিবাদমান দেশ তিনটি যুদ্ধের উপযুক্ত সময় বিবেচনা করলে অবাক হবার কিছুই থাকবে না্।

চিন-ভারত সীমান্তে ভারতের নির্মিত কয়েক’শ কিমি দীর্ঘ একটি রাস্তা এখন হট স্পট । ২০০৮খ্রিঃ ভারতে নির্মিত একটি এয়ার বেজের সাথে সংযুক্ত এই রাস্তাটি এখন যত নষ্টের গোড়া। দুইটি দেশই এখন মুখোমুখি। বাংকার খুড়ে, তাবু টাঙিয়ে চিনা সৈন্যরা যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে। চিনের গতি প্রকৃতি দেখে এবারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। লাদাখে অন্ততঃ দুইবার উভয় পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হোয়েছে। তাছাড়া চিন ভারতের সীমান্তে গালোয়ান উপত্যকা, হটস্প্রিং ও দক্ষিণে প্যাংঅং তিন জায়গায় সৈন্য সমাবেশ করেছে। দুই দেশের ৩,৪৪০কিমি বা ২১০০ মাইল সীমান্ত থাকলেও উভয় পক্ষের সীমান্ত রক্ষীরা বিগত চার দশকে একটি গুলিও খরচ করে নাই। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দুটি দেশের এত লম্বা সীমান্তের এ্যকচুয়াল লাইন অব কন্ট্রোল নির্ধারিত হোয়েছে আঁকাবাঁকা নদী, লেক, স্নোক্যাপ, ঝর্না, পাহাড় কিংবা মালভূমির উপর দিয়ে যার দুই পার্শে অনেকগুলো পয়েন্টে উভয় দেশের সৈনিকরা মুখোমুখি হোচ্ছে বারবার। এবারে সীমান্ত উত্তেজনা শুধু লাদাখে নয়, ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকের রাজ্য সিকিমের নাকুলাতেও। চিন-ভারতের সৈন্যরা গত মে মাসে এখানে হাতাহাতিও করেছে। বলাবাহুল্য প্যাংঅং লেক দিয়ে চিনের সেনাবাহিনী লাদাখ, শায়ক উপত্যকা, নুবরা ভেলি এমনকি শিয়াচেনে উপস্হিত হোতে পারবে যখন তখন। শুধু তাই নয় চিন দীর্ঘদিন ধরেই অতি দ্রুত ভারি সামরিক সরঞ্জাম ও যানবাহন পরিবহনের পথ তৈরী করে রেখেছে সুপরিকল্পিতভাবে। লাদাখের লাইন অব কন্ট্রোল ঘেষে শায়ক নদী বরাবরে ডিবিও পর্যন্ত ভারত যে রাস্তা বানিয়েছে সেটি শান্ত নদী গালোয়ানকে হটস্পট বানিয়ে ফেলেছে। চিনা সরকারি বার্তা মিডিয়া গ্লোবাল টাইমসে চেংডু ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট গবেষক ড. লঙজিংচুং বলছেন গালোয়ান উপত্যকা গোটাটাই চিনের ভোগদখলকৃত এলাকা, এখানে ভারত রাস্তা বানাবে কেন? উইলসন্স সেন্টারের এশিয়া প্রোগ্রামের ডেপুটি ডাইরেক্টর মাইকেল কুগিলম্যান মনে করেন ভারতের এই উসকানিমূলক পদক্ষেপ চিনকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। চিন তাই তার যুদ্ধের শক্তি ও সামর্থ দেখাতে চায় ভারতকে। এই রাস্তা বানিয়ে ভারত কি করতে চায়, তার লক্ষই বা কি? ভারত কি চিনের অভ্যন্তরে সৈন্য মার্চ করার সাহস রাখে? সম্প্রতি নেপাল যে নতুন ম্যাপের ঘোষণা দিয়েছে তাতে দেখা যায় ভারত নেপালের জায়গার উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করেছে, কেন? এসব সীমান্তে উত্তেজনার মূল শেকড়টিবা কোথায়?

গত বছর ৫ আগস্ট নয়াদিল্লির বিজেপি সরকার সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বাতিল করে কাশ্মিরকে দুটি জেলায় রুপান্তরিত করে। ভারত জম্মু ও কাশ্মিরকে তার দুটি জেলা ঘোষনা করে যে নতুন ম্যাপ বানিয়েছে যেখানে আকসাই চিন সহ লাদাখকে অন্তর্ভূক্ত করেছে যা চিনের দখলে। অতি সম্প্রতি নেতারা কথায় কথায় পাকিস্তান অধিকৃত আযাদ কাশ্মিরকে দখল করে নিতে চায়, হুমকিও দেয়। অথচ পাকিস্হান অধিকৃত কাশ্মিরের গিলগিট-বাল্টিস্হান এর মোট ০১ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৯৯% এবং আজাদ কাশ্মিরের ০২.৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার ১০০% মুসলমান। আবার এই অঞ্চল দিয়েই চিনের ৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থায়নে নির্মিত হোয়েছে কারাকোরাম হাইওয়ে এবং চায়না-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর যা পাকিস্তানের দক্ষিণ অংশের গোয়াডার সমুদ্র বন্দরকে সংযুক্ত করেছে। এই ১৮০০কিমি হাইওয়ে এবং গোয়াডার বন্দর চিনকে আরব সমুদ্রে যুক্ত করেছে যা সত্যিকার অর্থে চিনের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে বা কাচামাল আমদানিতে যথেষ্ট সহায়তা করছে।

(ম্যাপ দেখুন)

অন্যদিকে তিব্বতের পলাতক নেতা দালাইলামাকে ভারতে আশ্রয়দান, প্রবাসী সরকার গঠনে সহায়তাদান, চিনের বিরুদ্ধে ভারতের ইত্যাদি উস্কানিমূলক কর্মকান্ড চিন-ভারত সম্পর্ককে তিক্ত করে তুলেছে অনেক আগে থেকেই। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুতেই ভারত আকর্শিকভাবে চিনের পণ্য আমদানি বন্ধ করে চিনকে আর্থিক ক্ষতি ও বিব্রতকর অবস্হায় ফেলে দেয়।

চিন-ভারত সম্পর্ক এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেচে তাতে ভারতের সামনে দুটি পথ খোলা, হয় চিনের মতো করে আলোচনা অথবা বল প্রয়োগ- যেকোন একটি বেছে নিতেই হবে ভারতকে। একথা সত্য সামরিক শক্তির দিক থেকে চিন পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহৎ অবস্হানে এবং অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে চিন তার সামরিক শক্তি ব্যবহারে দ্বিধা করবে না। ইতিপূর্বে ভারত আকসাই চিন দাবী করাতেই চিন অরুনাচল প্রদেশ এবং আসামেরও কিছু অংশ দখল করে রেখেছিলো। আবার সিকিমকে ভারতের প্রদেশ মানতেও আপত্তি করেছিলো চিন। শুধু তাই নয় বর্তমান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অরুনাচল প্রদেশ সফরকে চিন সমালোচনাও করেছে। পক্ষান্তরে ভারতের সামরিক ও অর্থনৈতিক অবস্হা অন্ততঃপক্ষে চিনের সাথে টক্কর দেয়ার মতো নয়, চিনের সাথে যুদ্ধ করা এবং সে যুদ্ধে ভারতের জয়লাভ সুদূর পরাহত, দিবা স্বপ্ন মাত্র।

এইতো ২০১৭খ্রিঃ একইভাবে চিন ভারত মুখোমুখি দাড়িয়েছিলো ডোকালামে সেতো শুধু শুধু নয়। কারণ ডোকালামকে চিন-ভারত ও ভূটানের জংসন বলা যায়। চিন সেখানে একটি রাস্তা বানাতে গেলে ভূটান আপত্তি জানায়, ভারত ভূটানকে সমর্থন করে। কিন্ত চিন নাছোর বান্দা ছয়মাসের মধ্যে রাস্তা বানিয়ে ফেলে। পরে জানা গেলো চিন সেখানে একটি শক্ত সামর্থ স্হায়ী মিলিটারী বেজ বানিয়ে ফেলেছে।

অতএব আগামীতে কি কি হোতে যাচ্ছে? ব্যবসায়ী দেশ চিন বিনালাভে লোহা বহন করছে কি? সেনা মোতায়েন এবং মুভমেন্ট যথেষ্ট ব্যয়বহুর একটি কাজ। লাদাখের পূর্বদিকে আকসাই চিন অঞ্চলটির দাবীদার ভারত হোলেও দখলদার কিন্ত চিন। আর কৌশলগত দিক থেকে এ অঞ্চলটি বেইজিংয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিনের জিনঝিয়াং প্রদেশকে তিব্বতের পশ্চিমাংশের সাথে যুক্ত করে রেখেছে এই আকসাই চিন। ১৯৪৭ খ্রিঃ আগে অথবা পরে চিনের দখলে ছিলো এবং আছে আকসাই চিন ও শাক্যগাম উপত্যকা । চিন মনে করে আকসাই চিন গনপ্রজাতন্ত্রী চিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ অঞ্চলটি প্রিন্সলি স্টেট জম্মু ও কাশ্মিরের অংশ বৃটিশদের এ সিদ্ধান্ত চিন মানে না। ১৯৬৩খ্রিঃ চিন ও পাকিস্হান কারাকোরাম সেক্টরে তাদের যে সীমানা চিহ্নিত করেছে সেটাই চুড়ান্ত বলে মনে করে।

-রেজাউল করিম মুকুল

পঠিত : ৬০৯ বার

মন্তব্য: ০