Alapon

আল্লাহর একটি নাম 'আস শাকুর' এর পূর্ণাঙ্গ অর্থ...


আল্লাহ তায়ালা বলেন - لِيُوَفِّيَهُمْ أُجُورَهُمْ وَيَزِيدَهُم مِّن فَضْلِهِ ۚ إِنَّهُ غَفُورٌ شَكُورٌ - "যাতে তিনি তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিফল দান করেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, মহাগুণগ্রাহী।" (৩৫:৩০) আজ আমি আপনাদের সাথে আল কুরআনে বর্ণিত আল্লাহর একটি অনন্য এবং অসাধারণ নাম সম্পর্কে আলোচনা করবো। এই নামটি অনন্য কারণ আল্লাহ এই একই নাম তাঁর নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন আবার বিশ্বাসীদেরকেও এমন হতে বলেছেন। আল্লাহ আমাদের সম্পর্কে বলেছেন - وَقَلِيلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ - "এবং আমার বান্দাদের মধ্যে অল্পই শাকুর"। (৩৪:১৩) 'শাকুর' অর্থ - চরম কৃতজ্ঞ এবং চরম গুণগ্রাহী।(appreciative)

আর কৃতজ্ঞ হওয়া এবং গুণগ্রাহী হওয়া দুটি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। কৃতজ্ঞ মানে কেউ যদি আপনার কোনো উপকার করে, তাহলে আপনি তাকে 'থ্যাংক ইউ বা ধন্যবাদ' বলেন এবং মনে মনে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন। 'গুণগ্রাহী' মানে আপনি সবকিছুতে ইতিবাচকতা প্রত্যক্ষ করেন। সব পরিস্থিতিতেই আপনি ভালো কিছুর সন্ধান পেয়ে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতি খারাপ হলেও আপনি তাতে ভালো কিছু হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী থাকেন। আমাদের রাসূলুল্লাহ (স) এর জীবনে অন্যতম দুর্বিষহ একটি ঘটনা ছিল 'ইফকের ঘটনা', যখন মদীনাতে তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অপমানজনক অপবাদ রটনা করা হয়। আর এই মিথ্যা অপবাদ রটনার কাজ ত্রিশ দিন পর্যন্ত চলতে থাকে। ত্রিশ দিন পর আল্লাহ নাজিল করেন - لَا تَحْسَبُوهُ شَرًّا لَّكُم ۖ بَلْ هُوَ خَيْرٌ لَّكُمْ - "এটাকে তোমাদের জন্য ক্ষতিকর মনে কর না, বরং তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর।" (২৪:১১)

তো, এভাবে আল্লাহ আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করেন এবং তিনি চান আমরা যেন শাকুর হই। যার অর্থ চরম গুণগ্রাহী হওয়া, চরম তারিফ করা, আল্লাহর তারিফ করার জন্য উপায় খোঁজা, কৃতজ্ঞ হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করা। 'শাকুর' এর এই অর্থ আমাদের জন্য। আর আমাদের জন্য ব্যাপারটা উপলব্ধি করা সহজ। কিন্তু আল্লাহ, সবকিছুর মালিক নিজেকে 'শাকুর' বলেছেন। আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লা বলেছেন - إِن تُقْرِضُوا اللَّهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعِفْهُ لَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ۚ وَاللَّهُ شَكُورٌ حَلِيمٌ - "যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তিনি তা তোমাদের জন্য দ্বিগুন করে দিবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, পরম ধৈর্যশীল।" (৬৪:১৭) সূরা তাগাবুনের এই আয়াতে আল্লাহ নিজেকে 'শাকুর' বলেছেন। আর সূরা ফাতিরে তিনি নিজেকে দুইবার 'শাকুর' বলেছেন।

এখন আল্লাহ 'গুণগ্রাহী' হওয়ার মানে কী? শাকুরের যে আরেকটি অর্থ আছে 'কৃতজ্ঞ', সেটি আমরা আল্লাহর জন্য ব্যবহার করি না। আমরা আল্লাহ আজ্জা ওয়া জাল্লার জন্য শাকুরের অর্থ হিসেবে 'গুণগ্রাহী (appreciative)' শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেছেন তিনি চরম গুণগ্রাহী।তাই, আমি আপনাদের সবার জন্য বিষয়টি সহজ করে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। যেন আমরা এখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি এবং বুঝতে পারি আল্লাহ কেন আমাদের জন্য এমন একটি শব্দ ব্যবহার করলেন - যে গুণটি আমাদের থাকতে হবে - যা তিনি তাঁর নিজের নাম হিসেবেও ব্যবহার করেছেন।

আমাদের কোন কিছুই আল্লাহর প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমরা আমাদের সবকিছুর জন্য আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আল্লাহ হলেন 'গানী' তিনি সবধরনের প্রয়োজন থেকে মুক্ত। তিনি হলেন 'হামিদ।' কেউ তাঁর প্রশংসা না করলেও, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করলেও - তিনি নিজে নিজেই প্রশংসিত। কোন কিছুর অস্তিত্ব না থাকলেও আল্লাহর প্রশংসা এবং কৃতজ্ঞতা এমনিতেই বর্তমান আছে। তদুপরি, আমাদের যা কিছু রয়েছে - وَآتَاكُم مِّن كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ - “যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন।”(14:34) - তোমাদের যা কিছুর প্রয়োজন হত তার সবকিছুই আল্লাহ তোমাদের দিয়েছেন। এটা আমাদের উপর আল্লাহর দাবী। আমরা প্রতিনিয়ত তাঁর নিকট কৃতজ্ঞতার ঋণে আবদ্ধ।

আমাদের সম্ভাব্য প্রতিটি প্রয়োজন তিনি পূর্ণ করেছেন এবং এতো অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন যে আমরা কোনদিনও তার ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হব না। যেমন, নিঃশ্বাস নেয়ার ক্ষমতা। এই কক্ষে উপবিষ্ট সবার দিকে তাকিয়ে দেখুন, আমাদের প্রায় সবাইকে দৃষ্টি শক্তি প্রদান করা হয়েছে, আমাদের সবারই উঠে দাঁড়ানোর এবং চলাফেরা করার ক্ষমতা রয়েছে। এই পৃথিবীতে এমন বহু মানুষ রয়েছে যারা দাঁড়াতে পারে না, হাঁটতে পারে না। আমরা যে ঘুমাতে পারি এটাকে আমরা কোন নিয়ামতই মনে করি না। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণার কারণে নিদ্রাহীন রাত কাটায়। আমাদের হাতের আঙ্গুলগুলোকেও আমরা কিছুই মনে করি না। মনে হয় যেন আমরা এগুলোর মালিক। এমন অনেক মানুষ রয়েছে যাদের হাত নেই বা প্যারালিসিস এর কারণে হাত নাড়াতে পারে না। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখ ছাড়া আর কিছুই নাড়াতে পারে না, বা বাসায় পড়ে রয়েছে।

ব্যাপারটা হল, এই পৃথিবীতে আমাদের যা কিছু আছে তার সবই মূল্যবান। আর আমরা মূল্য নির্ধারণ করি টাকার অংকে। এখন কেউ যদি বলে, "আপনার পা কিনতে চাই, মূল্য কত? আপনার উভয় চোখ কত টাকা মূল্যে বিক্রি করবেন? আপনার ফুসফুস কিনতে চাই। আপনার পা কিনতে চাই, শুধু একটা, শুধু একটা কিনতে চাই। আমার উভয়টার দরকার নেই।".... আল্লাহর দেয়া এই মহামূল্যবান উপহারগুলো আমরা প্রতিদিন ব্যবহার করে চলছি। প্রতিনিয়ত কোন কিছু ব্যবহার করতে থাকলে আমাদের কাছে তার মূল্য কমে যায়। "এটা আর এমন কি, জাস্ট একটা পায়ের পাতা।" আবার অভিযোগ করি, এটা খালি চুলকায়। smile তো, আমরা এই মহামূল্যবান উপহারগুলো যেমন, আমাদের শরীর, আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, আমাদের পরিবার, বাতাস, ভূমি যার উপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি... আচ্ছা কোন কারণে ভূমিকম্প হচ্ছে না?

পৃথিবী সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আপনাদের বলছি। আল্লাহ পৃথিবীকে তৈরি করেছেন তাঁর অনুগত করে। আর যারা আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পিত তারা কখনো আল্লাহর অবাধ্যতা সহ্য করতে পারে না। মনোযোগ দিয়ে শুনুন। যা কিছুই আল্লাহর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে তার নিকট আল্লাহর অবাধ্যতা অসহনীয়। আর পৃথিবীর উপর বিচরণকারী মানব সম্প্রদায় আল্লাহর অবাধ্যতা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। সত্য কিনা? হ্যাঁ, সত্য। আর যখন তারা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয় তখন পৃথিবী তাদের চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে চায়। পৃথিবী ঐ সব মানুষদের ধ্বংস করতে চায় যারা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত, কারণ তার নিকট আল্লাহর অবাধ্যতা অসহনীয়। আল্লাহ বর্ণনা করেন, প্রতিবার যখন কেউ বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন - تَكَادُ السَّمَاوَاتُ يَتَفَطَّرْنَ مِنْهُ وَتَنشَقُّ الْأَرْضُ وَتَخِرُّ الْجِبَالُ هَدًّا - “এতে আসমানসমূহ ফেটে পড়ার, যমীন বিদীর্ণ হওয়ার এবং পাহাড়সমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হবে।” (19:90) এতে সাত আসমান ফেটে পড়ার উপক্রম হয়, যখন কেউ বলে আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তারা এমন জঘন্য কথা সহ্য করতে পারে না। পৃথিবীও খন্ড-বিখন্ড হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়, যখন কেউ এমন পাপপূর্ণ কথা উচ্চারণ করে।

আর এই যমীন মানব জাতির অসংখ্য পাপ সহ্য করে যাচ্ছে প্রতিদিন। সব কিছু চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়ার জন্য এটি আল্লাহর কাছে অনুমতি ভিক্ষা করতে থাকে। আর আল্লাহ একে থামিয়ে রাখেন। পরিশেষে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ পৃথিবীকে অনুমতি প্রদান করবেন, আদেশ নয়। “বি আন্না রাব্বাকা আওহা-লাহা ” আল্লাহ একে অনুমতি দিবেন যেন এতদিন যাবত সে তার ভেতরে যত যাতনা বহন করে চলছিল তা উগড়ে ফেলতে পারে। এতোসব পাপ নিয়ে আমরা যখন পৃথিবীর উপর দিয়ে চলতে থাকি, এটি যে কম্পন সৃষ্টি করে আমাদের ধ্বংস করে না তার জন্য আমরা কতটুকু কৃতজ্ঞ? কতটুকু কৃতজ্ঞ? আমাদের প্রতি আল্লাহর নিয়ামত গুণে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ আমাদের যে অসংখ্য অগণিত উপহার দান করেছেন তা আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতার বাহিরে।

এই জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কৃতজ্ঞ মানুষের কথা মনে করুন। এ ক্ষেত্রে আমার মনে পড়ে ইব্রাহিম (আঃ) এর কথা। ইব্রাহিম (আঃ) এর গোটা জিন্দেগী ছিল আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার জিন্দেগী। জানেন, আল্লাহ কীভাবে তাঁর সমগ্র জীবনকে বর্ণনা করেছেন? তিনি বলেন - شَاكِرًا لِّأَنْعُمِهِ - তিনি শুধু অল্প কিছু অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে পেরেছিলেন। ''আনউম'' ব্যবহার করা হয় অল্প কিছু অনুগ্রহের জন্য। আর "নিয়াম" শব্দটি ব্যবহার করা হয় অনেক বেশি নেয়ামতের জন্য।

অর্থাৎ, আল্লাহর অসাধারণ একজন দাস ইব্রাহিম (আ) এর মত ব্যক্তিও যদি তার সমগ্র জীবন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ব্যয় করেন, তিনি শুধু সামান্য কয়েকটি নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারবেন। আল্লাহ তাঁকে যত কিছু দিয়েছেন তার তুলনায়। এরপর তিনি বলেন- (وَإِن تَعُدُّوا نِعْمَةَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا) যদি তোমরা আল্লাহর শুধু একটি অনুগ্রহ পুরোপুরি উপলব্ধির চেষ্টা কর, তোমরা সম্পূর্ণরূপে এটি গণনা করতে সমর্থ হবে না। (16:18) আল্লাহর সকল অনুগ্রহ নয়, শুধু একটি অনুগ্রহ - নে'মাতাল্লাহ (একবচন)। লা তুহসুওহা- গণনা করে শেষ করতে পারবে না। উদাহরণস্বরূপঃ চিন্তা করার সামর্থ্য, এটি শুধু একটি অনুগ্রহ। আল্লাহর এই একটি অনুগ্রহ প্রতিদিন, প্রতি মিনিটে কতভাবে আমার উপকার করে!! আমি আল্লাহর শুধু একটি অনুগ্রহের উপকার গণনা করে শেষ করতে পারব না। কীভাবে আমি আমার প্রতি তাঁর প্রদত্ত সকল অনুগ্রহের শুকরিয়া আদায় করবো??

আমাদের প্রতি আল্লাহর 'য-হেরা' বা প্রকাশ্য অনুগ্রহ যেমন আছে তেমনি আছে 'বা-তিনাহ' বা গোপন অনুগ্রহ। তিনি বলেন - (وَ اَسۡبَغَ عَلَیۡکُمۡ نِعَمَہٗ ظَاہِرَۃً وَّ بَاطِنَۃً - এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নি‘য়ামাতসমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। ৩১:২০) তিনি আমাদের প্রতি অগণন প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য অনুগ্রহ বর্ষণ করেছেন।

কতজন মানুষ উপলব্ধি করে যখন তারা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে বের হয় তখন আল্লাহ গাড়ির সামনে এবং পেছনে প্রতিরক্ষক ফেরেশতা পাঠিয়ে এর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন? যেন আপনি নিরাপদে বাসায় পৌঁছতে পারেন। আপনার গাড়ি যে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়েনি, ব্রেক ভালভাবে কাজ করার কারণে এমনটি হয়নি, আপনার গাড়ি রাস্তায় টিকে আছে কারণ আল্লাহ গার্ডিয়ান ফেরেশতা পাঠিয়ে এর সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কতজন মানুষ এটা উপলব্ধি করে? আমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ এতো অসংখ্য এবং অগণিত পরিমাণ যে, আমরা যদি প্রতি নিঃশ্বাসে শুকরিয়া আদায় করি তবু সামান্য কিছু নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা আদায় করতেও সমর্থ হব না।

- উস্তাদ নোমান আলী খান

পঠিত : ৪৯৮ বার

মন্তব্য: ০