Alapon

নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, একটি ইতিহাসের নাম...


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ঘাটতে গেলেই সর্বাগ্রে দেখা যায় একজন মানুষের নাম, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। নবার স্যার সলিমুল্লাহ ভূমিকার কারণেই এই তিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সম্ভব হয়েছে এবং সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক।

৭ জুন আজকের এই দিনেই পৃথিবীতে এসেছিলেন উপমহাদেশের মুসলিমদের মুক্তি আন্দোলনের অগ্র পথিক নবার স্যার সলিমুল্লাহ। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ১৮৬৬ সালের ৭ জুন ঢাকার আহসান মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন নবাব আহসানউল্লাহর জেষ্ঠ পুত্র।


ছবি: আহসান মঞ্জিল

স্যার সলিমুল্লাহর বেড়ে ওঠা

নবাবি পরিবারের নিয়মনুসারে শিশু সলিমুল্লাহর পড়াশোনা শুরু হয়। গৃহ শিক্ষকের কাছেই তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। নবাবের পরিবারে আর সবার মত তাঁকে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরবি, ফার্সী ও উর্দু ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। পড়াশোনা শেষ করে সলিমুল্লাহ সাহেব ডেপুটি মেজিষ্ট্রেট হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। ১৮৯৩-১৮৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি ডেপুটি মেজিষ্ট্রেট হিসেবে চাকরি করেন। তারপর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ময়মনসিংহে ব্যবসা করেন। এর কিছুদিন পর নবাব আহসানউল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে তার সেই ব্যবসাও বন্ধ করে দিতে হয়। তারপর নবাব আহসানউল্লাহর মৃত্যুর পর জেষ্ঠপুত্র হিসেবে নবাবি স্টেটের দায়িত্ব গ্রহণ করে সলিমুলল্লাহ সাহেব। আর এভাবেই তিনি হয়ে উঠেন নবাব সলিমুল্লাহ।

শিক্ষা বিস্তারে নবাব সলিমুল্লাহর ভূমিকা

নবাব সলিমুল্লাহ দায়িত্বভার গ্রহণ করার সাথে সাথে শিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। তিনি উপলব্ধি করেন এই জাতির মুক্তির জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। শিক্ষা ব্যতিরেখে এই জাতি কখনোই নিজের ভালো উপলদ্ধি করতে পারবে, আর কোনো স্বাধীনতার সুখও উপলবদ্ধি করতে পারবে না। সেই লক্ষ্যে নবাব ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেই নৈশ বিদ্যালয়গুলোতে খেটে খাওয়া মানুষদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করা হতো। এরপর নবাব শিশুদের শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করেন। নবাব বিশ্বাস করতেন নৈতিকতাবিহীন শিক্ষা আদৌত কোনো শিক্ষা হতে পারে না। তাকে পূর্নাঙ্গ শিক্ষা বলা যায় না। তাই নবাব মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসারেও ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আলীগড় কলেজের অনুকরণে বাংলার মুসলমান ছাত্রদের জন্য প্রথম বারের মতো ঢাকায় একটি মুসলিম হল নির্মাণের জন্য নবাব সলিমুল্লাহ ১,৮৬,৯০০ শত টাকা দান করেন। ঢাকা মাদ্রাসার ছাত্রাবাসের জন্য তিনি লক্ষাধিক টাকা দান করেন। বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসায় অকাতরে অর্থ অনুদান দিয়ে তিনি নিঃস্ব হয়েছেন। শিক্ষা খাতে দান অব্যাহত রাখতে নিজের জমিদারী বন্ধক রেখে অর্থ নিয়েছেন এবং অবশিষ্ট জমিদারী গচ্ছিত রেখে ব্রিটিশ সরকার থেকে ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা কর্জ করেছেন, যা তিনি মৃত্যু পর্যন্ত পরিশোধ করতে পারেননি। এভাবেই নবাব খাজা সলিমুল্লাহর হাত ধরে বাংলার মানুষ আলোর পথে হাটতে শুরু করে।

রাজনীতিতে নবাব

১৯০৩-০৪ সালে বঙ্গভঙ্গের বিষয়ে মতামত প্রদান করতে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়েন নবাব সলিমুল্লাহ। ১৯০৪ সালের ১১ জানুয়ারি পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দকে নিয়ে আহসান মঞ্জিলে এক সভা করে সরকারের বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনার কিছু বিষয় বিরোধিতা করেন। তিনি পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের সুবিধার্থে ঢাকায় রাজধানী করে বৃহত্তর প্রদেশ গঠনের এক বিকল্প প্রস্তাবও দেন। ভাইসরয় লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ১৯০৪ সালের ১৮-১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর আতিথ্য গ্রহণ করেন। ওই সময় তাঁদের মধ্যে আলোচনার ফলে বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আসে। এরপর ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গবিভাগ কার্যকর হলে ঢাকা নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের রাজধানী হয়। এছাড়াও ব্যবসায়িক খরচ কমাতে ততকালীণ ইংরেজ সরকার বিকল্প পথ খুঁজছিল। নবাব বড় লাটকে বুঝিয়ে বলেন যে, বিকল্প পথ হিসেবে চট্টগ্রামের সমুদ্র বন্দর হতে পারে সবচেয়ে উত্তম। নবাবের এই প্রস্তাবে খুশি হন বড় লাট। তারপর চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে মালা আনা নেওয়া করলে চট্টগ্রামের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হতে শুরু করে। কিন্তু কংগ্রেসের অন্যায় দাবির কাছে বঙ্গভঙ্গ রথ হয়ে যায় এবং বাংলার মানুষের ভাগ্যে আবারও কালো অমানিষা নেমে আসে। ১৯১১ সালের ১৯ আগস্ট কার্জন হল-এ পূর্ববঙ্গের ছোটলাট ল্যান্সলট হেয়ার-এর বিদায় এবং বেইলী-এর স্বাগত অনুষ্ঠানে নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। কথিত রয়েছে বর্তমানে যে স্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় দাড়িয়ে রয়েছে তা নবাব সলিমুল্লাহরই দান করা জমি।

পরিশেষে

পরিশেষে শুধু এতোটুকু বলব, যে মানুষ বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য এতো কিছু করে গেলেন, আজ তাকেই আমরা ভুলতে বসেছি। এমনকি যার উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করল সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও নবাবকে ভুলতে বসেছে। অথচ শিকড় ভুলে গেলে যে জাতির অস্তিত্ত্বই বিলিন হয়ে যায়, তা বর্তমান সময়ের বুদ্ধিজীবিরা উপলব্ধি করেন কিনা- তা আমার জানা নেই। তবে নবাব খাজা সলিমুল্লাহ এখনো বাংলার আপামর জনতার মাঝে বেঁচে আছেন। নবাব খাজা সলিমুল্লাহ শত জন্ম বার্ষিকী ঘটা করে পালন করা না হলেও তিনি মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন। কারণ, তিনি যে কেবল নিস্বার্থভাবে মানুষের মাঝে বিলিয়েই গেছেন। প্রতিদান নেওয়ার আগে অকালে এই বাংলার মানুষের জন্যই জীবন বিলিয়ে গেছেন। এই মহান শিক্ষানুরাগীকে জানাই হাজার সালাম, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

পঠিত : ১০৬৫ বার

মন্তব্য: ০