Alapon

খেয়াল করে দেখুন, আমরা বাংলাদেশিরাও বর্ণবাদি...


এই করোনা কালীণ সংকটময় পরিস্থিতিতেও আমেরিকাতে বিশাল আন্দোলন চলছে। বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন। সেই আন্দোলন এখন আর শুধু আমেরিকার ভূখন্ডেই সীমাবদ্ধ নেই। তা ইউরোপ আফ্রিকা থেকে এই উপমহাদেশেও এসে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশেও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কিছু মানুষ কথা বলছেন। ফ্রয়েডের আত্মত্যাগ এবং আমেরিকায় বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ম্যালকম এক্সের বিভিন্ন ভূমিকা নিয়ে ভূয়সি প্রশংসা করছেন। আমরা উপমহাদেশিয়রা অথবা বাংলাদেশিরা ভাবছি, বর্ণবাদ কেবল ইউরোপে অথবা আফ্রিকাতেই ঘটে। বাংলাদেশে বর্ণবাদ নেই। এমনটা মনে করাটা মানুষের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। মানুষ কখনোই নিজের দোষটা দেখতে পারে না, আমিও পারি না। তাই আমরা সর্বদা অন্যের দোষ নিয়ে সমালোচনা করতে পছন্দ করি এবং বিজ্ঞ বিজ্ঞ কথা বলি। কিন্তু আমি বা আমরাও যে বর্ণবাদি কর্মকান্ডে দুষ্ট তা কখনো উপলব্ধিই করতে পারি না।

প্রথম ঘটনা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ক্রিকেটার রুবেল হোসেনকে নিশ্চয়ই চেনেন। আমাদের এলাকায় রুবেল হোসেনকে গরু চোর বলে ডাকা হয়। হয়তো আমিও তাকে বেশ কয়েকবার গরু চোর বলে সম্বোধন করেছি। তাকে গরু চোর বলার কারণ কি জানেন, তার গায়ের রং! তার গায়ের রং তুলনামূলক বেশি কালো হওয়ার কারণেই আমরা তাকে গরু চোর বলে ডাকি। আবার কেউ কাউয়া বলেও ডাকে। এমন ঘটনাও ঘটতে শুনেছি, রুবেল হোসেন বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করছে আর দর্শকরা গ্যালারি থেকে কাউয়া কাউয়া বলে চিৎকার করছে। এগুলোও বর্ণবাদি আচরণ! আর এই আচরণ থেকে আমরা বাঙালিরা মুক্ত নই।



ছবি: ক্রিকেটার রুবেল হোসেন

দ্বিতীয় ঘটনা। এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমুর কথা আপনাদের মনে আছে কি? নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা। তিনি নিজের অভিনয় প্রতিভা দিয়ে মানুষের মনে জয় করে নিয়েছেন সত্যি। সেই সাথে তাকে আরও একটি কারণে মনে রাখার কথা। অবশ্য সেই কারণটা আমাদের জন্য লজ্জার। তার স্বামীর কারণে বাংলার মানুষের সুমাইয়া শিমু এবং তার স্বামীর কথা খুব ভালো ভাবেই মনে রাখার কথা।

২০১৫ সালের আগস্টে সুমাইয়া শিমু নাসিরউদ্দিন নাসিম নামে এক ব্যবসায়ীকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাদের কাপল ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করার সাথে সাথে চারদিকে ছি...ছি... রব উঠতে শুরু করে। কারণ, সুমাইয়া শিমুর বর নাসিরউদ্দিন নাসিম দেখতে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি কালো। তাই সুমাইয়া শিমুর মত একজন সুন্দরী অভিনেত্রীর সাথে এই কালো মানুষটা কোনোভাবেই মানান সই হতে পারে না। আর এটা নিয়ে সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমত ট্রল করতে শুরু করে। এটাও রেসিজম। এটাও বর্ণবাদ। বাংলাদেশেও এমন নিকৃষ্ট বর্ণবাদের আবাদ বিদ্যমান রয়েছে।



ছবি: অভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু এবং তার স্বামীর যুগলবন্দি ছবি।

আর একটা বিষয় বলেই আজকের মত আলোচনা শেষ করছি। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যবহৃত মিডিয়া হাউজগুলো কি বর্ণবাদ থেকে মুক্ত?
এক জরিপে দেখা গেছে, মিডিয়া হাউজেই বর্ণবাদের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে। প্রিন্ট মিডিয়ায় তারপরও নারীরা বর্ণবাদের তেমন একটা মুখোমুখি না হলেও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নারীরা পদে পদে বর্ণবাদের স্বীকার হচ্ছে। আপনি টেলিভিশনের উপস্থাপিকার মধ্যে একজনকেও পাবেন না, যার গায়ের রং কালো অথবা শ্যামলা। শ্যামলা হলে তাকে মেকাপ রুমে নিয়ে ডিসটেম্পার মেরে সাদা বানানো হচ্ছে। এটাও বর্ণবাদি আচরণ। সর্বোপরি মিডিয়ায় যে ‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’ প্রসাধনীর বিজ্ঞাপন দেখানো হয়, তা সম্পূর্ণভাবেই একটি বর্ণবাদি বিজ্ঞাপন। তাহলে দেখা যাচ্ছে সরিষার মাঝেই ভূত।

পরিশেষে জিম্বাবুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের একটি উক্তি দিয়ে শেষ করছি,

‘বর্ণবাদ তত দিন থাকবে, যত দিন সাদা গাড়িগুলোর চাকা কালোই থাকবে। দুর্ভাগ্য বোঝাতে কালো, আর শান্তি বোঝাতে সাদার ব্যবহার যত দিন থাকবে, তত দিন থাকবে বর্ণবাদ। বিয়ের পোশাক সাদা, আর শবযাত্রায় কালো পোশাকের চল যত দিন থাকবে, তত দিন থাকবে বর্ণবাদ। করখেলাপি বা মন্দ লোকেদের যত দিন সাদা নয়, কালোতালিকাভুক্ত করা হবে, তত দিন বর্ণবাদ থাকবে। এমনকি স্নুকার খেলায়ও কালো বলটিকে গর্তে না ফেলা পর্যন্ত কেউ জিততে পারে না, আর সাদা বলটিকে বরাবর টেবিলের ওপরই থাকতে হয়।’

পঠিত : ৪৩৯ বার

মন্তব্য: ০