Alapon

লিবিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বিষফোঁড়া আমিরাতের বিপর্যয়...


বিগত কয়েক দিনে লিবিয়ান গৃহযুদ্ধের শক্তি ভারসাম্যে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। ত্রিপলিকেন্দ্রিক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার বা জিএনএ বাহিনী বিরাট অগ্রগতি অর্জন করেছে। এক বছরের চেয়ে বেশি সময় ধরে রাজধানী অবরোধকারী যুদ্ধবাজ হাফতারের বাহিনীকে তাড়িয়ে তারা সম্পূর্ণ ত্রিপলি ও মিটিগা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পুনরুদ্ধার করেছে। তারপর তারা যুদ্ধবাজ হাফতারের শক্ত ঘাঁটি তারহুনা ও বনি ওয়ালিদ দখল করে নেয়। বর্তমানে জিএনএ বাহিনী সারাত ও জুফরা ঘাঁটি অভিমুখে অগ্রসরমান। ইতোপূর্বে তারা হাফতার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ হতে কেড়ে নিয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাঁটি ওয়াতিয়া।
লিবিয়ার দীর্ঘ দিনের শাসক মুআম্মার আল-গাদ্দাফির পতনের পর দ্রুতই তেলসমৃদ্ধ দেশটিতে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তারপর বহু রক্তপাত ও বিভক্তি পর 2015 সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘের উদ্যোগে গবর্মেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড (জিএনএ) বা জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয়। কিন্তু বেশিদিন যেতে না যেতেই পূর্বাঞ্চলে বেনগাজিকেন্দ্রিক একটি বিরোধী গ্রুপ সৃষ্টি হয়, গাদ্দাফির সাবেক কমান্ডার ফিল্ড মার্শাল খলিফা হাফতারের নেতৃত্বে তারা স্বঘোষিত সরকার প্রতিষ্ঠা করে গোলযোগপূর্ণ পূর্বাঞ্চলের বহু অঞ্চল দখল করে নেয়।

হাফতারের নেতৃত্বে গঠিত অবৈধ সরকার মধ্যপ্রাচ্যের কিছু সরকার হতে বিপুল সহায়তা লাভ করে। দেশগুলো হল মিশর, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত। এই চক্রটি কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় স্বীকৃত ঐকমত্যের সরকার বা জিএনএ বিরোধী, তা সহজেই অনুমেয়। জিএনএ-তে লিবিয়ার প্রায় সকল দলের অংশগ্রহণ রয়েছে, যাদের মাঝে ইসলামপন্থি দলও আছে। তবে জিএনএ-এর প্রধানমন্ত্রী ফায়েস আম-সাররাজ ব্রাদারহুড সদস্য নন, শুধু তাই নয়, ব্রাদারহুড লিবিয়ায় খুব একটা শক্তিশালীও নয়। তবুও মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরত্রয়ী জিএনএ এর বিরুদ্ধে খলিফা হাফতারকে সমর্থন দেয়। বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছেন, তা হল জিএনএ সরকারে বহু দলের অংশগ্রহণ থাকায় এটি লিবিয়ার গণতান্ত্রিক উত্তরণে ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ওই ত্রয়ীর চোখে রাজনৈতিক ইসলাম যেমন ঘৃণিত, তারচেয়ে বেশি আপত্তির বিষয় হল যে কোন ধরণের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা।

লিবিয়ার ইসলামপন্থা ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরচক্রের তিন সদস্যের ভূমিকা সমান নয়। 2019 সালের মার্চে খলিফা হাফতার রিয়াদ সফর করে। তারপর এপ্রিল মাসে ত্রিপলি আক্রমণ করে। এটা সহজেই অনুমেয় যে, ওই সফরে হাফতার বিপুল অর্থলাভে ধন্য হয়েছিল। লিবিয়ার সাথে বিস্তৃত সীমানা থাকায় মিশরের পক্ষে হাফতারকে অস্ত্র ও জনবল দিয়ে সহায়তা করা সহজ।

তবে লিবিয়ায় গণতন্ত্র ও জিএনএ সরকারের ব্যর্থ করে দেয়ার মূল প্রজেক্ট আরব আমিরাতের। আরো নির্দিষ্ট করে বললে আমিরাতের যুবরাজ এমবিজেড তথা মুহাম্মদ বিন যায়েদের। তিনি পুরো প্রক্রিয়াটিতে দেখভাল করেন। লিবিয়ার আলখাদিমে বিমানঘাঁটি স্থাপন করা, হাফতারকে চাইনিজ ড্রোন ও রাশিয়ান এয়ার ডিফেন্স সরবরাহসহ সব প্রকারের সামরিক ও আর্থিক সহায়তা কর্মকাণ্ড সমন্বয় করে আরব আমিরাত। এমনকি, রাশিয়ান কোম্পানি ওয়াগনার খলিফা হাফতারকে যে ভাড়াটে সৈনিক সরবরাহ করে, তাও যোগাড় করে দেয় আমিরাত। কোম্পাটির মধ্যপ্রাচ্যঅফিস আমিরাতে অবস্থিত। 2011 সাল থেকে লিবিয়ার ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে। সেটি এড়ানোর জন্য আরব আমিরাত কাজাখাস্তান ও ইউক্রেনের কিছু ভুয়া এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে এয়ারলিফট তৈরী করে লিবিয়ার অস্ত্র পাঠায়।

প্রশ্ন হল: লিবিয়া আরব আমিরাত হতে বহু দূরে। সেখানে কেন সে এক যুদ্ধবাজকে ক্ষমতায় বসিয়ে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চায়? এ প্রশ্নের আপাত উত্তর হল যে কোন প্রকারের গণতান্ত্রিক উত্তরণের বিরুদ্ধে আরব আমিরাত। জিএনএ সরকারে বহু দলের অংশগ্রহণ রয়েছে এবং চুক্তি অনুসারে এটি গণতান্ত্রিক উত্তরণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে কোন প্রচেষ্টাকে সন্ত্রাসবাদের সাথে তুলনা করে। ওই দেশের মন্ত্রীদের কথায় বুঝা যায়, তারা মিছিল-মিটিং-কে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে গণ্য করে। তাছাড়া জিএনএ সরকারে ইসলামপন্থি দল রয়েছে। যদিও ওই দলের ভূমিকা খুবই নগন্য, তবুও আরব আমিরাত রাজনৈতিক ইসলামের ছিটেফোঁটাও সহ্য করতে প্রস্তুত নয়। অতএব যুদ্ধবাজ খলিফা হাফতারকে ক্ষমতায় বসানো গেলে গণতন্ত্র ও ইসলামি রাজনৈতিক শক্তি, দুটোকেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আমিরাত কেবল লিবিয়ায় নাক গলাচ্ছে, এমন নয়। তারা ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদির সহযোগী। তবে সৌদির সাথে তাদের সহাবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা সন্দেহ। কারণ দক্ষিণ ইয়েমেনের এডেনে তারা সৌদির সাথে সমন্বয় না করে ট্রানজিশনাল কাউন্সিল নামে একটি নতুন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির পৃষ্ঠপোষকতা করছে। লিবিয়া ছাড়িয়ে তিউনিসিয়ার সরকারকেও ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য সম্প্রতি ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে নেমেছে আমিরাত। এর একটি কারণ তো পরিস্কার, তিউনিসিয়ায় সাফল্যজনকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা চলছে, যা আরব বিশ্বের জন্য ব্যতিক্রমী কারবার। ওই দেশের প্রেসিডেন্ট কায়স সুয়াইয়াদ অবশ্য ইসলামপন্থি নয়; তবে পার্লামেন্টে বেশি আসনের মালিক আল-নাহদাপ্রধান রশিদ ঘান্নুশি স্পীকারের দায়িত্বে আছেন। অতএব ওই সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য আর কোন কারণের দরকার নেই। আমিরাত কেবল রাজনৈতিক ইসলাম ও গণতন্ত্রের শত্রু, এমন নয়। বিশ্ব মুসলিমের স্বার্থ তাদের কাছে চরমভাবে উপেক্ষিত। একথার প্রমাণ হল, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাদানকারী সংবিধানের 370 ধারা অবলুপ্ত করার অব্যবহিত পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে আরব আমিরাতের সর্বোচ্চ পদক প্রদান করা।

এক সময় আমরা ইসরাইলকে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া বলে জানতাম। ইহুদি রাষ্ট্রটির সাথে আরব দেশগুলোর টুকাটুকি লেগেই থাকত। বর্তমানে ফিলিস্তিন ছাড়া অন্য কোন দেশের সাথে ইসরাইলের কোন সমস্যা আছে বলে জানা যায় না। অপরদিকে মধ্যপ্রাচ্যের নানাপ্রান্তে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি সোল এজেন্সি নিয়েছে আরব আমিরাত। অর্থাৎ বিষফোঁড়ার দায়িত্ব পালনে ইসরাইলি অব্যহতির অভাব পূরণে এগিয়ে এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের নব্য বিষফোঁড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত। আর ওই অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ, যারা ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক খেলায় ক্লান্ত, তারা যুদ্ধবাজ হাফতারের পরাজয়কে নয়া বিষফোঁড়ার বিপর্যয় হিসেবে দেখতে চাইবে।

- জুবায়ের এহসান হক

পঠিত : ৫১৩ বার

মন্তব্য: ০