Alapon

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সাতকাহন



শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের রাজনীতি শুরু হয় মুসলিম লীগের হাত ধরে। তিনি মুসলিম লীগের তারকা নেতা। কিন্তু উপমহাদেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধেই নির্বাচন করেন। নির্বাচনে ভালো ফলাফল করে সরকার গঠন করেন এবং আবারো পুরনো দল মুসলিম লীগের হয়ে কাজ করেন। এটা কেন? এর উত্তর তালাশের চেষ্টা করবো আমরা।

‘শেরে বাংলা’ বা হক সাহেব রূপে পরিচিত আবুল কাশেম ফজলুল হক বাকেরগঞ্জ জেলার সাটুরিয়ায় ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তবে তাঁর পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিল বরিশাল শহর থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে চাখার গ্রামে। তিনি ছিলেন মুহম্মদ ওয়াজিদ ও সায়িদুন্নিসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। হক সাহেবের পিতা বরিশাল আদালতের দীউয়ানি ও ফৌজদারি উকিল ছিলেন এবং তাঁর পিতামহ কাজী আকরাম আলী ছিলেন আরবি ও ফারসিতে দক্ষ পন্ডিত ও বরিশালের একজন বিশিষ্ট মোক্তার।

এ.কে ফজলুল হক ১৮৯০ সালে ফজলুল হক বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯২ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ এবং ১৮৯৪ সালে বি.এ পরীক্ষায় (রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ) উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গণিত শাস্ত্রে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৮৯৭ সালে কলকাতার ‘ইউনিভার্সিটি ল কলেজ’ থেকে বি.এল ডিগ্রি লাভ করে ফজলুল হক আশুতোষ মুখার্জীর অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। পিতার মৃত্যুর পর হক বরিশাল শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৩-১৯০৪ সময়কালে তিনি এ শহরের রাজচন্দ্র কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। ১৯০৬ সালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ফজলুল হক সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত হক ছিলেন সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার। এরপর সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর আইনপেশায় আত্মনিয়োগ করেন।

ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ও টাঙ্গাইলের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর কাছে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়। তাঁদের সহযোগিতায় ১৯১৩ সালে তিনি তাঁর শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্রকে পরাজিত করে ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৩ সালে হক বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক হন এবং ১৯১৬ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক রূপেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত ফজলুল হক ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি।

হক সাহেব একইসাথে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য রূপে তিনি সে সংগঠনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে ১৯১৬ সালে লক্ষ্মৌ চুক্তি প্রণয়নে সহায়কদের অন্যতম। ১৯১৭ সালে হক ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের যুগ্ম সম্পাদক এবং ১৯১৮-১৯১৯ সালে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রূপে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯১৯ সালে হক খিলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন। কিন্তু অসহযোগের প্রশ্নে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল।

১৯২০ সালে কংগ্রেস-গৃহীত অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত ব্রিটিশ পণ্য ও উপাধি বর্জনের তিনি সমর্থন করেন। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের পশ্চাৎপদ অবস্থার কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করে তিনি স্কুল ও কলেজ বর্জনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিলেন। বর্জনের সিদ্ধান্ত মুসলমান ছেলেমেয়েদের অগ্রগতিতে বাধার সৃষ্টি করবে এটা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। এই ইস্যুতে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ১৯২০ সালে ফজলুল হক, কাজী নজরুল ইসলাম ও মুজাফ্ফর আহমদ মিলে নবযুগ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর সরকারবিরোধী নীতির কারণে এ পত্রিকার জামানত বহুবারই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ফলে দীর্ঘদিনব্যাপী এ দৈনিক পত্রিকা চালানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।

সর্বভারতীয় রাজনীতিতে হক অংশগ্রহণ করলেও তাঁর মনোযোগ প্রধানত বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৩৪ সালে এম.এ জিন্নাহ্ সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি হন। মুসলিম লীগের কর্মসূচিতে হক খুশি ছিলেন না। জিন্নাহর সঙ্গে তার পার্থক্য তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯৩৫ সালের আইনের অধীনে নির্বাচনের সময় এটা বিশেষভাবে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়। মুসলিম লীগের ইশতেহারে প্রান্তিক কৃষক সমাজ ও স্বাধীনতার বিষয়ে কোন ধারণা না থাকায় হক সাহেব আলাদাভাবে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৩৬ সালে ফজলুল হক তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারের খসড়া তৈরি করেন এবং তাঁর নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় তিনি জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের তীব্র বিরোধিতা করেন। ফজলুল হক এক নতুন বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন বলে তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার বাংলার জনগণের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কৃষক প্রজা পার্টি নামে একটি দলের ব্যানারে তিনি নির্বাচন করেন। এই দলটির আত্মপ্রকাশ হয় নির্বাচনের ঠিক আগের বছরে।

কৃষক প্রজা পার্টির পটভূমি :
বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মুসলমান নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৯ সালে। স্যার আব্দুর রহিম এ সমিতির সভাপতি এবং আরও পাঁচজন সহ-সভাপতি ছিলেন। ফজলুল হক ছিলেন এ পাঁচজনের মধ্যে প্রথম সহ-সভাপতি। প্রজা সমিতির সভাপতির পদ পূরণ নিয়ে একটি বিবাদের সূত্রপাত হয়। ১৯৩৪ সালে ভারতের আইন সভার সভাপতি নির্বাচিত হলে স্যার আব্দুর রহিম নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরপর সমিতির সদস্যরা পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা-এ দুই আঞ্চলিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে ফজলুল হক সভাপতির পদের প্রত্যাশী ছিলেন, অন্যদিকে পশ্চিম বাংলা দলের পক্ষ থেকে খান বাহাদুর এ. মমিন এ পদের জন্য খুবই আগ্রহ প্রকাশ করেন। এ পরিস্থিতিতে বিতর্ক মীমাংসার জন্য উভয় দল বিদায়ী সভাপতির মধ্যস্থতা মেনে নিতে সম্মত হয়। তিনি খান বাহাদুরের প্রতি সমর্থন দেন। এ প্রেক্ষাপটে ফজলুল হক পূর্ব বাংলায় তার সমর্থকদের নিয়ে প্রজা সমিতি ত্যাগ করলেন।

একই সাথে দুইটি সংগঠনের সাথে বিরোধ তৈরি হয় ফজলুল হকের। মুসলিম লীগের সাথে ইশতেহার নিয়ে। প্রজা সমিতির সাথে নেতৃত্ব পাওয়া নিয়ে। আবার সামনে প্রাদেশিক নির্বাচন। সবগুলো বিষয় মিলে ১৯৩৬ সালে ফজলুল হক নিজেই নিয়মিত রাজনৈতিক দল কৃষক প্রজা পার্টি (কে.পি.পি.) গঠন করেন। গ্রামীণ সমাজের নেতা হিসেবে ফজলুল হক আসন্ন নির্বাচনে জনগণের মন জয় করার জন্য একটি কৃষি-ভিত্তিক কর্মসূচির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভালভাবে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কৃষক প্রজা পার্টির কর্মসূচিতে কৃষককে জমির একচ্ছত্র মালিকানা দিয়ে জমিদারি প্রথা বিলোপ, খাজনার হার হ্রাস, কৃষক সম্প্রদায়ের ঋণ মওকুফের মাধ্যমে মহাজন শ্রেণির শৃঙ্খল থেকে তাদের মুক্তিদান, কৃষকের মাঝে সুদমুক্ত ঋণ বিতরণ, দেশব্যাপী খাল খননের মাধ্যমে সেচ সুবিধা সৃষ্টি, সর্বগ্রাসী কচুরীপানা পরিষ্কার করে নৌচলাচল সচল করা, বিনাবেতনে প্রাথমিক শিক্ষা চালু ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

কৃষককুলের কাছে ফজলুল হকের বক্তৃতা ছিল তার কর্মসূচির মতই আকর্ষণীয়। ফজলুল হকের আবেদন ছিল অসম্প্রদায়িক এবং সে কারণে তিনি নিম্নবর্ণের হিন্দু কৃষক সমাজের কাছেও শ্রদ্ধাভাজন হয়ে ওঠেন। প্রজা পার্টির নির্বাচনী ইশতাহার শেষ পর্যন্ত সকলের জন্য ‘ডাল ভাত’ এ একটি শ্লোগানে পরিণত হয়। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কে.পি.পি-র প্রধান দু প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। কৃষক ভোটাররা ফজলুল হকের প্রতি বিশাল সমর্থন জানায়। যদিও তার দল মাত্র এক বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু নির্বাচনে প্রাপ্ত আসন হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কেপিপি তৃতীয় স্থান দখল করে। কংগ্রেস পায় ৫৪টি আসন, মুসলিম লীগ ৪০টি, কে.পি.পি ৩৬টি এবং অন্যান্য খন্ডিত দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২৫০ আসনের বাকিগুলি দখল করে। কে.পি.পি-র টিকেটে নির্বাচিত ৩৬ আসনের ৩৩টি আসে পূর্ব বঙ্গ থেকে। এর ফলে কে.পি.পি পূর্ব বঙ্গের একটি দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো অভাবনীয় নির্বাচনী বিজয়ের পর পরই কে.পি.পির পতন শুরু হয়। কংগ্রেস কোয়ালিশনে একমত না হওয়ায় মুসলিম লীগ ও কে.পি.পি প্রাদেশিক সরকার গঠন করে। কে.পি.পির পতনে মূল ভূমিকা রাখেন জিন্নাহ। তিনি চাইলে বাংলায় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সরকার গঠন হতে পারতো। কিন্তু তিনি বিরোধ দূর করার লক্ষ্যে ফজলুল হককেই প্রধান হয়ে সরকার গঠন করতে বলেন। এতে ফজলুল হক জিন্নাহর অনুগত হয়ে পড়েন। এ.কে ফজলুল হক মুসলিম লীগ ও আরও কয়েকটি ক্ষুদ্র দল ও স্বতন্ত্র সদস্যের সমর্থনে ও অংশগ্রহণে একটি কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠন করেন।

কে.পি.পি এবং মুসলিম লীগের দূরত্ব ঘুচে যায়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ফজলুল হককে দলকে সংহত করার পরিবর্তে ক্ষমতার রাজনীতিতে বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়। তার মন্ত্রিসভার ১১ জনের মধ্যে মাত্র ২ জন ছিলেন কে.পি.পি এবং বাকিরা মুসলিম লীগ ও সংখ্যালঘু দলগুলি থেকে। দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে অসন্তষ্ট কে.পি.পি নেতৃবৃন্দ সংসদে আলাদা দল হিসেবে আসন গ্রহণ করেন। বিদ্রোহী গ্রুপটি ১৯৩৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গাইবান্ধায় দলের সাধারণ সভা ডাকেন এবং হক ও তার অনুসারীদের দল থেকে বহিষ্কার করেন। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ফজলুল হকও বিদ্রোহীদের বহিষ্কার করেন।

আভ্যন্তরীণ কোন্দল :
১৯৩৭ সালের ২৯ জুলাই তারিখে অনুষ্ঠিত প্রথম বাজেট অধিবেশনে ভোট গ্রহণের সময় কৃষক প্রজা পার্টির বেশ কয়েকজন সদস্য শামসুদ্দীনের নেতৃত্বে কংগ্রেসের পক্ষে ভোট দিলে প্রজা পার্টির অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। কিছুদিন পর ফজলুল হক কর্তৃক নির্বাচনী অঙ্গীকার ভঙ্গের অজুহাতে প্রজা পার্টির বাম আদর্শ লালনকারী ২১ জন সদস্য কোয়ালিশন ত্যাগ করেন। দলত্যাগের এ নাটকে লীগ সুবিধা লাভ করে এবং আইন প্রণয়নের ব্যাপারে সমর্থনের জন্য ফজলুল হক লীগের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফজলুল হক দলত্যাগীদের ইসলামের স্বার্থের বিরোধী বলে ঘোষণা করেন।

বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ও মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিনের প্রভাব থেকে নিজেকে বাঁচাতে ফজলুল হক কিছু শর্তে জোট গঠনের প্রস্তাব নিয়ে কংগ্রেসের দ্বারস্থ হন। কিন্তু কংগ্রেস কর্তৃক প্রত্যাখাত হলে ফজলুল হক মুসলিম লীগের আরও বেশি নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েন। ১৯৩৭ সালের ১৫ অক্টোবর লক্ষ্ণৌতে হক আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় মুসলিম লীগের মতবাদ গ্রহণ করেন। তিনি বাংলার কোয়ালিশনের সকল মুসলিম সদস্যকে লীগে যোগদানের এবং লীগের পতাকাতলে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান। প্রকাশ্যে প্রজাপার্টির সঙ্গে ফজলুল হক সম্পর্ক ছেদ না করলেও তাঁর নেতৃত্ব ছাড়া বস্তুত পার্টি মর্যাদা হারিয়ে ফেলে।

১৯৩৮ সালে দুটি দুটি ভাঙনের মুখে পড়ে কেপিপি। আইনসভায় প্রজা পার্টির উপনেতা ও মন্ত্রী নওশের আলী মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ না করেও কোয়ালিশনের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলে লীগের উপর ফজলুল হকের নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যায়। কালক্রমে প্রজা পার্টির অবক্ষয় ঘটলে লীগের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী রইল না। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে ১৯৩৮ সালের আগস্ট মাসে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কংগ্রেস-প্রস্তাবিত বেশ কয়েকটি অনাস্থা প্রস্তাব আইনসভায় পেশ করা হয়। অবশ্য ২৫ জন ইউরোপীয় সদস্যের দৃঢ় সমর্থন লাভ করে শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা টিকে যায়। বিনিময়ে ইউরোপীয়রা পাটশিল্পে বহু সুবিধা আদায় করে নেয় যা মূল উৎপাদনকারীদের স্বার্থের পরিপন্থি হয়েছিল।

নতুন এ অবস্থা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে ফজলুল হক তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া প্রজা পার্টির সহকর্মীদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। আলোচনার পর হক ১৯৩৮ সালের ১৭ নভেম্বর শামসুদ্দীন ও তমিজউদ্দীনকে মন্ত্রিসভায় যোগদানে রাজি করাতে সক্ষম হন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই ফজলুল হক এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে জিন্নাহর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ফজলুল হক ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করলে জিন্নাহ্ তাঁকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে এবং কোয়ালিশন দল থেকে লীগকে প্রত্যাহার করে এর পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। অথচ এর আগের বছর জিন্নাহ ফজলুল হকের মাধ্যমে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব (পাকিস্তান প্রস্তাব) পেশ করান। এবং এই সুবাদে ফজলুল হক শেরে বাংলা উপাধি পান।

শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা :
১৯৪১ সালের ২ ডিসেম্বর ফজলুল হক পদত্যাগ করেন, তবে তিনি প্রজা পার্টির প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিবর্গ, কংগ্রেসের বসু গ্রুপ সহ অধিকাংশ হিন্দু সদস্য এবং হিন্দু মহাসভার রক্ষণশীল সংস্কারবাদীদের নিয়ে বিস্তৃত ভিত্তির একটি প্রগতিশীল কোয়ালিশন গঠন করতে সক্ষম হন। নতুন মন্ত্রীসভা শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা গঠিত হয় এবং ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এই মন্ত্রীসভাকে শ্যামা-হক মন্ত্রীসভা হিসেবে নামকরণ করে মূলত মুসলিম লীগ।
এই রকম এক জটিল পরিস্থিতিতে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভার পথ অবশ্যই মসৃণ ছিল না।

ফজলুল হকের একমাত্র মূলধন ছিল তার নিজস্ব জনপ্রিয়তা। সেটাতে ধ্বস লাগে যখন তিনি হিন্দুদের নিয়ে মন্ত্রীসভা করেন। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী, নাজিমুদ্দিন ও তমিজদ্দিনের মতো দক্ষ নেতা ও সংগঠক সারা প্রদেশ চষে বেড়িয়ে অসংখ্য জনসভায় হকের মুন্ডুপাত করতে থাকেন, হককে বিশ্বাসঘাতক ও মুসলমানদের শত্রু বলে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা হয়। তিনি বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছেন বলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। মন্ত্রিসভায় হিন্দমহাসভার মাত্র একজন প্রতিনিধি থাকলেও এই মন্ত্রিসভাকে শ্যামা-হক মন্ত্রিসভা নামে চিহ্নিত করা হয়।

১৯৪২ সালের এপ্রিল মাসে নাটোরের যে উপনির্বাচন হয় তাতে ফজলুল হকের মনোনীত প্রার্থী লীগের প্রার্থীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। লীগের প্রার্থী পেয়েছিলেন ১০,৪৮৩টি ভোট। হকের মনোনীত প্রার্থী পান মাত্র ৮৪০টি ভোট। তার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

পায়ের তলায় মাটি পেতে হক উঠে পড়ে লাগেন। তিনি “প্রগতিশীল মুসলিম লীগ” নামে লীগের একটি পাল্টা সংগঠন গড়ে তুলতে সক্রিয় হন। ইসলামের স্বার্থ এর প্রাথমিক লক্ষ্য হলেও অন্যান্য সম্প্রদায়ের অধিকারও রক্ষিত হবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তিনিও পূর্ব বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। কিন্তু তার এইসব প্রচেষ্টা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়। আসলে বাংলার মুসলমানরা তখন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের দিকেই আকৃষ্ট হয়েছিল। ফজলুল হকের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নীতি অবশ্যই কংগ্রেস, কৃষক-প্রজা পার্টি ও হিন্দু মহাসভার মনঃপূত ছিল। কিন্তু মুসলিমরা এই নীতি প্রত্যাখ্যান করেছিলো।

১৯৪২ সালের ১০ই মে হিন্দুমহাসভা বাংলার বিভিন্ন স্থানে “পাকিস্তান বিরোধী দিবস” পালন করে। বাংলার মুসলমান সম্প্রদায় এতে গভীরভাবে আহত হয় এবং হিন্দুমহাসভার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার জন্য তারা ফজলুল হককে দায়ী করে। সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ পদ সংরক্ষিত হলেও সেই অনুযায়ী মুসলমানদের নিয়োগ করা হয়নি বলেও হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে। প্রতিকূল এই পরিস্থিতিতে হক জিন্নার সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নিতে প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৪৩ সালের ২৮ মার্চ ফজলুল হক আর মন্ত্রীসভা কন্টিনিউ করতে সক্ষম হননি।

পঠিত : ৮৬৭ বার

মন্তব্য: ০