Alapon

ইসলাম, গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্র...


এগুলোর মাঝে কতিপয় [مضاف إليه محذوف]-এর ঝাঁক ঝাঁক ভক্তের দাপাদাপি
ইসলামের সাথে গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের তুলনা করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আবার রাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিতুলনাও ছোট্ট লেখায় সম্ভব নয়। বচসাপ্রবণ লোকদের কাছে গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্র দু’টোরই খণ্ডিত রূপই বিবেচ্য। তারা গণতন্ত্র বলতে বোঝে নির্বাচনকে, যদিও ভোটের বাইরেও গণতন্ত্র আছে। তেমনিভাবে রাজার পুত্রের রাজা হওয়াকে রাজতন্ত্র মনে করা হয়। অর্থাৎ সাধারণ মানুষ শাসক নির্ধারণের পদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রকে বিবেচনা করে।

শাসকনির্ধারণপদ্ধতি হিসেবে গণতন্ত্র ও রাজতন্ত্রের মাঝে কোনটি ইসলামের সাথে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ তা এখানে পর্যালোচনা করে দেখব। বলাবাহুল্য, মিশরের একমাত্র নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. হাফিয মুহাম্মদ মুরসি-এর মৃত্যুতে কতিপয় [مضاف إليه محذوف] ও তাদের ভক্তদের দুআ করতে কুন্ঠাবোধ করা এ লেখার প্রেষণা হিসেবে কাজ করেছে। তাদের অনেকের মতে গণতন্ত্র হারাম বা কুফরি মতবাদ, তাই নিজ দোষেই মুরসি মারা গেছেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যারা অংশগ্রহণ করেছেন তাদের জন্য দোয়া করা কীভাবে বৈধ হতে পারে (?!)

রাসূলুল্লাহ (সা) হিজরতের পর মদিনায় একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকে মনে করেন, এটি ছিল ইসলামি রাষ্ট্র। আবার অনেকে বলেন, ইসলাম তো মানুষের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য নয়। তারা বলেন, সেটি ছিল কল্যাণ রাষ্ট্র। আচ্ছা তা-ই হোক। অনেকে আবার মদিনায় রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে অস্বীকার করেন। তাদের মতে, সেটি ছিল একটি কল্যাণময় সমাজ। আচ্ছা, তর্ক এড়ানোর জন্য আমরা সবই মেনে নিলাম। কিন্তু সেকালে একজন শাসক যে দায়িত্ব ও কর্তব্য আঞ্জাম দিতেন, রাসূলুল্লাহ (সা) সেগুলো সম্পাদন করতেন, যেমন মদিনার প্রতিরক্ষার জন্য যুদ্ধ করা, দরিদ্র মানুষের দেখভাল করা, শিশুদের পড়াশুনার ব্যবস্থা করা, বিচার-আচার করা, বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ-র উদ্দেশ্যে কূটনৈতিক ও দাওয়াতি পত্র প্রেরণ ইত্যাদি। ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের কথা তো উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। এই কারণে মাইকেল এইচ হার্ট যখন পৃথিবীর সর্বকালের সেরা একশত মানুষের তালিকা করেছিলেন, তখন রাসূসুল্লাহ (সা) কে এক নম্বরে রেখেছিলেন। কারণ তিনি পার্থিব ও ধর্মীয়- দু’ক্ষেত্রেই সফল ছিলেন। এবার আপনারাই বলুন রাসূলুল্লাহ (সা) রাষ্ট্রপরিচালনা করেছিলেন কীনা।

রাসূলুল্লাহ (সা) সময়ে সারা পৃথিবীতে রাজার পুত্র রাজা বা পুত্রের অবর্তমানে রাজবংশীয় কাউকে রাজা বানানোর ধারা চালু ছিল। এটি তো রাজতন্ত্র। রাসূলুল্লাহ (সা) নিজ বংশীয় কাউকে শাসক করে যাননি। এমনকি সুস্পষ্ট করে তিনি কাউকে মনোনীতও করেননি। তাঁর ওফাতের পর সাহাবীগণ কয়েকদিন ধরে আলোচনার পর তাঁর ঘনিষ্ট সাহাবী আবু বাকর (রা)-কে (যিনি বনু হাশিমের কেউ ছিলেন না) রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতিনিধি বা খলিফা নির্ধারণ করেন। বলাবাহুল্য, আবু বাকর (রা) ধর্মীয় ও ইহলৌকিক বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। আবু বাকর (রা) মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ করে উমার (রা) খলিফা নির্ধারণ করেন। ‘উমার (রা) ছুরিকাহত হওয়ার পর পরবর্তী খলিফা নির্বাচনের জন্য ছয় সদস্যের কমিটি করেন। ‘আশারা মুবাশ্শারার জীবিত সদস্যগণ ওই কমিটির সদস্য ছিলেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, আশারা মুবাশ্শারার অন্যতম সদস্য সাঈদ ইবন যায়েদ তখন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু নিজ বংশীয় বলে উমার (রা) তাকে কমিটির সদস্য করেননি। তাছাড়া নিজ পুত্রকে খলিফা নির্ধারণ না করার কঠোর নির্দেশ দেন। তৃতীয় খলিফা ‘উসমান (রা)-এর শাহাদাতের পর উপস্থিত জনতা নিজেদের মাঝে পরামর্শ করে ‘আলী (রা) কে খলিফা নির্বাচিত করেন। এতে প্রমাণিত হয়, শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ জনগণের সাথে পরামর্শ করে খলিফা নির্বাচন করেছিলেন। শাসক নির্ধারণে বংশানুক্রমিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করেননি, যদিও তখনকার দুনিয়ায় সেটিই চালু ছিল, পরামর্শব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না।

গণতন্ত্রের সাথে ইসলামের সম্পর্কের বিষয়টি এখানেই আলোচনা করতে চাই। রাজতন্ত্রকে মিটিয়ে দিয়ে গণতন্ত্র এসেছে, এটির মূলকথা হল, কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা এলিট শ্রেণির শাসন নয়, বরং জনগণের শাসন, যা বাস্তবায়িত হয় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। কম্যুনিজমের মত আঁটসাঁট মতবাদ নয় গণতন্ত্র। তাই জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের বহু স্থানিক রূপ রয়েছে। আবার নির্বাচন ছাড়াও গণতন্ত্রের আরো অনেক উপাদান আছে, যেমন আইনসভার সার্বভৌমত্ব, সাম্য ইত্যাদি।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, গণতন্ত্র একটি শিথিল মতবাদ। ব্রাদারহুডের মত দলগুলো যখন ‘তাওহিদুল হাকিমিয়্যাহ’ বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করেন তখন তারা গণতন্ত্রের একটি শিথিল ও আংশিক রূপকে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের বাহন হিসেবে গ্রহণ করেন। নিজেদের মিশনের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশের সুযোগ গ্রহণ করেন। আবার নিজেদের পক্ষে কতটুকু জনসমর্থন সৃষ্টি হয়েছে তা যাচাইয়ের জন্য তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। আপাদমস্তক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা তারা কখনো বলেননি। তাদের সাহিত্যসম্ভার অধ্যয়নে এ বক্তব্যের সত্যতা পাওয়া যাবে। গণতন্ত্রের এই দিকটি তথা শাসক নির্বাচনে জনগণের মতামতগ্রহণ ইসলামের সাথে মোটেও সাংঘর্ষিক নয়। বিশেষত উমার (রা) এর কর্মপন্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

কতিপয় শায়খ, যারা গণতন্ত্রকে হারাম মনে করেন এবং এ কারণে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মৃত্যুতে দোয়া করতে কুন্ঠিত হন, তারা এই বিষয়টি জানেন এবং বুঝেন। ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের কারণে মুরসি’র এই পরিণতি’ একথা বলতে গিয়ে তারা কয়েকটি অপরাধ করেছেন। তারা এমন একটি ধারণা দিয়েছেন যে, ইসলাম একটি নির্মম ও নির্দয় ধর্ম। তাছাড়া নিজ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তারা সবার জানা একটি বিষয় অস্বীকার করেছেন। সেটি হল, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য মুরসি’র এই পরিণতি হয়নি, বরং গণতন্ত্রকে হত্যা করার জন্য তাঁর এই পরিণতি।

মুরসিকে যখন অপসারণ করা হয় তখনও এ শায়খগণ তৎপর ছিলেন। মুরসি-এর সমর্থকরা রাবা চত্বরে জমায়েত হয়েছিল। অবৈধ দখলদার সিসি’র বাহিনী নারী-শিশু নির্বিশেষে মুরসি সমর্থকদের নির্বিচারে হত্যা করে। তখন এসব শায়খ বলেছিলেন, রাস্তায় বিক্ষোভ করে বৈধ শাসক সিসির বিরুদ্ধে তারা বিদ্রোহ (খুরুজ) করেছিল, তাই তাদেরকে হত্যা করা জায়েজ হয়েছে। বাহ! শায়খদেরকে বুঝি এমন নির্মমভাবে মজলুমের প্রতি রূঢ় ও জালিমের স্তাবক হতে হয়! এ কারণে তারা বাদ্রারহুডের মত সংগঠনকে খারেজি আখ্যা দিয়ে নিজেদের কুৎসিত রূপ জাহির করে। তারা জেনেও না জানার ভান করে যে, গণতান্ত্রিক দেশে সভা, সমাবেশ, শোভাযাত্রা, প্রতিবাদ ও সমালোচনা জনগণের সাংবিধানিক অধিকার, ‘খুরুজ’ নয়।

এ শায়খগণের অনেকে এমন একটি দেশে বসবাস করে যেখানে কঠোর রাজতন্ত্র বিদ্যমান। হাঁ, রাজতন্ত্রের সাথে মুসলমানদের বসবাস দীর্ঘদিনের। খুলাফা রাশিদূনের কার্যকালের সমাপ্তিতে উমাইয়াগণ ক্ষমতায় বসেন। তাঁরা বংশানুক্রমিক শাসন তথা রাজতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচনের পদ্ধতি চালু করেন। উমাইয়া খেলাফতের সূচনায় অনেক সাহাবী বেঁচে ছিলেন। তাঁরা সেই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন। তাই রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হারাম বলা যায় না। তবে পূর্বের আলোচনার আলোকে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, শাসক নির্ধারণের জন্য রাজতন্ত্রের তুলনায় গণতান্ত্রিক (ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র নয়) ব্যবস্থা ইসলামের অনেক বেশি নিকটবর্তী।

রাজতন্ত্রের ব্যাপার-স্যাপার আলাদা। ওখানে মিছিল-মিটিং এর অনুমতি নেই। সমালোচনা-প্রতিবাদের অধিকার নেই। এমনকি সরকারের ইচ্ছার বিপরীতে দোয়া করাও ঝুঁকিপূর্ণ। অতি সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত এক সৌদি শায়খের একটিমাত্র অপরাধ আমরা জানতে পেরেছি। কাতার অবরোধের পর তিনি আরব দেশগুলোর শাসকদের জন্য দোয়া করে একটি টুইট করেছিলেন, যেখানে তিনি সকল দেশের জনগণের কল্যাণের জন্য যেন শাসকরা কাজ করতে পারে সেজন্য দেয়া করেছিলেন। তো এমন দেশের ফ্রিজের ভেতরে এক বাঙালি শায়খ বসবাস করেন ফতোয়া মিসাইল ছুঁড়ে মারেন। ‘ব্রাদারহুড খারেজি সংগঠন’ কারণ তারা শাসকের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং-শোভাযাত্রা করে, শাসকের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করে। ওহে কতিপয়! আপনার ফাতওয়া ফ্রিজের ভেতরে প্রযোজ্য। ফ্রিজের বাইরে গরম অনেক বেশি, তাই চিৎকার শোরগোল হবেই।

আমরা আগেই বলেছি, ব্রাদারহুডের মত সংগঠনগুলো শাসক পরিবর্তনের একটি মাধ্যমে হিসেবে গণতন্ত্রকে গ্রহণ করে। তারা আপাদমস্তক গণতন্ত্রকে গ্রহণ করে না। উপরের আলোচনার আলোকে নিঃসন্দেহে বলা যায়, শাসক নির্বাচনের উপায় হিসেবে রাজতন্ত্রের তুলনায় গণতন্ত্র অনেক বেশি ইসলামের কাছাকাছি। অন্য ভাষায়, গণতন্ত্র যদি হারাম হয়, রাজতন্ত্র ডাবল হারাম।

- জুবায়ের এহসান হক

পঠিত : ৬৭৭ বার

মন্তব্য: ০