Alapon

জীবনের কিছু অপূর্ণতাই আগামী দিনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগাবে...


আজ আমি আপনাদের একজন তথাকথিত সফল মানুষের গল্প শোনাব। যে সফলতার গল্প সাধারণত আমরা ছোট বেলা থেকে শুনতে শুনতে বড় হই।

ভারতের একজন মানুষ। ছোট বেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হবে। সেই স্বপ্নকে সামনে রেখেই পড়াশোনা করতে থাকেন। ফলে স্কুল জীবন শেষ করেন রেকর্ড মার্কস নিয়ে। এরপর ভর্তি হওয়ার পালা। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার পর দেখা গেল সে ভারতের সবচেয়ে নামকরা ৭ টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছে। সেই ৭ টি কলেজের মধ্য থেকে একটাতে পছন্দের সাবজেক্টে ভর্তি হয়ে গেলেন।

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু আচমকা তার একদিন মনে হল, আমি অভিনেতা হবো। মানুষ আমাকে এক নামে চিনবে; ফিল্ম স্টার হবো। সে যখন এই সিদ্ধান্ত নিলো তখন সে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তৃতীয় বর্ষে। আর মাত্র দুটি সেমিস্টার শেষ করলেই সে স্বীকৃত ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সার্টিফিকেট পাবে। কিন্তু তিনি পড়াশোনার পিছনে আর সেই সময়টুকুও ব্যয় করতে রাজি হলো না। কলেজ থেকে ড্রপ আউট করলো এবং পরিবারের নিষেধ অমান্য করেই মুম্মাইয়ে পাড়ি জমালো। বুকে তার একটাই স্বপ্ন, আমাকে ফিল্ম স্টার হতেই হবে।

ফিল্ম হওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবে সে ড্যান্স ক্লাসে ড্যান্স শিখতে থাকে আর থিয়েটারে অভিনয় করতে থাকে। এভাবে এভাবে চলতে চলতে একদিন তার সামনে খুব ছোট্ট একটা সুযোগ চলে আসে, একটি স্টেজ শো তে ব্যাক ড্যান্সার হওয়ার। আর সেখানে প্রধান পারফরমার থাকবেন বলিউডের বাদশাহ হিসেবেখ্যাত শাহরুখ খান। সে যখন শাহরুখ খানের সঙ্গে ব্যাক ড্যান্সার হিসেবে ড্যান্স করছিল, তখন ভাবছিল- ‘এই তো আর তিন কদম বাকি! আজ শাহরুখ খান যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একদিন আমিও সেখানে দাঁড়াবো। সেজন্য আমাকে প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’

এরপর আরও কিছুদিন কেটে যায়। তারপর তার কাছে একটি ড্রামা সিরিয়ালে অভিনয় করার প্রস্তাব আসে। সে সেই প্রস্তাবে রাজিও হয়ে যায়। সেই ড্রামা দিয়ে তার জীবনে প্রথম চুক্তি ভিত্তিক উপার্জন শুরু হয়। কিছুদিন পর সেই ড্রামা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং তার উপার্জনের পরিমাণও বাড়তে থাকে। এরপর আরও একটি ড্রামাতে অভিনয় করার অফার। তারপর আরও একটি। এভাবেই তার ব্যস্ততা বাড়ছিল আর টাকার পরিমাণ বাড়ছিল।

এরপর...এরপর একদিন তার কাছে এলো সেই কাঙ্খিত প্রস্তাব, ফিল্ম স্টার। যে ফিল্ম স্টার হওয়ার জন্য সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা শেষ না করেই মুম্বাই শহরে চলে আসে। তারপর সে তার এতোদিন লালিত স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হল এবং সহসাই ফিল্ম স্টার খেতাব পেল। এরপর তার পরিচিতি ও টাকা জ্যামিতিক হারে বাড়তে লাগল। আর সেই টাকা দিয়ে দিয়ে সে তার স্বপ্নের বাড়ি কিন, স্বপ্নের গাড়ি কিনল। তার আকাশের তারা দেখার শখ ছিল। বিশ্বের যেকটি অতি শক্তিশালী টেলিস্কোপ রয়েছে তার একটির সে মালিক হল। এতেও সে শান্ত হল না। চাঁদে বসে তাঁরা দেখার আশায় চাঁদে এক খন্ড জমিও কিনে ফেলল। আর এভাবেই সে জীবনের সব স্বপ্ন পূরণ করল।

ছোট বেলা থেকে আমরা যে সফলতার সংজ্ঞা শুনে বড় হয়েছি, তার সবটাই সে অর্জন করল। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে সে পৃথিবীর অন্যতম একজন সফল মানুষে পরিণত হল। তারপর...তারপর তার আর কোনো স্বপ্ন নেই। আর স্বপ্ন না থাকার দরুন সে এই পৃথিবীতে বসবাস করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলল এবং এক রৌদ্র ঝলমলে সকালে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে পড়ে পৃথিবীর সাথে নিজের সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলল।

এতোক্ষণ যে মানুষটার গল্প বললাম সে আর কেউ নয় বলিউডের সুপারস্টার সুশান্ত সিং।

ইদানিংকালে আমাদের একটা কথা শোনানো হয়, ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।’ আর সেই স্বপ্নগুলো হবে এই দুনিয়ায় সফলতা পাওয়ার স্বপ্ন। তারপর সেই স্বপ্নের পিছনে আমাদের দিনরাত ছুটতে হবে। ইদানিংকালে আমাদের প্রায় সকলের স্বপ্ন একটাই, কী করে অধিক টাকা ইনকাম করা যায়! আরও প্রচুর টাকা ইনকাম করা যায়।

এই স্বপ্নের ফলাফল স্বরূপ এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান সময়ে মানসিক অবসাদগ্রস্থ রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি যারা এই স্বপ্ন পূরণ করে এখন হাজার কোটি টাকা ইনকাম করেছে তারাও মানসিক অবসাদে ভুগছে। কারণ, তাদের মনে শান্তি নেই। রাতে তাদের ঠিকমত ঘুম আসে না। ঘুমানোর জন্য ওষুধের সাহায্য নিতে হয়। অন্যদিকে মাঝরাতে রাস্তায় বেরুলে খেয়াল করলে দেখবেন কারওয়ান বাজারের কুলিটা তার মালামাল বহনের ঝুড়িটাতেই দিব্যি না ডেকে ঘুমাচ্ছে। তার ঘুম দেখে মনে হবে, সে কতই না নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আরও মনে হবে, সে-ই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ।

আর একটা ছোট্ট ঘটনা দিয়েই ইতি টানব। আমার জন্ম একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে। ছোট বেলা থেকেই দেখে আসছি, দুই ঈদের এক ঈদে আমাদের নতুন কাপড় দেওয়া হতো। আর এক ঈদে আমাদের নতুন কাপড় দেওয়া হতো না। তখন মনে হতো, দুই ঈদেই যদি আমাদের নতুন কাপড় দেওয়া হতো তাহলে হয়তো ঈদটা আরও একটু বেশি ভালো কাটতো।

আলহামদুলিল্লাহ, এখন নিজে আয় ইনকাম করি। কিন্তু সত্যি বলতে এখন নিজের টাকা থাকা স্বত্ত্বেও সেই ছোটবেলার মত যে কোনো একটা ঈদে নিজের জন্য নতুন কাপড় কিনি। আর এটাতেই সুখ খুঁজে পাই।

আব্বাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আব্বা, আপনার তো সামর্থ্য ছিল। তাহলে প্রতি ঈদেই কেন আমাদের নতুন জামা দিতেন না?’
আব্বা বলেছিলেন, ‘জীবনের কিছু অপূর্ণতাই তোমাকে আগামী দিনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগাবে। তাই জীবনের সব ইচ্ছা পূরণ করতে নেই...’।

পঠিত : ৪৪৩ বার

মন্তব্য: ০