Alapon

বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিংঃ আদিম দাস প্রথার আধুনিক সংস্করণ



বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের মূর্তিমান আতংকের নাম “র‍্যাগিং”। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর কমবেশি এই আদিম বর্বর প্রথার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
র‍্যাগারদের যুক্তি অনুযায়ী, ‘এটা বহু বছর ধরে চলে আসা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি। আমাদের সিনিয়ররা আমাদের র‍্যাগ দিয়েছেন, তাই আমরাও আমাদের জুনিয়রদের র‍্যাগ দিবো। এর মাধ্যমে ভার্সিটিতে আসা অসভ্য ছেলে মেয়েদের ম্যানার্স শিখিয়ে সভ্য বানানো হয়। তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় কালচার শেখানো হয়।‘
তাদের যুক্তিগুলো যে কতোটা হাস্যকর ‘অপযুক্তি’ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিষয়টা কিছুটা আমাদের ছোটবেলায় পড়া “A fox without a tail” গল্পের মতো। অর্থাৎ আমার লেজ কেটেছে, তাই আমি অন্যদেরও লেজ থাকতে দিবো না।
বা কিছুটা এই রকম যে, আমি ধর্ষিত হয়েছি, তাই আমি চাই অন্যরাও ধর্ষিত হোক।

মূলত একজন শিক্ষার্থী যখন সদ্য ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে তার বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, চেনা পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ নতুন একটি পরিবেশে আসে, তখন এমনিই মনের মধ্যে দ্বিধা-সংকোচ-ভয় কাজ করে, পাশাপাশি মনের কোণে নতুন একটি জীবন শুরু করার স্বপ্ন জাগে।
ঠিক তখনই এই ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের মানুষগুলোকে মানুষিকভাবে ধর্ষিত হতে হয় কিছু মানুষিক বিকারগ্রস্থ মানুষদের দ্বারা।
তাদেরকে সভ্যতা শেখানোর নামে নানাভাবে উৎপীড়ন করা হয়, রুমের ভেতর অর্ধ-উলঙ্গ করে নাচানো হয়, অশ্লীল কবিতা পাঠ করানো হয়, নিজের পরিবারের সদস্যদের নামে ‘চটিগল্প’ বলতে বলা হয়। এমন আরো অনেক কিছুই করানো হয়, যা কোন সুস্থ মানুষ ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে তো র‍্যাগিং এর নামে মারধোর ও শারিরীক নির্যাতন করা হয়।
এই বর্বর নির্যাতনের স্বীকার কতো শিক্ষার্থী যে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে রাতে আঁধারে ক্যাম্পাস ত্যাগ করে, তা আমরা কতোজন জানি?
আর যারা বর্বর মধ্যযুগীয় নির্যাতন সহ্য করে টিকে যায়, তারাই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। এই টিকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি অংশের মানুষিক বিকৃতি ঘটে। তারা এক পর্যায়ে এই নির্যাতনকে উপভোগ করতে থাকে। পরবর্তীতে এরাই সিনিয়র হয়ে তাদের জুনিয়রদের নির্যাতন চালায়।
তারাই আবার এরপক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়। একে “সভ্যতা শেখানো” বলে লিগালাইজ করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এবার মনে হচ্ছে এই মহামানবেরা সভ্যতার সঙ্গাটাকেও পরিবর্তন করবেন।
এটাকে আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও আমাদেরকে খুঁজে দেখতে হবে এর শেকড় কোথায়।

পূর্ববর্তী সময়ে এক সময় পৃথিবীতে দাসপ্রথা ছিলো, যখন সমাজে দুটো শ্রেণী ছিলো: দাস (Slave) ও দাস মালিক (Slavemaster)। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দাস বিদ্রোহের পর দাসভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থারবস্থার অবসান হয় ও সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থার (Feudalistic Society) উদ্ভব হয়, যা নামের দিক থেকে ভিন্ন হলেও আদতে তা দাসপ্রথাই ছিলো। এই সমাজের দুটো শ্রেণী হলো ভূ-স্বামী (Feudal Lord) ও কৃষক (Pesant)।
এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক শাসন ও সমাজব্যাবস্থা আসে, যেখানে সবাই স্বাধীন ও সবাই সমান।

কিন্তু আমাদের এই উপমহাদেশে বহুবছর ধরে দাসপ্রথা ও পরবর্তীতে সামন্ততন্ত্র থাকার ফলে তা মানুষের অবচেতনে তাদের সামাজিক ও পারিবারিক ব্যাবস্থার মধ্যে স্থান করে নেয়, যায় মূল মন্ত্রই হলো যে তোমার দূর্বল বা ছোট তাকে Dominate করার অধিকার তোমার আছে।
পরবর্তীতে আমাদের এই উপমহাদেশে নামে মাত্র গণতন্ত্র এলেও গণতন্ত্রের আঁড়ালে দাসপ্রথা ঠিকই থেকে যায়। যেখানে জনগণ হলো দাস আর শাসকরা হলো মালিক। এই তো গেলো রাজনৈতিক অবস্থা। এবার সমাজের দিকে চোখ ফেরানো যাক, সমাজের একটি নির্দিষ্ট কাঠামো রয়েছে, যেখানে কাঠামোর উপরে অবস্থানকারী মানুষগুলো হলো মালিক, আর কাঠামোর নিম্নস্তরে বসবাসকারী মানুষগুলো হলো দাস, যাদের Dominate করার অধিকার সমাজের উপরের স্তরের মানুষগুলোর রয়েছে।

এই যে একটি Dominating Society এর বাইরে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও পড়ে না। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়তে আসে, তারা এই গণতন্ত্রের নামধারী নব্য-সামন্ত্রতান্ত্রিক সমাজব্যাবস্থা থেকেই উঠে আসে। তাই নিজেদের এই মানুষিকতা তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের জুনিয়রদের উপর প্রয়োগ করতে আসে।
যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের জুনিয়ররা হলো একপ্রকার অলিখিত দাস, আর সিনিয়ররা মালিক। তারা চাইলে তাদের সাথে যা ইচ্ছে করতে পারে। আর জুনিয়ররা তা মেনে নিতে বাধ্য।

বর্তমান সময়ে অবশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন র‍্যাগিং এর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিচ্ছে। র‍্যাগিং এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে বর্তমানে আছে “শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়”, আমি যেখানকার ছাত্র।
এখানে র‍্যাগিং এর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়ার জন্য শিক্ষকদের সমন্বয়ে কমিটি আছে, যেখানে র‍্যাগিং এর স্বীকার ছাত্র-ছাত্রীদের অভিযোগ নিয়ে দ্রুততার সাথে তাদের প্রতি হওয়া নির্যাতনের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়।
তাই আমাদের ক্যাম্পাসে র‍্যাগিং প্রায় নেই বললেই চলে, কারণ এখানে র‍্যাগিং এর শাস্তি আজীবন বহিষ্কার এবং আমরা তা কার্যকর হতেও দেখেছি।
তাই বলে ক্যাম্পাসে র‍্যাগিং নেই বলে আত্মতৃপ্তি বোধ করাটাও অনুচিত। কারণ আমাদের চারদিকে একদল অসুস্থ মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কে বলতে পারে আমার পাশে বসা মানুষটিই একটুপর গিয়ে কাউকে র‍্যাগ দিবে না।

আর র‍্যাগিং এর সব ঘটনা তো সামনে আসে না। অল্পকিছুই সামনে আসে। আর ক্যাম্পাসে আসার পর একজন নতুন শিক্ষার্থীর এতোটা সাহস থাকে না যে প্রোক্টর স্যারের কাছে গিয়ে র‍্যাগারদের নামে নালিশ করবে। কারণ পূর্ব থেকেই তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, “তোরা আমাদের বালটাও ছিড়তে পারবি না।“
তবুও যারা সাহসী হয়ে প্রোক্টর স্যারের অফিস পর্যন্ত যেতে পারে, কেবল তাদের ক্ষেত্রেই আমরা সুবিচার দেখতে পাই।
এবার একটি ছোট ঘটনা দিয়ে আমার এই সুদীর্ঘ লেখা শেষ করবো:
আমার নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক বন্ধু বললো, তাকে একবার ক্যাম্পাসের তথাকথিত বড় ভাইয়েরা ক্যাম্পাসের বাইরের এক মেসে ডাকে। সেখানে গিয়ে সে দেখে তার মতো আরো অনেককেই সেখানে আনা হয়েছে। এরপর তাদের প্রায় অর্ধ-নগ্ন করে সারারাত চলে র‍্যাগিং।
র‍্যাগিং এর এক পর্যায়ে সেই তথাকথিত বড় ভাইরা বারবার করে বলছিলেন, “ কি, প্রোক্টরের কাছে বিচার দিবি, না ভিসির কাছে? আচ্ছা তোদের বিচার দিতে হবে না। আমার কাছে ভিসির নাম্বার আছে। আমিই ফোন দিচ্ছি।“
এক পর্যায়ে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বলে ফেললেন, “তোরা আমার বালটাও ফেলতে পারবি না।“
আমার সেই নিরীহ বন্ধুটি তখন যদি একটু সাহসী হয়ে অভিযোগ দায়ের করতে পারতো, তখন হয়তো বা আমরা অন্যরকম একটা ফল দেখতে পেতাম।

সর্বোপরি সবার কাছে একটাই অনুরোধ থাকবে, যখনই আপনার সামনে কাউকে এই বর্বর নির্যাতনের স্বীকার হতে দেখবেন, দয়া করে না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাবেন না।
তার পাশে দাঁড়ান, তাকে সেখান থেকে রক্ষা করে নিয়ে আসুন। তাকে সুবিচার পাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করুন। দেখবেন, এই মানুষটি আপনাকে সারাজীবন মনে রাখবে।
শ্রদ্ধা জোর করে পাওয়া যায় না। তা অর্জন করে নিতে হয়।

পঠিত : ৭৭২ বার

মন্তব্য: ০