Alapon

বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ ‘আর রাহিকুল মাখতুম’ রচনার অজানা ইতিহাস...


রাতে আল্লাহর রাসূলের সীরাত গ্রন্থ ‘আর রাহিকুল মাখতুম’ পড়ছিলাম। এই গ্রন্থের খ্যাতি দুনিয়াজোড়া। অথচ গ্রন্থের রচয়িতা একজন হিন্দুস্থানী; সফিউর রহমান মোবারকপুরী। একজন হিন্দুস্থানী লেখকের বই দুনিয়াজোড়া খ্যাতি লাভ করল কীভাবে, এই প্রশ্নটা আমার মনে ঘুরপাক খেতে লাগল। উইকিয়াপিডিয়া ঘেটে দেখলাম, বইটি রচনাকাল ১৯৭৬ সাল! ওই সময়তো গ্লোবাল ভিলেজ বলতে তেমন কিছু ছিল না; বর্তমানে যার বদৌলতে পৃথিবী এখন অনেকটা বর্ডারশূণ্য! জ্ঞানের দিক থেকে বহু পূর্ব থেকেই কোনো বর্ডার ছিল না। কিন্তু সেসময় একজন হিন্দুস্থানী লেখকের বই দুনিয়াজোড়া আলোড়ন সৃষ্টি করবে, তা বিষ্ময়করই বটে।
এই কৌতূহল থেকেই এই গ্রন্থ রচনার ইতিহাস জানার চেষ্টা করলাম।

১৯৭৬ সাল। পাকিস্তানের করাচীতে ‘রাবেতা আলম আল ইসলামী’-এর উদ্যোগে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘রাবেতা আলম আল ইসলামী’ বিশ্ব জুড়ে একটি প্রতিযোগিতার ঘোষণা দেয়। প্রতিযোগিতাটি হল আল্লাহর রাসূলের জীবনী রচনা প্রতিযোগিতা। বিশ্বের যেকোনো ভাষায় এই জীবনী রচনা করা যাবে এবং রাবেতা আলম আল ইসলামীর নির্দশনা মেনে পান্ডুলিপি প্রস্তুত করে মক্কায় পাঠাতে হবে। তারপর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত কমিটি সেইসব পান্ডুলিপি বাছাই করে নির্বাচিত পান্ডুলিপি নির্বাচন করবেন। সেক্ষেত্রে ৫ টি পান্ডুলিপি বাছাই করা হবে। যে পান্ডুলিপি প্রথম স্থান অধিকার করবে তার রচয়িতাকে দেওয়া হবে ৫০ হাজার সৌদি রিয়াল। দ্বিতীয় স্থান অধিকারীকে দেওয়া হবে ৪০ হাজার সৌদি রিয়াল। তৃতীয় স্থান অধিকারীকে দেওয়া হবে ৩০ হাজার সৌদি রিয়াল। চতুর্থ স্থান অধিকারীকে দেওয়া হবে ২০ হাজার ও পঞ্চম স্থান অধিকারীকে দেওয়া হবে ১০ হাজার সৌদি রিয়াল।

প্রযুক্তির অনগ্ররসতার কারণে তখন আন্তর্জাতিক সংবাদগুলো পৌঁছাতে বেশ সময় লাগত। ফলে সফিউর রহমান মোবারকপুরী সাহেবও এই প্রতিযোগিতার বিষয়ে বেখবর রইলেন। এরপর মাদ্রাসার ছুটিতে মোবারকপুরী সাহেব যখন বাড়িতে গেলেন তখন তাঁর ফুফা তাকে এই প্রতিযোগিতার সংবাদ প্রেরণ করলেন। সেইসাথে মোবারকপুরী সাহেবকে উক্ত প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করার কথা বললেন। কিন্তু মোবারকপুরী সাহেব বললেন, ‘আমি এই কাজের যোগ্য না। আর এটাতো এমন কোনো সাধারণ বিষয় নয়; স্বয়ং আল্লাহর রাসূলের জীবনী রচনার বিষয়। বিরাট কাজ। এতো বড় কাজে হাত দেওয়ার মত যোগ্যতা ও সক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই।’
তখন তার ফুফা বললেন, ‘তুমি ভেবো না, আমি প্রাইজমানি পাওয়ার লোভে তোমাকে এখানে অংশগ্রহণ করতে বলছি! বরং আমি চাই, অন্তত তোমার মাধ্যমে হলেও যেন দ্বীনের একটি বড় খেদমত সম্পাদিত হয়। আর তুমি হও সেই খেদমতের অংশিদার।’
কিন্তু তারপরও মোবারকপুরী সাহেব নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।

এরপর কেটে যায় বহুদিন! মোবারকপুরী সাহেব একদিন মাদ্রাসায় নিজের কামরায় বসেছিলেন এবং স্থানীয় একটি ম্যাগাজিন পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছিলেন। পাতা উল্টাতে উল্টাতে হঠাৎ একটি বিজ্ঞাপনে তার চোখ আটকে যায়; ‘রাবেতা আলম আল ইসলামী’- এর বিজ্ঞাপন। সেই সীরাত প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন। তিনি বিজ্ঞাপনটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়লেন এবং রাবেতা আলমের শর্তাবলিগুলো লক্ষ্য করলেন। সেই বিজ্ঞাপন দেখার পর এবং তার ফুফার উপর্যোপরি জোরাজুরি ও ‍উৎসাহের দরুন তিনি সীরাত রচনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কিন্তু ততোদিনে প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার ৫ মাস কেটে গেছে। আর মাত্র ৩ মাস বাকি আছে। প্রথমে একটু সংশয়ে ছিলেন, এতো কম সময়ে রেফারেন্সসহ পূর্ণাঙ্গ সীরাত রচনা করা সম্ভব হবে কিনা! তারপর সমস্ত সংশয় দূর করে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপর ভরসা করে সীরাত রচনা শুরু করে দিলেন।

এর কিছুদিন পরেই চলে আসল রমজান মাস। যার কারণে মাদ্রাসা বন্ধ দিল এবং মোবারকপুরী সাহেব লেখার জন্য আরও বেশি সময় পেলেন। সেই রমজান মাসটা সফিউর রহমান মোবারকপুরী সাহেবের জন্য বিশেষ বরকতের মাস হিসেবেই আর্বিভূত হয়েছিল। রমজান মাস শেষে দেখা গেল সীরাত গ্রন্থের প্রায় ২ তৃতীয়াংশ রচনা করা শেষ। আর বাকি অংশও দিন দশেকের মধ্যে রচনা শেষ হয়ে যাবে। তবে মোবারকপুরী সাহেব সংশয়ে ছিলেন, দ্বীতিয়বার পুরো পান্ডুলিপি পড়ে সংযোজন ও বিয়োজন করার সুযোগ পাবেন কিনা! তবে এক্ষেত্রে এগিয়ে আসলেন মোবারকপুরী সাহেবের সেই ফুফা। তিনি নিজেও একজন আলেম। তিনি সীরাত গ্রন্থের রেফারেন্সগুলো মিলিয়ে মিলিয়ে মোবারকপুরী সাহেবের কাজটাকে অনেকটা সহজ করে দিলেন।

এরপর দুই সপ্তাহ পর মক্কার রাবেতা আলম আল ইসলামী-এর ঠিকানায় পান্ডুলিপি পাঠিয়ে দিলেন। এর দুই মাস পর রাবেতা আলম আল ইসলামী থেকে সফিউর রহমান মোবারকপুরী সাহেবের নামে রেজিষ্ট্রিকৃত দুটি চিঠি আসে। সেই চিঠিগুলোর মাধ্যমে তার পান্ডুলিপি চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছে বলে জানানো হয়। এরপর কেটে যায় যায় বহুদিন। মোবারকপুরী সাহেব কিছুদিন এদিক-ওদিক ঘুরে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলেও রাবেতা আলম আল ইসলামীর আর কোনো খবর পাওয়া যায় না। তারপর নানা ঝামেলা ও ব্যস্ততার দরুন মোবারকপুরী সাহেবও সেই প্রতিযোগিতার খবর অনেকটাই ভুলে গেলেন।

এভাবে কেটে গেল দুই বছর। একদিন মোবারকপুরী সাহেব স্থানীয় রেল স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ট্রেন আসতে দেরি দেখে একটা পত্রিকা কিনে পড়তে শুরু করলেন। পত্রিকার পাতা খুলতেই দেখলেন গতকাল পাকিস্তানে রাবেতা আলম আল ইসলামীর মহা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত অনুষ্ঠানে সীরাত প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের নামও ঘোষণা করা হয়েছে। বিজয়ীদের মধ্যে একজন হিন্দুস্থানী লেখকও রয়েছেন। তবে পত্রিকায় সেই লেখকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। তারপর মোবারকপুরী সাহেব এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানার জন্য বহু চেষ্টা করলেন, কিন্তু পেলেন না।

তারপর এর দিন দুয়েক পরে ভোরবেলা মাদ্রাসায় হঠাৎ শোরগোল শোনা যেতে লাগল। শোরগোলটা আস্তে আস্তে মোবারকপুরী সাহেবের রুমের দিকেই এগিয়ে আসছিল। তারপর সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা যখন তার রুমে ঢুকে অভিনন্দন জানাতে লাগলেন, মোবারকপুরী সাহেব তখনও হতভম্বের ন্যায় দাড়িয়ে ছিলেন। তিনি অবাক হয়ে তাদের উল্লাস দেখছিলেন, কিন্তু তখনও তিনি জানেন না তারা কেন আনন্দা-উল্লাস করছে। তারপর তার দিয়ে যখন পত্রিকা এগিয়ে দেওয়া হল তখন দেখলেন রাবেতা আলম আল ইসলামীর সীরাত প্রতিযোগিতায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।

রাবেতা আলম আল ইসলামীর তথ্যমতে উক্ত প্রতিযোগিতায় ১১৮৭ টি পান্ডুলিপি জমা হয়েছিল। সেখান থেকে প্রাথমকিভাবে ১৮০ টি পান্ডুলিপি বাছাই করে সেখান থেকে চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা হয়। আর সেই চূড়ান্ত মূল্যায়নে সফিউর রহমান মোবারকপুরী সাহেবের আর রাহিকুল মাখতুম সীরাত গ্রন্থটি শ্রেষ্ঠ সীরাত বলে নির্বাচিত হয়। আর এই প্রতিযোগিতার কারণেই ‘আর রাহিকুল মাখতুম’- এর নাম বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

আর রাহিকুল মাখতুম প্রথমে আরবী ভাষায় রচিত হলেও পরবর্তিতে উর্দু, হিন্দি এবং বাংলা ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়। আর এই সীরাত গ্রন্থের জনপ্রিয়তা এখনো সেই প্রথম সময়ের মতই ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। মহান আল্লাহ সফিউর রহমান মোবারকপুরী সাহেবের খেদমত কবুল করে নিন।

পঠিত : ১০৩২ বার

মন্তব্য: ০