Alapon

লাহোর প্রস্তাব থেকে পাকিস্তান আন্দোলন



পাকিস্তানের চিন্তাভাবনা অথবা পরিকল্পনা কোন অভিনব রাজনৈতিক দশর্ন নয়। এটি হুট করে হিন্দুস্থানে নাজিল হয়নি। ধারাবাহিকভাবে এর একটি প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। লর্ড কার্জন কর্তৃক শুধুমাত্র প্রশাসনিক কারণে ১৯০৫ সালে বাংলাকে ভেঙে আরেকটি প্রদেশ তৈরি করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মুশরিকদের বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন এবং ১৯১১ সালে তা রহিতকরণ থেকে শুরু। এরপর উপমহাদেশের যত্রতত্র এবং যখন তখন মুসলমাদের গায়ে পড়ে হিন্দুদের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ সৃষ্টি এবং মুসলমানদের জানমালের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে মুশরিকরা। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে বার বার সমঝোতা করার চেষ্টা করা হলেও কংগ্রেস তথা হিন্দুত্ববাদীদের হটকারিতায় সেটা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর সাতটি প্রদেশে আড়াই বছর কংগ্রেসের কুশাসন মুসলিমদের আলাদা রাষ্ট্রের কথা তীব্রভাবে ভাবতে শিখায়।

হিন্দুস্থানে মুশরিকরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ও শক্তিশালী হওয়ার কারণে মুসলিম জাতিকে হয় তাদের দাসানুদাস বানিয়ে রাখতে অথবা নির্মূল করতে চায়। এ লক্ষ্য হাসিলে জন্যেই কংগ্রেসের দাবী ছিল এই যে এ উপমহাদেশের অধিবাসীদের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং ব্রিটিশ সরকারকে তার হাতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। হিন্দু সভ্যতা সংস্কৃতি ও হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ এবং হিন্দুরামরাজ্য স্থাপনই ছিল কংগ্রেসের একমাত্র লক্ষ্য। কংগ্রেস ও তার কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন আচরণে এ বিশ্বাস মুসলমানদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয় এবং এ কারণেই মুসলমানগণ পাকিস্তান আন্দোলন করতে বাধ্য হন।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, পাকিস্তানের সূচনা তখন থেকে হয় যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম বিজয়ীর বেশে হিন্দুস্থানে পদার্পণ করেন। অতঃপর এ উপমহাদেশে কয়েকশত বছর ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা বলবৎ থাকে। বৃটিশ শাসনের শেষের দিকে পুনরায় বৃটিশ ভারতে মুসলিম জাতির স্বাতন্ত্র ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠর চিন্তভাবনা ও প্রচেষ্টা শুরু হয়। উপমহাদেশে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ- পূর্ব অঞ্চলগুলোতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা আলাদা রাষ্ট্রের ব্যাপারে প্রেরণা দিয়েছিল। তাই বিশ্ব ইসলামী ঐক্যের অগ্রদূত সাইয়েদ জামালুদ্দীন আগগানী আফগানিস্তান এবং উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে একটি মুসলিম রিপাবলিক গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রথম চিন্তাভাবনা করেন।

আল্লামা মুহাম্মদ ইকবাল ১৯৩০ সালে এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন সমস্যা আলোচনার পর বৃটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যেই অথবা বাইরে মুসলমানদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আল্লামা ইকবাল তাঁর প্রস্তাবিত মুসলিম রাষ্ট্রের কোনো নাম দেননি। এ কাজটি করেছেন চৌধুরী রহমত আলী। ১৯৩৩ সালের জানুয়ারী মাসে চৌধুরী রহমত আলী এবং তাঁর ক্যাম্ব্রিজের তিনজন সহকর্মী নাউ অর নেভার (Now or Never) শীর্ষক একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। চৌধুরী রহমত আলী তাঁর প্রচারপত্র ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে, লন্ডনে অনুষ্ঠিত তৃতীয় গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানকারী মুসলিম ডেলিগেটদের কাছে এবং ইংলন্ডের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিকটে প্রেরণ করেন। এই প্রচারপত্রেই তিনি পাকিস্তান শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি পাকিস্তান বলতে হিন্দুস্থানের উত্তরাঞ্চলে পাঁচটি প্রদেশ তথা পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানকে বুঝিয়েছেন। এই প্রচারপত্রের মূল বিষয় ছিলো মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র। ‘পাকিস্তান’ নামটি চৌধুরী রহমত আলীরই উদ্ভবন- যা লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে হিন্দুস্থানের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং প্রায় সাত বছর পর তা বাস্তব সত্যে পরিণত হয়।

লাহোর প্রস্তাবের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহ :
প্রথমত
নিখিল ভারত মুসলিম লীগ দৃঢ়তার সাথে পুনঃঘোষণা করছে যে, ১৯৩৫ খ্রীস্টাব্দের ভারত শাসন আইন-এ যে যুক্তরাষ্ট্রের (Federal) পরিকল্পনা রয়েছে, তা এ দেশের উদ্ভূত অবস্থার প্রেক্ষিতে অসঙ্গত ও অকার্যকর বিধায় তা ভারতীয় মুসলমানদের জন্য অগ্রহণযোগ্য।

দ্বিতীয়ত
সমস্ত সাংবিধানিক পরিকল্পনা নতুনভাবে বিবেচনা না করা হলে মুসলিম ভারত অসন্তুষ্ট হবে এবং মুসলমানদের অনুমোদন ও সম্মতি ব্যতিরেকে সংবিধান রচিত হলে কোন সংশোধিত পরিকল্পনাও তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।

তৃতীয়ত
নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সুচিন্তিত অভিমত এরূপ যে, ভারতে কোন শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকর হবে না যদি তা নিম্নবর্ণিত মূলনীতির উপর ভিত্তি করে রচিত না হয়:
ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সংলগ্ন বা সন্নিহিত স্থানসমূহকে 'অঞ্চল' হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানা পরিবর্তন করে এমনভাবে গঠন করতে হবে যেখানে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এলাকাগুলো 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ' (Independent States) গঠন করতে পারে, 'স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের' সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাষ্ট্র বা প্রদেশসমূহ হবে স্বায়ত্বশাসিত ও সার্বভৌম।

চতুর্থত
এ সমস্ত অঞ্চলের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে সংবিধানের কার্যকর ও বাধ্যতামূলক বিধান রাখতে হবে। ভারতবর্ষের মুসলমান জনগণ যেখানে সংখ্যালঘু সেখানে তাদের সাথে পরামর্শ সাপেক্ষে এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথেও আলোচনা সাপেক্ষে সংবিধানে কার্যকর বিধান রাখতে হবে।

২৪ মার্চ প্রবল উৎসাহের মধ্য দিয়ে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। হিন্দু সংবাদপত্র ও সাময়িকীসমূহ লাহোর প্রস্তাবকে ক্যামব্রিজে বসবাসরত দেশত্যাগী ভারতীয় মুসলমান রহমত আলী কর্তৃক উদ্ভাবিত নকশা অনুযায়ী ‘পাকিস্তানের জন্য দাবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। হিন্দু সংবাদপত্রসমূহ লাহোর প্রস্তাবকে পাকিস্তান ট্যাগ দিয়ে একটি রাষ্ট্রের ধারণা দেয়। মুসলমান নেতাদের পক্ষে সাধারণ মুসলিম জনগণের নিকট লাহোর প্রস্তাবের ব্যাখ্যা প্রদান এবং এর প্রকৃত অর্থ ও গুরুত্ব বুঝাতে হয়তো দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারতো। কিন্তু হিন্দু সংবাদপত্রসমূহ কর্তৃক প্রস্তাবটিকে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে নামকরণ করাতে সাধারণ জনগণের মাঝে এর পূর্ণ গুরুত্ব জনে জনে প্রচার করার ব্যাপারে মুসলমান নেতৃবৃন্দের অনেক বছরের পরিশ্রম কমিয়ে দেয়। বিরোধীতা করতে গিয়ে পাকিস্তানের প্রচার হিন্দুরাই বেশি করে। যদিও লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান শব্দটির উল্লেখ ছিল না।

যাই হোক, এরপর ১৯৪১ সালের ১৫ এপ্রিল মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাবকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্রে একটি মৌল বিষয় হিসেবে সন্নিবেশ করা হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের স্বাধীনতা পর্যন্ত এটি লীগের প্রধান বিষয় ছিল। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে যখন মন্ত্রী মিশন ভারতে পৌঁছে, তখন ৭ এপ্রিল দিল্লিতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তাদের ‘পাকিস্তান দাবি’র পুনরাবৃত্তি করতে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্যদের তিন-দিনব্যাপী এক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়। সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি চৌধুরী খালিকুজ্জামান, হাসান ইস্পাহানি ও অন্যান্যদের সমবায়ে একটি উপ-কমিটি নিয়োগ করে। চৌধুরী খালিকুজ্জামান প্রস্তাবের একটি খসড়া তৈরি করেন। অন্যান্য সদস্যদের সাথে খসড়াটি নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং সামান্য পরিবর্তনের পর উপ-কমিটি এবং অতঃপর সাবজেক্ট কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ‘স্টেটস’ (States) শব্দটিকে একবচন শব্দ ‘স্টেট’ (State)-এ পরিবর্তন করা হয়।

পাকিস্তান দাবি ভারতের মুসলিমদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর পিছনে অনেক সুস্পষ্ট কারণ ছিল। বাংলা ও পাঞ্জাবের কৃষকদের নিকট ‘পাকিস্তান’কে হিন্দু জমিদারদের শোষণের অবসান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বেঙ্গল মুসলিম লীগের সচিব আবুল হাশেম ১৯৪৪ সালে এক ঘোষণার মাধ্যমে জমিদারি উচ্ছেদের অঙ্গীকার করেন। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় ছিল যে, প্রস্তাবিত পাকিস্তান ভারতের অংশ বিশেষকে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ব্যবসায়ী বা পেশাজীবীদের প্রভাব বলয় থেকে পৃথক করবে বলে অঙ্গীকার করে। এতে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠা লাভ এবং নতুন গড়ে উঠা মুসলিম বুদ্ধিজীবীগণ চাকরি গ্রহণ করতে পারবে। তুলনামূলকভাবে বড় মুসলিম পুঁজিপতিদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। ১৯৪৭ সালের পূর্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাঞ্জাবে বড় ধরনের কোন শিল্পকারখানা ছিল না বললেই চলে। অবশ্য এতদ্অঞ্চলে উন্নত কৃষি ব্যবস্থার সাথে জড়িত ক্ষুদ্র মাপের কিছু উদ্যোক্তার আবির্ভাব ঘটে। প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় বড় পুঁজিবাদের প্রতিযোগিতার কবল থেকে রক্ষা করে পাকিস্তান এ সকল লোকের জন্য আর্থিক সুবিধাদি লাভের ব্যবস্থা করে দেয়।

পাকিস্তান আন্দোলনকে আদর্শিকভাবেও প্রতিষ্ঠিত হতে হয়েছে। হিন্দু নেতাদের অনুরূপ কিছু মুসলমান ব্যক্তিত্বও দ্বি-জাতি তত্ত্বের সমালোচনায় নেমে পড়লেন। মুসলমান ব্যক্তিত্বের অন্যতম দেওবন্দি মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী। তিনি যুক্ত জাতীয়তা ও ইসলাম শিরোনামে এক খানা পুস্তিকা প্রণয়ন করেন। তিনি যুক্ত জাতীয়তার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে পুস্তিকায় লেখেন, “যুক্ত জাতীয়তার বিরোধীতা ও তাকে ধর্ম বিরোধী আখ্যায়িত করা সংক্রান্ত যে সব ভ্রান্ত ধারণা প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে, তার নিরসন করা অত্যাবশ্যক বিবেচিত হলো। ১৮৮৫ সাল থেকে কংগ্রেস ভারতের জনগণের কাছে স্বাদেশিকতার ভিত্তিতে জাতিগত ঐক্য গড়ার আবেদন জানিয়ে অব্যাহতভাবে জোরদার সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। আর তার বিরোধী শক্তিগুলি সেই আবেদন অগ্রহণযোগ্য, এমনকি অবৈধ ও হারাম সাব্যস্ত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের জন্য এ জাতিগত ঐক্যের চাইতে ভয়ংকর আর কিছুই নেই, এ কথা সুনিশ্চিত। এ জিনিসটা ময়দানে আজ নতুন আবির্ভূত হয়নি, বরং ১৮৮৭ সাল বা তার পূর্ব থেকে আবির্ভূত। বিভিন্ন শিরোনামে এর ঐশী তাগিদ ভারতীয় জনগণের মন মগজে কার্যকর করা হয়েছে। তিনি আর এক ধাপ এগিয়ে বলেন,“ আমাদের যুগে দেশ থেকেই জাতির উৎপত্তি ঘটে থাকে। এতএব হিন্দু মুসলিম এক জাতি, আমরা সবাই ভারতীয়”

মওলানা সাহেবের এই পুস্তিকা প্রকাশিত হওয়ার পর নির্ভেজাল তাত্ত্বিক দিক দিয়ে জাতীয়তাবাদের বিষয়ে পুংখানুপুংখ বিচার গবেষণা চালিয়ে মওলানা মওদূদী রহ. রচনা করেন “ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ” পুস্তক। তিনি যুক্ত জাতীয়তাবাদের পক্ষের সব যুক্ত খণ্ডন করে দেখিয়েছেন যে, সমগ্র পৃথিবীর গোটা মানব বসতিতে মাত্র দু’টি দলের অস্তিত্ব রয়েছে; একটি আল্লাহর দল অপরটি শয়তানের দল। তাই এই দুই দল মিলে কখন এক জাতি হতে পারে না, যেমন পারে না তেল ও পানি মিশে এক হয়ে যেতে। মওলানার এই বই তখন রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে।

//মাওলানা মওদূদী রহ. বলেন, অমুসলিম জাতি সমূহের সাথে মুসলিম জাতির সম্পর্কের দু’টি দিক রয়েছে। প্রথমটি এই যে মানুষ হওয়ার দিক দিয়ে মসলিম-অমুসলিম সকলেই সমান। আর দ্বিতীয়টি এই যে, ইসলাম ও কুফরের পার্থক্য হেতু আমাদেরকে তাদের থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র করে দেয়া হয়েছে। প্রথম সম্পর্কের দিক দিয়ে মুসলিমরা তাদের সাথে সহানুভূতি, দয়া ঔদার্য ও সৌজন্যের ব্যবহার করবে। কারণ মানবতার দিক দিয়ে এরূপ ব্যবহারই তারা পেতে পারে। এমনকি তারা যদি ইসলামের দুশমন না হয়, তাহলে তাদের সাথে বন্ধুত্ব, সন্ধি এবং মিলিত উদ্দেশ্যের (Common Cause) সহযেগিতাও করা যেতে পারে। কিন্তু কোন প্রকার বস্তুগত ও বৈষয়িক সম্পর্ক তাদেরকে ও আমাদেরকে মিলিত করে ‘একজাতি’ বানিয়ে দিতে পারেনা।

তিনি আরো বলেন, যেসব গন্ডীবদ্ধ, জড় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও কুসংস্কারপূর্ণ ভিত্তির উপর দুনিয়ার বিভিন্ন জাতীয়তার প্রাসাদ গড়ে উঠেছে আল্লাহ ও তাঁর রসুল তা চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেন। বর্ণ, গোত্র, জন্মভূমি, অর্থনীতি ও রাজনীতিক অবৈজ্ঞানিক বিরোধ ও বৈষম্যের ভিত্তিতে মানুষ নিজেদের মূর্খতা ও চরম অজ্ঞতার দরুণ মানবতাকে বিভিন্ন ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খন্ডে বিভক্ত করেছিল, ইসলাম তার সবগুলোকে আঘাতে চূর্ণ করে দেয় এবং মানবতার দৃষ্টিতে সমস্ত মানুষকে সমশ্রেণীর সমমর্যাদাসম্পন্ন ও সমানাধিকার প্রধান করেছে। ইসলামী জাতীয়তায় মানুষে পার্থক্য করা হয় বটে, কিন্তু জড়, বৈষয়িক ও বাহ্যিক কোন কারণে নয়। করা হয় আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিকতার দিক দিয়ে। মানুষের সামনে এক স্বাভাবিক সত্য বিধান পেশ করা হয় যার নাম ইসলাম। আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য, হৃদয়মনের পবিত্রতা ও বিশুদ্ধতা, কর্মের অনাবিলতা, সততা ও ধর্মানুসরণের দিকে গোটা মানব জাতিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তারপর বলা হয়েছে যে, যারা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করবে,তারা এক জাতি হিসাবে গণ্য হবে আর যারা তা অগ্রাহ্য করবে, তারা সম্পুর্ণ ভ্ন্নি জাতির অন্তর্ভুক্ত হবে। অর্থাৎ মানুষের একটি হচ্ছে ঈমান ও ইসলামের জাতি এবং তার সমস্ত ব্যক্তিসমষ্টি মিলে একটি উম্মাহ। অন্যটি হচ্ছে কুফর ও ভ্রষ্টতার জাতি।//

দ্বি-জাতি তত্ত্ব হঠাৎ করে তৈরি হওয়া কোন তত্ত্ব নয়। এ তত্ত্ব মানুষের সৃষ্টি থেকে, বিশেষ করে ইসলামের আবির্ভাব থেকে সমাজে সুস্পষ্ট ছিল। রসুল সা. বলেছেন “আল কুফরু মিল্লাতুন ওয়াহেদা”- সমস্ত কুফর জাতি এক জাতি এবং “আল মুসলেমু আখুল মুসলিম” এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। এ এক চরম সত্য। যেহেতু মুসলিম ধর্মের মূল শিরক বিবর্জিত ওহদানিয়াতের প্রতি বিশ্বাস ও তদানুযায়ী জীবনাচার। এই বিশ্বাসের রূপরেখা প্রতিফলিত হয় মুসলিম সংস্কৃতিতে ও এরই সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ চরিত্র দিয়ে। কুরআন ধর্মের একত্বের উপরে জোর দিয়ে একে ঈমানের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করেছে। যে কারণে দেশের, ভাষার বিভিন্নতা সত্ত্বেও গোটা বিশ্বের মুসলিম সংস্কৃতিতে ঐক্যের সুর বিরাজমান। সব মুসলমান এক জাতি।

পঠিত : ২২৭২ বার

মন্তব্য: ০