Alapon

আওয়ামী লীগ সরকার কি তবে ভারতের প্রতি নির্ভরশীলতা কমাতে যাচ্ছে...?


করোনা ভাইরাসের এই মহামারীর সময়েও ‘যুদ্ধ’ বিষয়ক আলোচনাই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ, দিন কয়েক আগেই চীন-ভারত সীমান্তে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়ে গেল। সেই সংঘর্ষে চীনের কতজন সৈন্য নিহত ও আহত হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য জানা না গেলেও ভারতের ২০ সৈন্য নিহত ও ৭০ জন আহত হয়েছে। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে নিহত ও আহতের প্রকৃত সংখ্যা সবসময় অগোচরেই থেকে যায়, তাই এ কথা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে ভারতের সৈন্য আহত ও নিহতের সংখ্যা আরও বেশি।

সে যাইহোক, আমার আলোচনার বিষয় সেটা নয়। আমার আলোচনার বিষয় ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এবং বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সাথে তাদের ব্যবহার।

এই যুদ্ধের কারণে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কটি সামনে চলে এসেছে। বাংলাদেশে শাসনক্ষমতায় ভারতের পরীক্ষিত বন্ধু আওয়ামী লীগ থাকলেও, চীনের সাথে বিবাদমান পরিস্থিতিতে তারা বাংলাদেশ থেকে কোনো সহায়তা পায়নি। এমনকি বাংলাদেশ এই পরিস্থিতি নিয়ে একটা শব্দও ব্যবহার করেনি। এটাও সমস্যা ছিল না। কিন্তু এই সংঘর্ষের একদিন পরই চীন বাংলাদেশের পন্যের জন্য শুল্কমুক্তের ঘোষণা প্রদান করে। আর এই ঘোষণাই ভারতের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ঘোষণা আর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরের চীন-ভারতের বিবাদমান সংঘর্ষ নিয়ে তাদের পক্ষ অবলম্বন না করায় ভারত যেন বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে। ভারত কেন হঠাৎ করে বাংলাদেশকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে, আজ আমরা সেই বিষয়গুলোই জানার চেষ্টা করব।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের অদৃশ্য হস্তক্ষেপ বহু পূর্ব থেকেই ছিল, এ কথা সবারই জানা। এমনকি বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ভোটার বিহীণ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকার পিছনেও যে ভারতের শক্ত ভূমিকা ছিল, এ কথা সর্বজনবিদিত। অবশ্য ভারত এমনি এমনি আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসায়নি। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগকে দিতেও হয়েছে অনেক।

ভারতের সহযোগীতায় ২০১৪ নির্বাচনে চুরি করে জিতার বদৌলতে বাংলাদেশ সরকার স্বেচ্চায় কিংবা আধিপত্যবাদী ভারতের চাপে পড়ে বহু কিছু হারিয়েছে-

১। নতজানু সরকার ভারত থেকে পানি হিস্যা আদায় করতে পারেনি। যৌথ নদী কমিশনের একাধিক বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোন দাবী ও এজেন্ডা না থাকায় এই বৈঠক আর বসছে না বহু বছর। এদিকে শুষ্ক মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের মরুকায়ন তীব্রতর হয়েছে, তিস্তার পানি পুরোপুরি প্রত্যাহার করেছে। যমুনায় ইতিহাসের সর্ব নিন্ম পানি প্রবাহিত হয়েছে শুষ্ক মৌসুমে। বিগত বছরে ধীরে ধীরে গঙ্গা ব্যারেজের গেইট খোলার পরিবর্তে একযোগে ১১৯টি স্লুইস গেইট খুলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে হঠাত বন্যা তৈরি করে ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত ক্ষতি করেছে ভারত। যদি বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কই থেকে থাকে ভারত কেন সম্ভাব্য বৃষ্টিপাতের পরিমাপ সাপেক্ষে গঙ্গা ব্যারেজের গেইট খোলে না। মেটেরিও স্যাটেলাইট দেখে বর্তমান সময়ে এই কাজটি এত সহজ হলেও কেন বার বার শুকনা মৌসুম না পেরুতেই বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গ তলিয়ে যায়?

২। ভারতীয় চাপে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বন্ধ হয়েছে। ভারত বিগত ১২ বছরে ধরে গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্প বন্ধ রেখেছে, এতে করে ২০২৬ এ আসন্ন গঙ্গা পানি চুক্তির নেগোসিয়েশান কৌশলে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।

৩। ভারত তেল উৎপাদনকারী না হয়েও বাংলাদেশে ডিজেল বিক্রি করছে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে উচ্চ দামে। অভিযোগ উঠেছে এই ডিজেল সঠিক মানে পরিশোধিত নয়, এতে উচ্চ পরিমাণ সালফার সহ পরিবেশ ধ্বংসকারী উপাদান আছে। তেল উৎপাদনকারী না হয়েও, পৃথিবীর এভারেজ থেকে নিচের মানের কয়লার মুজদদারী ভারত থেকে ঠিক কোন যুক্তিতে বাংলাদেশকে ভারত থেকে তেল ও কয়লা কিনতে হবে? যেখানে আমেরিকার ফ্রেকিং এবং রাশিয়ার ব্যাপক প্রডাকশনের পরে তেলের বাজারে সারপ্লাস বিরাজ করছে?

৪। চাহিদা না থাকা ভারতীয় কয়লা বিদ্যুৎ ক্রস বর্ডার বিদ্যুতের নামে বিক্রি করছে। বাংলাদেশ তার বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার অর্ধেকেরও কিছু বেশি বসিয়ে রাখলেও বর্তমানে ভারত থেকে দুটি হাব দিয়ে দিনে ৭৫০ মেগাওয়াটের মত বিদ্যুৎ কিনে লোকসান দিয়ে যাচ্ছে।

৫। ভারত নিজের অব্যবহৃত নিন্ম মান কয়লা দিয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল এবং সুন্দরবন নষ্টের জন্য রাপমাল সহ একাধিক কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশে ব্যাপক নাগরিক অসন্তুষ্টিকে আমলে নেয়নি তারা। যৌথ বলা হলেও মাত্র ১৫% মালিকানা দিয়ে উল্টো রামপাল সহ কয়লা প্রকল্প গুলোতে বাংলাদেশকে ভারতীয় ঋণ নিতে হয়েছে।

৬। কভিড-১৯ এর আগেই বাংলাদেশের যেখানে নূন্যতম ৪ কোটি ৮২ লক্ষ লোক বেকার সেখানে বাংলাদেশের ভারতীয়দের ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে। করোনা কালে ভারত তার শ্রমিকদের ফিরিয়ে নিতেও গড়িমসি করেছে।

৭। টোল না দিয়ে, রাস্তা নির্মাণ খরচ না দিয়ে, রাস্তা রক্ষণাবেক্ষণ খরচ না দিয়ে ভারত প্রায় ফ্রি স্থল ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করছে। উল্টো রাস্তা নির্মানে ভারত উচ্চ সুদে বাংলাদেশকে ঋণ নিতে বাধ্য করেছে।

৮। ড্রেজিং খরচ না জুগিয়ে ভারত প্রায় ফ্রি নৌ ট্রানজিট সুবিধা ভোগ করছে।

৯। নিজস্ব দুটি সাবমেরিন ল্যান্ডীং স্টেশান থাকার পরেও, সরকারি খাতে অন্যায্য দাম, খুরুচে ট্রান্সমিশান পথ আর কুয়াকাটায় কারিগরি সমস্যা জিইয়ে রাখায়, বেসরকারি কোম্পানি সামিট ও ফাইবার এট হোম এর ক্রস বর্ডার ইন্টারনেট ব্যবসা চালু আছে।

১০। চট্রগ্রাম সমূদ্র বন্দর ক্যাপাসিটি স্বল্পতায় ভুগলেও ভারতীয় কোম্পানি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চট্রগ্রাম সমূদ্র ব্যবহার করার চুক্তি করে নিয়েছে।

১১। বাংলাদেশের কমার্শিয়াল মেরিটাইম জোনে ভারতীয় রাড়ার বসার চুক্তি হয়েছে। ভারত নিজে সমরাস্র ক্রয়ের শীর্ষ দেশ হলেও বাংলাদেশকে ভারত থেকে নিন্ম মান সমরাস্র কিনতে হচ্ছে। সেখানেও বাংলদেশকে ভারতীয় ঋণ ধরিয়ে দিয়েছে। ভারতীয় নৌ সেনা ও নৌ সেনা আশ্রিত দস্যুরা বাংলাদেশের পাথরঘাটা ও সুন্দরবনের উপকূলীয় জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করে, মাছ ডাকাতি করে এবং ট্রলার ডুবিয়ে দেয় বলে বহু অভিযোগ আছে।

১২। বাংলাদেশের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পরামর্শক হিসেবে ঢুকে গেছে ভারত সম্পূর্ণ অযাচিত ভাবে, যেখেন নির্মাণকারী দেশ প্রযুক্তির মূল স্বত্বাধিকারী রাশিয়া নিজেই।

১৩। বাংলাদেশের সংসদে উপস্থাপিত সরকারি তথ্য মতেই ভারত বিগত এক দশকে সীমান্তে ২৯৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। (সীমান্ত অপরাধ প্রায় সাড়ে চার হাজারের বেশি)।

১৪। ভারতে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রিতে পরোক্ষ শুল্কারোপ অব্যহত আছে। পাটের উপর এন্টি ডাম্পিং নীতিমালা বসিয়ে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত শিল্পকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে।

১৫। বাংলাদেশ ভারতের শীর্ষ রেমিটেন্স সংগ্রহকারী দেশের অন্যতম হলেও ভারতে বাংলাদেশীদের ওয়ার্ক ভিসা এখনও প্রকৃতভাবে উন্মুক্ত হয়নি।
(তথ্যসূত্র: ফাইয়েজ তাইয়েব আহমদের কলাম)

হাসিনার চীনের প্রতি নির্ভরশীলতার কারণ

অবৈধ পন্থায় ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে শেখ হাসিনা সরকারকে ব্যবসায়ীদের কাছে অসহায়ত্ব বরণ করতে হয়েছে। এমনকি নিজ দলীয় ব্যবসায়ীরাও সরকারের এই ‍দুর্বলতাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে কার্পন্য বোধ করেনি। ব্যবসায়ীরা সরকারের চোখের সামনে দিয়েই হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে। তারপর সালমান এফ রহমানের মত আওয়ামী ব্যবসায়ীরা শেয়ার বাজারের কমর ভেঙ্গে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে, একই সাথে ব্যাংক থেকে শত হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে নিজেকে দেউলিয়া হিসেবে ঘোষণা করে ঋণ খেলাপির খাতায় নাম লিখিয়েছে। পরবর্তিতে দেশের প্রায় সব বড় বড় ব্যবসায়ী ঋণ খেলাপীর খাতায় নিজের নাম লিখিয়ে দেশের প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর সাড়ে সর্বনাশ করেছে।

যার কারণে দেশ চালাতে সরকারের দরকার ঋণের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু সরকারের প্রয়োজন এমন ঋণ যে ঋণের কোনো জবাবদিহিতা থাকবে না। অন্যদিকে ভারত বন্ধু রাষ্ট্র হলেও ভারতের ঋণের জবাবদিহিতা রয়েছে। সেই সাথে ঋণ প্রদান কালে ভারত নিজেরাই খরচের খাত দেখিয়ে দেয়। হয় ভারতের ঋণের টাকায় ভারত থেকে পণ্য আমদানি করতে হবে, অথবা ভারত থেকে সামরিক সামগ্রি ক্রয় করতে হবে। ফলে এই ঋণ সরকারের তেমন একটা কাজে আসবে না। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসে নব্য পরাশক্তির দেশ চীন। এ কথা প্রায় সকলেই জানে চীনের ঋণে কোনো জবাবদিহিতা নেই। চীন বিনা শর্তে বিভিন্ন দেশকে ঋণ সুবিধা প্রদান করে থাকে।

আপনাদের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং বাংলাদেশ সফরে আসে। সে সফলে শি জিংপিং বাংলাদেশের জন্য প্রায় ২ হাজার চারশো কোটি টাকা অর্থ সহায়তা ও বিনিয়োগ সুবিধা প্রদান করে বলে বিভিন্ন মাধ্যম মারফত জানা যায়। আর এভাবেই বাংলাদেশে চীনের টাকা প্রবেশ করতে শুরু করে। যদিও তখন ভারত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি রুষ্ঠ হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা তাতে খুব একটা কর্নপাত করেনি। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের অর্থনীতি চীনের উপর নির্ভরশীল হতে শুরু করে, আর আওয়ামী লীগ সরকারের ভারতের সাথে সম্পর্ক শীথিল হতে শুরু করে।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের ভোটার বিহীণ নির্বাচন নিয়ে স্বয়ং ভারতই বিষ্ময় প্রকাশ করেছিল। ইন্ডিয়ান টাইমস- এর একটি কলাম থেকে জানা যায়- ‘বাংলাদেশে যে এমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সে তথ্য ভারতেরও অজানা ছিল।’

আর তখন থেকেই আমার অনুধাবণ হয়েছিল, গণভবনে ভারত বলয়ের যে শক্তিশালী অবস্থান ছিল তা দিনকে দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের হাতে যেহেতু আওয়ামী লীগ ছাড়া বিকল্প কোনো শক্তিও নেই, তাই শেখ হাসিনা সরকারও ভারতকে টপকে চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছে। বলতে পারেন, অনেকটা বাধ্য হয়েছে। যদিও চীনের ঋণ খুব মারাত্মক ঋণ! কারণ, শ্রীলংকাকে ইতোমধ্যেই চীনের ঋণের ফাঁদে পড়ে হাম্বানটোটা সমুদ্র বন্দর ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে বন্ধক রাখতে হয়েছে। আমাদের যে কী বন্ধক রাখতে হয় সেটাই ভাবনার বিষয়!

আর চীনের সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির সাথে সাথে হাসিনা সরকারও ভারতের যেকোনো কাজে অকুন্ঠ সমর্থন প্রদান বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও হাসিনা সরকার চীন ও ভারতের বিবাদমান পরিস্থিতিতে কোনো পক্ষ অবলম্বন করেনি। তবে কিছুদিন পরে এরূপ পরিস্থিতিতে হাসিনা সরকার চীনের পক্ষ অবলম্বন করে তাতে খুব একটা অবাক হওয়ার কিছু থাকবে বলে মনে হয় না।

পঠিত : ৫৯০ বার

মন্তব্য: ০