Alapon

শায়খ আবু বকর জাকারিয়া ও মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ...


১.

শায়খ আবু বকর মোহাম্মাদ জাকারিয়া, মতিউর রহমান মাদানী, মুজাফফর বিন মুহসিন, আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ। সালাফী ঘরানার কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলিম।

তবে তারা কেউ আমার ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় নেই।

দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে তাদের এপ্রোচ আমার কাছে আক্রমনাত্মক মনে হয়। তারা ভিন্নমতের মানুষদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কঠোর মনোভাব পোষণ করেন। কখনও কখনও তাদের ভাল কাজের স্বীকৃতি না দিয়ে ভুল ভ্রান্তি নিয়েই কথা বলেন বেশি। ব্যক্তিগতভাবে অতি আক্রমনাত্মক মনোভাবের মানুষ আমার পছন্দ নয়।

তবে আলিম হিসেবে আমি তাদের সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি। ভিন্নমত থাকা সত্বেও তাদের মর্যাদা হানি হয়, এমন কোন কথা না বলাকেই উত্তম মনে করি।


সম্প্রতি শায়খ আবু বকর মোহাম্মাদ জাকারিয়া তাফসির নিয়ে আলোচনা/সমালোচনা চলছে। অভিযোগ এসেছে, তার লিখিত তাফসিরের একটা বিশাল অংশ বিভিন্ন তাফসির থেকে হুবহু কপি পেস্ট করা।

গবেষনা কর্মের ক্ষেত্রে গবেষকেরা বিভিন্ন লেখকের দেওয়া তথ্য উপাত্তের সাহায্য নেন। কখনও কখনও ভিন্ন লেখক/গবেষকের বক্তব্য নিজের ভাষায় বর্ননা করেন। কখনও তাদের বক্তব্য হুবহু তাদের ভাষায় উদ্ধৃত করেন। এক্ষত্রে নিয়ম হল, অন্য লেখক/গবেষকের লিখা বইয়ের উদ্ধৃতি দেয়া, স্বীকৃতি দেয়া।

কিন্তু শায়খ আবু বকর জাকারিয়া তা করেন নি। তিনি অন্য তাফসিরের ভাষা দাড়ি কমা সহ লাইন বেলাইন হুবহু কপি করেছেন। কোন রেফারেন্স দেন নি।


তিনি ও তার পক্ষের লোকদের দাবী, অন্য তাফসির ও তার লিখিত তাফসির একই উৎস থেকে নেয়া। তাই দুটোর মধ্যে মিল থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

কিন্তু তার এই দাবী অত্যন্ত দুর্বল ও অগ্রহনযোগ্য। ধরে নিলাম, উভয়ই ইবনে কাসিরের দেয়া তথ্য নিজ নিজ তাফসিরে গ্রহন করেছেন। কিন্তু দুজনের অনুবাদ কখনই এক হবে না। ভাষা, বাক্য গঠন, শব চয়নে বিস্তর পার্থক্য থাকবে। কোন অনুবাদক যদি অন্য কোন অনুবাদকের লিখা হুবহু নিজের অনুবাদে রেফারেন্স ছাড়া কপি করেন, তাকে আর অনুবাদ বলা যায় না। এটাকে বলে প্লেগিয়ারিজম। সোজা বাংলায় চৌর্যবৃত্তি। এটা যে কোন গবেষনা কর্মের প্রথম পাঠ। নুন্যতম এই জ্ঞান না থাকলে গবেষনা করা যায় না। পৃথিবীর বিভিন্ন নামী দামী ইউনিভার্সিটিগুলো এই মানদন্ড কঠিনভাবে অনুসরণ করে থাকে।

কোন থিসিস পেপার জমা দেয়া হলে ভার্সিটি কতৃপক্ষ মিলিয়ে দেখে, এই লিখার সাথে অন্য কোন লিখার হুবহু মিল আছে কি না।


শায়খ জাকারিয়া লিখিত তাফসিরের সমস্যা এখানেই। তিনি অন্য তাফসিরের বাংলা অনুবাদ থেকে দাড়ি কমা লাইন ধরে ধরে কপি করেছেন। রেফারেন্স দেন নি।

হুবহু কারও লেখা তুলে ধরা হলে নিয়ম হল, কোট করা। তিনি সেটাও করেন নি। গোটা তাফসিরের কোথাও তিনি তাফসিরকারকের নাম কিংবা কার থেকে সাহায্য নিয়েছেন তার উল্লেখ করেন নি।

বরং বিভিন্ন সময়ে সেই তাফসিরকারকের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তার লিখিত বই/কিতাব পাঠ করা থেকে সবাইকে বিরত থাকতে বলেছেন।

এটা এক ধরনের দ্বিচারিতা। কারও ভাল কাজের মুল্যায়ন না করে, সবাইকে তার থেকে দূরে থাকার কথা বলে, নিজে তারই লিখার হুবহু অনুসরণ করা নিসন্দেহে একটা বাজে দৃষ্টান্ত।

দুঃখের বিষয় হল, তিনি এর জন্য ভুল স্বীকার করেন নি। উলটো এমন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা তার মত একজন পিএইচডি গবেষকের জন্য রীতিমত বেমানান।


কিছুদিন পুর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠেছিল। দেখা গেল, তাদের লিখিত পেপার মিশেল ফুকো নামক এক দার্শনিকের লিখার হুবহু কপি পেস্ট।

এটা নিয়ে সমালোচনা হলে তারা এর পক্ষে সাফাই গান নি। বলেন নি, মিশেল ফুকো আর তারা একই ব্যক্তি থেকে তথ্য নিয়েছেন। তাই এত মিল।

ইসলামী অংগনের মানুষদের কাছ থেকে আমরা উন্নত নৈতিক আদর্শ প্রত্যাশা করি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব ক্ষেত্রে কখনও কখনও তারা গোজামিলের আশ্রয় নেন। মানুষের সামনে নিজেরা ছোট হন। আলিম উলামাদের ছোট করেন।

২.

এতো গেল মুদ্রার একটি। অন্য আরেকটি দিকও আছে।

ড আব্দুল্লাহ জাহাংগির রাহিমুহুল্লাহ একটা কথা প্রায়ই বলতেন “আমরা ব্যক্তির সমালোচনা করি না। কর্মের সমালোচনা করি। একজন মানুষের মধ্যে ভুল ত্রুটি থাকতে পারে। কিন্তু তার জন্য তার জীবনের অন্য অনেক ভাল কাজ নষ্ট হয়ে যায় না।“

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলতেন “মনে করুন, একটা টুকরো গু। আমি যদি এই গু এক গ্লাস পানিতে ছেড়ে দেই, তাহলে কি হবে? গুও নাপাক, পানিও নাপাক। কিন্তু এই গু যদি আমি মহা সমুদ্রে ছেড়ে দেই? গু নাপাক। কিন্তু পানি? পানি পাক। সমুদ্রের বিশাল জলরাশির তুলনায় গু কিছুই না”

ভুল ত্রুটি নিয়েই মানুষ। কোন মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু কিছু ভুলের জন্য তার ভাল কাজের গুরুত্ব কমে যায় না।

শায়খ আবু বকর জাকারিয়া নিয়ে যারা সমালোচনা করছেন, তারাও অনেকক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করেছেন। বাড়াবাড়ি করেছেন।

তার সমালোচনা করতে গিয়ে অনেকেই এমন সব শব্দ ব্যবহার করছেন যা অনুচিত, অন্যায়। কেউ কেউ শায়খের ছবি দিয়ে তার সাথে ট্যাগ লাগিয়ে দিচ্ছেন “চোরা জাকারিয়া! চোরা শায়খ!” (আস্তাগফিরুল্লাহ...নাউজুবিল্লাহ)

যেন তিনি কোন আলিম নন। “ট্যারা কামাল” “জর্দা জামাল” এর মত গলির ধারের ঊঠতি কোন সন্ত্রাসী (!!??)

শায়খ জাকারিয়া অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন একজন মানুষ। বাংলা ভাষায় তার লিখিত বই ও অনুবাদের সংখ্যা অনেক। এছাড়াও তিনি অসংখ্য বই সম্পদনা করেছেন। দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।

তাফসিরের ক্ষেত্রে তিনি যে কাজটি করেছেন তা গ্রহনযোগ্য নয়। তার এই ভুলের কারণে ইসলামের জন্য তার অন্যান্য খেদমত মিথ্যে হয়ে যায় না। গুরুত্ব হারায় না।আ

ফেসবুকের কারণে একটা বিশাল ‘ফেসবুক কসাই’ প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে। যারা ছুরি কাচি নিয়ে সব সময় তৈরি থাকেন। কারও কোন ভুল ত্রুটি, দোষ, আচরনে সমস্যা কিংবা বক্তৃতায় দু একটা শব্দের এদিক সেদিক পেলে আর রক্ষে নেই। সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন। ব্যংগ বিদ্রুপ ট্রলের জোয়ারে নিউজফিড ভাসিয়ে তোলেন।

ভুল ভ্রান্তি সবারই আছে। উম্মতের সোনালী যুগের মানুষদেরও ভুল ভ্রান্তি ছিল। কিন্তু তাদের কর্মের বিশাল মহাসগরের কাছে সেই সব ভুল ত্রুটি তুচ্ছ।

ভাগ্যিস তাদের জন্ম এই যুগে হয় নি। নইলে আজকের ‘ফেসবুক কসাই’দের হাত থেকে তারাও নিস্তার পেতেন না।

প্রিয় ভাইয়েরা, আসুন ভারসাম্যপুর্ণ আচরন করি। যিনি যে অবস্থার মানুষই হন না কেন, তার ভুলকে আমরা ভুলি বলি। কিছু ভুলের জন্য একজন মুসলিম ভাইয়ের ভাল কাজগুলোকে অব্যমুল্যায়ন না করি। বিশেষ করে আলিমদের সম্পর্কে মর্যাদা হানিকর শব্দ চয়ন থেকে বিরত থাকি।

আলিমগন উম্মতের কান্ডারি। তাদের প্রতি দরদ থাকাটা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। তাদের ভুল/অন্যায়ের কারণে তাদের প্রতি দ্বীনি ভালবাসায় আমাদের যেন ঘাটতি না হয়।

তাদের ভাল কাজগুলো আমরা সমর্থন করব। তাদের ভুলগুলো এড়িয়ে চলব। এর মাঝেই আমাদের জন্য কল্যান রয়েছে।

আল্লাহ আমাদের তাওফিক দিন। আমিন।

পরিশিষ্টঃ

অনেক ভাই মন্তব্য করছেন "ঢিল ছুড়লে পাটকেল খেতে হয়"। তিনি কখনও কখনও অন্য আলেমদের নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেছেন। তাই মানুষ আজ সুযোগ পেয়ে পালটা কটুক্তি করছে।

তাদেরকে বলি, যার যার কর্মের জন্য তিনিই দায়ী। তার এই কাজকে আমরা পছন্দ করছি না। তাহলে আমরা নিজেরা কেন একই কাজ করছি? তাহলে আর আমরা আলাদা করে ভাল হলাম কি করে?

তিনি তার কথা ও কাজের জন্য দায়ী থাকবেন। একইভাবে আমাদের কথা ও কাজের জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে আমাদেরকেই জবাবদিহী করতে হবে।

তাই, তিনি কি করেছেন সেটা না ভেবে বরং আমরা কি করছি, তা ভাবা উচিৎ। একজন আলিমের ক্ষেত্রে শব্দ চয়নে আরো সতর্ক হওয়া উচিৎ।

- সামছুর রহমান

পঠিত : ১০১৪ বার

মন্তব্য: ০