Alapon

কাগজ-কলমে দেশের অর্থনীতির অবস্থা আর বাস্তবতার মাঝে যত ফারাক...


কয়েক মাস আগের কথা, গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে আবার ডিশ নাই। তাই সময় কাটানো বা বিনোদনের জন্য সেখানে বিটিভিই ভরসা। তো বিটিভিতে একটা বিজ্ঞাপন দেখলাম। বিজ্ঞাপনটা ঠিক এমন, একজন লোকের বাবা মারা গেছে। তো সামাজিক নিয়মনুসারে কেউ মারা গেলে কুলখানি করা হয়। তো সেই লোক পাশ্ববর্তি গ্রামের কতক গরীব মানুষকে দাওয়াত করতে গেছে। তারা কুলখানির দাওয়াত শুনে সেই লোকের উপর যার পর নাই রেগে গেছে। রেগে যাওয়ার এক পর্যায়ে তারা সেই লোককে মারার জন্য ধাওয়া করে। আর জীবন বাঁচানোর তাগিদে সেই লোকও জীবন হাতে নিয়ে ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে গ্রামের মাতব্বরের সামনে গিয়ে হাজির হয়।

মাতব্বর সাহেব উত্তেজিত জনতাকে জিজ্ঞেস করে, ঘটনা কী? তোমরা তাকে মারতে চাচ্ছো কেন? তার অপরাধটা কী?

তখন উত্তেজিত জনতার মধ্য থেকে একজন বলে, এই লোক আমাদের মিসকিন মনে করে তার বাবার কুলখানির দাওয়াত দিতে গেছে।

তখন মাতব্বর সাহেব বলেন, তোমরা তো একসময় মিসকিনই ছিলা!

তখন উপস্থিত জনতা বলে, এক কালে ছিলাম সত্য! কিন্তু এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের বদৌলতে আমাদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়েছে। এখন আমাদের গোলা ভরা ধান আছে, পুকুর ভরা মাছ আছে। এখন আর আমাদের কোনো অভাব নাই। দেশে আর কোনো গরীব মানুষই নাই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের মাধ্যমে সকলের ভাগ্য বদলিয়ে দিয়েছেন।

সরকারি উন্নয়নের বিজ্ঞাপন।

এবার বিজ্ঞাপন ছেড়ে বাস্তব ময়দানে আসি। আপনাদের মনে আছে কিনা জানি না, ২০২০ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারী সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন বাংলাদেশের অর্থনীতি সিঙ্গাপুরের চেয়েও শক্তিশালী

আমাদের দেশের অর্থনীতি নাকি সিঙ্গাপুরের চেয়েও শক্তিশালী, অথচ করোনা ভাইরাসের কারণে মাত্র ৩ মাস লক ডাউন থাকার পর খোদ রাজধানী ঢাকাতেই জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ঢাকার পরিস্থিতি যেন এখন একটা যুদ্ধবিধ্বস্থ নগরীর মত। রাস্তায় বেরুলেই দেখা যায়, মানুষ ট্রাক বোঝাই করে জীবনের সহায়-সম্বল নিয়ে গ্রামের দিকে ছুটছে। যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সিঙ্গাপুরের চেয়েও শক্তিশালী সে দেশে মাত্র ৩ মাস লক ডাউন থাকার পর দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার দশা।

আমার পরিচিত এক অ্যাডভোকেটের কথা বলি। করোনা ভাইরাসের আগেও তার মাসিক ইনকাম ছিল ৫০ হাজারের উপরে। মার্চের শেষে লক ডাউন ঘোষণা করার আগে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সর্বশেষ এই মাসে তিনি ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ গ্রামে চলে গেছেন। কারণ, এই শহরের যে বাড়ি ভাড়া এবং দৈনন্দিন জীবন-যাপনে যে ব্যয় তাতে টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

আরও সহজ করে যদি বলি, মাত্র তিন মাসের লক ডাউনে দেশের উচ্চ মধ্যবিত্তরা পরিণত হয়েছে মধ্যবিত্তে। নিম্ন মধ্যবিত্তরা পরিণত হয়েছে নিরেট গরীব মানুষে। কাগজে কলমে এবং জিডিপির হিসাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী হলেও বাস্তবিক অর্থে দেশের অর্থনীতি মোটেও শক্তিশালী নয়। নুন্যতম শক্তিশালী হলেও মাত্র তিন মাসে ঢাকা শহরের চিত্র এমন যুদ্ধ বিধ্বস্থ নগরীর রূপ ধারণ করতো না।

দুদিন আগে পত্রিকায় পড়লাম, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় নাকি ভারতের মাথাপিছু আয়কেও ছাড়িয়ে গেছে। স্টাটিস্টিকার তথ্য অনুযায়ী ভারতের মাথাপিছু আয় ২০২০ অর্থবছরে ছিল ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮ ভারতীয় রুপি। শুক্রবার (২৬ জুন) ডলারের বিপরীতে ভারতের রুপির দর ছিল ৭৫ দশমিক ৪৯ রুপি। সেই হিসাবে ডলারে রূপান্তর করলে ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৭৮৯ মার্কিন ডলার।

বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ অর্থবছরে ভারতের মাথাপিছু আয় করোনার কারণে কমবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মাথাপিছু আয় হবে ১ দশমিক ৪৩ লাখ রুপি। সেই হিসাবে ডলারে এর মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৮৯৫ ডলার।

এদিকে সিইসডাটা ডটকমের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে ভারতের মাথাপিছু আয় ছিল ডলারে ২ লাখ ১৩ হাজার ৯ দশমিক ২২ ডলার। একই সময়ে ২০১৯ সালে ছিল ২ হাজার ৪৪ দশমিক ৫৮৬ ডলার।

বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় গতবছর অর্থাৎ ২০১৯ অর্থবছরের সালের শেষে ছিল ১ হাজার ৯০৯ ডলার। ২০২০ সালে এসে মাথাপিছু বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ১৭৩ ডলার। আর ২০২১ সালে বাজেটের সময় প্রাক্কলন করা হয়েছে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দাঁড়াবে ২ হাজার ৩২৬ ডলার।

সে হিসাবে ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় এখন বাংলাদেশের চেয়েও কম।

কিন্তু এর মানে যে বাংলাদেশের মানুষের খুব বেশি আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, ব্যাপারটা এমন নয়। বরঞ্চ ভারতীয়দের আয় কমে যাওয়ার কারণেই কাগজে কলমে ভারতের মাথাপিছু আয় হয়তো বাংলাদেশের চেয়ে কম হতে পারে। আর এই কাগজ-কলমের হিসাব শুনেই আমাদের সরকার বাহাদুর বারবার তৃপ্তি ঢেকুর তোলেন। কিন্তু জনাব সরকার বাহাদুর, এসব কাগজে-কলমে অর্থনীতির জয়গান আর কত শোনাবেন? মানুষের চাকরি নেই, মাথা গোজার ভালো জায়গা নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই, পেটের খাবারের নিশ্চয়তা নেই, সে এসব হিসাব-কিতাব শুনে বা পড়ে কী লাভ করবে? তার প্রয়োজন নগদ টাকা। তার প্রয়োজন চাকরি। তাই এসব কাগুজে অর্থনীতির ফাঁকা আওয়াজ বন্ধ করে বাস্তবমুখি অর্থনীতির দিকে নজর তিন।

পঠিত : ৪০৪ বার

মন্তব্য: ০