Alapon

ফেমিনিজম এবং কিছু কথা...


ইদানিং ফেমিনিজম তথা নারীবাদ নিয়ে বেশ লেখা, আলোচনা, সমালোচনা চোখে পড়ছে। বিশেষ করে ইসলামী অনুশীলনকারী কতক ছেলেমেয়েদের থেকে। কেউ আবার ইসলামী নারীবাদী, মডারেট বলে আখ্যায়িত হচ্ছেন বা আক্ষেপ ঝড়ে পড়ছে।

আমি অতি সহজ একজন মানুষ হিসেবে যেটা বুঝি, দেখছি সেটাই আজ আপনাদের জানাতে চাই। আমার বেড়ে ওঠা গ্রাম, শহরের নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও কিছু উচ্চবিত্তের মধ্যে। আমার ছয় মা-খালা, চার মামা, এক ফুফু, চার বাব-চাচা। তাদের প্রত্যেকেরেই গড়ে ৬/৭জন ছেলে মেয়ে। বলতে গেলে এদের প্রত্যেকের ছেলে-মেয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত। অথচ তারা ছিলেন একজন গৃহবধু ও প্রকৃত মা। তারা সমাজকে দিয়েছেন এক একটা সম্পদ। আমার ওইসব কাজিনদের প্রত্যেকের গড়ে ২/৩টি করে সন্তান আছে। এই সব প্রজন্মের সাথে আমার বেড়ে ওঠা ও যোগাযোগ রয়েছে। আমার জীবনের বিশাল একটি অংশ কেটেছে নানা বাড়িতে। যেখানটার চারদিকে ঘিড়ে ছিল দ্বিতল ও একতলা টিনসেট ১১টি ঘর এর মধ্যে একটি ঘর ছিল কাঠের বেড়া ও খড়ের ছাউনি, মাঝখানে বিশাল উঠান, এটাকে বলা হত একটি বাড়ি। এরকম পাশাপাশি উত্তরের বাড়ি, মাঝখানের বাড়ি ও দক্ষিণের বাড়ি এই তিনটি বাড়ির জন্য ছিল দুটো জামে মসজিদ। প্রত্যেকটা ঘরে ছিল ১/২ জন করে নানা-নানি অথবা শুধু নানি এবং সেসব ঘরে আবার ছিল ২/৩জন করে মামাদের পরিবার, তাদেরও ছিল অনেক সন্তান। বর্তমানে, দাদা-দাদি, নানা বাড়ির নানা-নানিরদের কেউ বেঁচে নেই। মামা-মামি, খালা-খালুদেরও অনেকেই পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। অল্প সংখ্যক মুরুব্বিরা আছেন, তাদের সন্তানেরা অর্থাৎ আমাদের প্রজন্ম, আমাদের সন্তান এবং অল্প কিছু সন্তানদেরও সন্তানেরা বর্তমান। নানা-বাড়ির ঐ গ্রামে ছিল অকেগুলো হিন্দুদের বাড়ি, ছিল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটু দূরে দূরে ছিল আরো কয়েকটি বাড়ি। ছোটবেলায় আমি পুরো গ্রাম দাবড়িয়ে বেড়িয়েছি, গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়ির সামনে তো রয়েছেই এমনকি পিছনে পর্যন্ত ছিল অবাধ বিচরণ। কার বাড়ি কালোজাম, চালতা, কাঁঠাল কোন ফল, কোন গাছ রয়েছে সব ছিল নখদর্পণে। ধানের মৌসুমে হিন্দুদের বাড়ি থেকে ধানের বিনিময়ে সমপরিমাণ পাত্রে, লুঙ্গিতে করে গরম গরম মুড়ি খাওয়ার মজা ভুলতে পারিনি। এরপর খালারা, মামারা, চাচারা বৈবাহিক সূত্রে এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, অন্য থানায় আবদ্ধ ছিল তাদের প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্রায়ই লঞ্চে করে একা চলে যেতাম তাদের বাড়িতে। ছোটো মানুষ হওয়ায় বড় লঞ্চে ভাড়া লাগত না। ছোট লঞ্চে নিচে বসতে বিরক্তি লাগত তাই দোতলায় আপার ক্লাসে বসতাম তখন হাফ ভাড়া লাগত। খালাদের বাড়িতে তো বলতে গেলে প্রতি দুই/তিন মাসেই একবার যেতাম এবং অনেকদিন বেরিয়ে আসতাম। সেখানেও চষে বেরিয়েছি।

এতবড় কাহিনী শুনে হয়তোবা বিরক্ত হচ্ছেন! এবার আসি মূল কথায়। তার আগে আর একটু গল্প লম্বা করার জন্য অনুমতি চাচ্ছি। আমি পরবর্তীতে যখন পরিবারের সাথে ঢাকায় আসি সেখানে কতক কাজের মহিলা ও তাদের পরিবারের সাথে পরিচয় ঘটে বাসায় কাজে সহযোগিতার ফলে। এই যে ফিরিস্তি দিলাম এই অগনিত পরিবারে কখনও ‍নারীনির্যাতন হতে দেখেনি। দরিদ্রতা ছিল, অল্প শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা ছিল আছে এখনও শুনিনি বিশাল কোন পারিবারিক বিচ্ছেদ। হত দরিদ্র যারা ছিল ওদের অল্প কিছুর মধ্যে কিছুটা কলহ-বিবাধ। যৌতুকের জন্য কিংবা অন্য কোন কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ দুয়েক জায়গায় ঘটছে তা উল্লেখ করার মত নয় এবং এটাও ঘটেছে আমাদের প্রজন্মে। এর মধ্যে খুবই নিকটতম পরিবারের মধ্যে বিবাদ ছিল কারণ সেখানে স্বামী-স্ত্রী কেউ কাকে ছাড় দিতে রাজি ছিল না, সমানে সমানে। এরমধ্যে আমার একজন খুবই আপন, তার ছিল অতিরিক্ত মাত্রায় উচ্চাভিলাষ যার কারণে তাকে একাধিক বৈধ স্বামীর ঘর করতে হয়েছিল।

আর একটু গল্প বলি ছাত্র জীবনে দু’বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে একটি নাট্য দলের সাথে যুক্ত থাকার সুবাধে মহিলা সমিতি, গাইড হাউস, বাংলা একাডেমিতে ছিল অবাধ বিচড়ন। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাইদ, কবি শামসুর রহমানের পাঠচক্রেরও ছিলাম নিয়মিত সদস্য। সে সুবাধে জুয়েল আইচ, গাজী মাজহারুল আনোয়ারসহ বিখ্যাত ও বহু তরুণ-তরুণীদের স্বপ্নের মানুষদের সান্নিধ্য ঘটেছিল।

পরবর্তীতে তো একনিষ্ঠ বিশ্বাসী মানুষের সংস্পর্শে ঘনিষ্ঠভাবে মিশার এবং তাদের সর্বোচ্চ ব্যক্তিবর্গের পাঠচক্র ও তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার অভুতপূর্ব সুযোগ। আলহামদুলিল্লাহ।

কর্মজীবনের শুরুতে ফোন-ফ্যাক্স, জেনারেল স্টোর ইত্যাদি ব্যবসার সুবাধে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আম জনতার সাথে মিশারও সুযোগ হয়েছিল। আমার দোকানের ফোনের গ্রাহক ছিল বেশিরভাগই মেয়ে। সেখানে দেখেছি ঘণ্টার ঘণ্টা ফোন ব্যস্ত রাখতে। শতকরা আশি থেকে নব্বই ভাগই পরকীয়া। তাদের মধ্যে তথাকথিত বোরকা আবৃতও ছিল। এক মেয়ে বলল আমরা যদি একটু চোখ কাত করি সব পুরুষ গায়েল। তখন বুঝলাম এক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা কতটা পারদর্শী।

পরবর্তীতে সাড়ে ছয় বছর একটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শাখা প্রধান হিসেবে এবং বৈবাহিক সূত্র ধরে আরো অনেক নারী-পুরুষের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়েছে এবং এদের বেশিরভাগই বিশ্বাসী মানুষ।

অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এসব বিশ্বাসী মানুষের কতক সংখ্যকের মধ্যে দেখেছি পারিবারিক কলহ, তার প্রধান কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখেছি জীবনভর ইসলামের কথা বলে বিবাহ করতে গিয়েই ইসলামকে আর পুরোপুরি মানতে রাজি নয়; নারী চায় ভাল রোজগারের, হ্যান্ডসাম ছেলে। ছেলের গোপন শক্তিশালী প্রত্যাশা ঢাকায় মেয়ের একটি বাড়ি বা ফ্লাট থাকলে খারাপ কি! সুন্দরী, সুশ্রী ও উচ্চ শিক্ষিত এবং সেক্ষেত্রে ধার্মিকতা একটু ছাড় দিলে কি এসে যায়!

এছাড়াও ধর্মীয় দিক প্রাধান্য দিয়ে উভয়েই প্রথমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও পরবর্তীতে অবসরহীন শয়তানের প্ররোচনায় তথাকথিত নারীবাদের সূক্ষ্ম চালে দ্বন্ধে পড়ে, তখনই শুরু হয় নানাবিধ সমস্যা, তারমধ্যে পরকীয়া ও বিচ্ছেদের ঘটনাও। এ সংখ্যাটাও নেয়ায়েত কম নয়!

অত্যন্ত দুঃখ ও কষ্টের বিষয় ইসলামী ধ্যান-ধারণা লালনকারী নারীদের কতক অংশ স্বামীকে বাধ্য করবে তার উচ্চ শিক্ষার জন্য, স্বামীকে সামর্থ থাকার পরও বাইরে চাকরি করতে যেতে হবে, স্বামীর একটু পয়সা হলেই মার্কেটে যেতে হবে এসব কাজ করতে নানাবিধ যুক্তি, ইসলামের সমস্ত দলিল উপস্থাপন। এমনিতেই দুর্বল নারী দিনশেষে বাইরের কাজের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে স্বামীর মূল প্রয়োজন মেটাতে যখন অক্ষম, সামর্থবান স্বামীকে ইসলামের অনুমতি দ্বিতীয় বিবাহ করতে দিতেও তখন আর ইসলামের দলিল গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যস শুরু হলো দ্বন্ধ, আইন তাদের পক্ষে, রাষ্ট্র তাদের পক্ষে ব্যস পুরুষ নির্যাতন অগোচরেই থেকে যায়।

তথাকথিত নারীবাদীদের কিংবা তাদের মুরুব্বিদের মত শুধু নারীদেরকে নিয়েই বিশ্বাসী মানুষের মধ্যে যখন খুব বেশি চর্চা হতে দেখি দুনিয়ার আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ দিয়ে তখন আর মিলাতে পারিনা।

এদের অল্প সংখ্যকের মধ্যেই এখন যারা নারী নির্যাতনের কথা বলে বেড়াচ্ছেন, বা দেদারছে লিখে চলেছেন এদের মধ্যে অধিকাংশই অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে অথচ ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ, সেখানে তাদের বাহানার শেষ নেই।

জনৈক একজনের লেখা থেকে বলছি "তথাকথিত কর্পোরেট সমাজ পুরুষবিদ্বেষ ছড়ানোতে নারীরা ঠিকই লাফ দিয়ে পড়বে। ‘নারী তুমি বেরিয়ে এসো, ঘর তোমাকে অবলা বানিয়ে রেখেছে, তোমার কোনো পুরুষের দরকার নেই, তুমি নিজেই নিজের ব্যয়ভার বহন করতে পারো’ ইত্যাদি বক্তব্য দিয়ে তারা শুধু নারীকে ঘর থেকে রাস্তায় নামানোর পাঁয়তারা করে।"

ঐসব নারীরা তো মনে করছে তাইতো আমার মনের কথা এই পুরুষরা বলছে ও সাথে আছে। তখন তাদের সাথে সখ্যতা, দহরম-মহরম চালাবে নারী তাকে সব কিছু দিয়ে দিতেও পিছপা হবেনা। পুরুষটি মনে মনে বলে এটাই তো আমি চেয়েছিলাম। তারপর নারী বয়সের ভারে চাকচিক্য হারিয়ে ফেলবে তখন শুধুই আফসোস ছাড়া আর কিছু জুটবে না। অথচ তার ঐসব তথাকথিত পেয়ারের পুরুষকে ভরা যৌবনে যা দিয়েছে এজন্য সাময়িক বাহবা নিয়েছে, তার শতকরা পঞ্চাশ ভাগও যদি তার স্বামীকে দিত তবে জীবনের পড়ন্ত বেলায় অন্তত আফসোস না করে সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে সুখেই দিনগুলি অতিবাহিত হত।

ইসলামে যেখানে বলে দিয়েছে মেয়েদের চারটি কাজ তাহলেই জান্নাত। নামাজ, রোজা, পর্দা করা ও স্বামীর আনুগত্য। আর পুরুষের কাজ স্ত্রী/নারী হলো কাঁচ সাবধানে ধরো, মূল্যবান সম্পদ হেফাজতে রাখ। তাদেরকে বাকা করে বানানো হয়েছে সোজা করতে যেওনা।

আর একটা মজার বিষয় দেখবেন স্রেফ নারীবাদ চর্চাকারীদের মধ্যে সে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী হোক উভয় গ্রুপের চর্চায় পুরুষ নির্যাতনের বেলায় কোন রা নেই।

তাই বলছি বিশেষ করে বিশ্বাসী মানুষের প্রতি আবেদন বাস্তব থেকে শিক্ষা নেন এবং সে আলোকে আলোচনা, বক্তব্য, লেখনিতে ইনসাফ কায়েম করুন।

CLTD

পঠিত : ৩৬৮ বার

মন্তব্য: ০