Alapon

বদলে যাচ্ছে ইরান-পাকিস্তান সম্পর্কের রসায়ন



ইরানের সাথে পাকিস্তানের সীমান্তটি সবসময়ই শিথিল। দুই দেশকে আলাদা করার মতো কোনো পর্বতমালা বা জটিল নদী নেই। আবার দুই দেশের মধ্যে বিস্তৃত বালুচিস্তান অঞ্চলটি শুস্ক ও অনুর্বর। দেশ দুটির অভিন্ন ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় প্রাচীন পারস্যের রাজা, মোগল সম্রাট ও সাফাভি শাহেরা অভিন্ন সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, সিন্ধু নদী ছাড়িয়ে আধুনিক কালের পাকিস্তান ও ভারতে ফারসি প্রভাব বিস্তার করেছেন। এর শিথিল প্রকৃতি এবং সেইসাথে আঞ্চলিক বিরোধ ও জোটবদ্ধতার জটিল ব্যবস্থা সত্ত্বেও তা তেহরানের সাথে ইসলামাবাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে। অবশ্য পরিস্থিতির আরো ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষণে দেখা যায়, সীমান্তজুড়ে ঘন ঘন সঙ্ঘাত সত্ত্বেও পাকিস্তান-ইরান সম্পর্ক অব্যাহতভাবে ইতিবাচক হচ্ছে।

গত মাসে ইরান-পাকিস্তান সীমান্তে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ওপর হামলার (এতে ছয় পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়) প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া তার ইরানি প্রতিপক্ষ জেনারেল মোহাম্মদ হোসাইন বাঘেরির প্রতি ইরানে সক্রিয় স্থানীয় মিলিশিয়াদের (এই হামলার জন্য তারাই দায়ী) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান। বাজওয়ার কণ্ঠে হতাশা দেখা গেলেও উভয় পক্ষ একসাথে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। তারা অভিন্ন সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করতে সংকল্প ব্যক্ত করে। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি নতুন কিছু নয়। গত বছর পাকিস্তান ও ইরান জয়েন্ট র‌্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্স গঠন করতে রাজি হয়। এই বাহিনীর লক্ষ্য হবে সীমান্ত নিরাপত্তা সমন্বয় করা।

অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান ও ইরানের আঞ্চলিক লক্ষ্য ভিন্ন। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে উজবেক, তাজিক ও আফগানিস্তানের অন্যান্য গ্রুপ নিয়ে গঠিত নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করে ইরান। আর পাকিস্তান সমর্থন করে মোল্লা ওমরের নেতৃত্বাধীন তালেবানকে। অধিকন্তু, ভারতের সাথে ইরান সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ গ্রহণ করার ফলে পাকিস্তানের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার প্রয়াস ভণ্ডুল হয়ে যায়। এছাড়া দক্ষিণ, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়াজুড়ে জোটবদ্ধতার ধারা জটিলতাও তৈরী করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তান ও ইরান এই জোটবদ্ধতায় বিপরীত দিকে অবস্থান করছে। ইরানের সাথে ভালো সম্পর্ক রয়েছে রাশিয়া ও ভারতের। সেইসাথে আর্মেনিয়ার সাথেও ইরানের বন্ধুত্ব আছে। এই গত মাসেই তারা দুই দেশের মধ্য নতুন বিদ্যুৎ লাইন স্থাপনের নতুন একটি চুক্তি করেছ। ফলে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ায় পাকিস্তান বেশ বিরূপ অবস্থায় পড়েছে। পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক আছে তুরস্ক ও আজারবাইনের। এই আজারবাইনের সাথে আর্মেনিয়ার দীর্ঘ দিনের বৈরিতা রয়েছে, বিশেষ করে নাগারনো ও কারাবাঘ নিয়ে।

এত কিছুর পরও পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কেন অভিন্ন নিরাপত্তা নিয়ে ইরানের সাথে কাজ করতে আগ্রহী?

এই প্রশ্নের জবাব নিহিত রয়েছে আসলে গত বছর ঘোষিত একটি বিবৃতির মধ্যে। ২০১৯ সালের আগস্টে নরেন্দ্র মোদিও নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার কাশ্মিরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে দেয়। ভারতের এই পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানকে ক্ষুব্ধ করে, পুরো মুসলিম বিশ্বও অসন্তোষ ব্যক্ত করে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর বিবৃতি প্রদান করেন। এতে তিনি এই অঞ্চলের মুসলিমদের নির্যাতন করা ও সন্ত্রস্ত্র করার জন্য ভারতের নিন্দা করেন।

খামেনি ইরান ও ভারতের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করলেও তিনি মোদির পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেন। তার এই অবস্থান পাকিস্তানের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়। বিশেষ করে ইরানের প্রায়ই পাকিস্তান ও ভারতের জটিল ভারসাম্য বজায় রাখার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে এর বিশেষ গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।

অধিকন্তু, ভারতের সাথে ইরানের অর্থনৈতিক সম্পর্ক যেমনটা হওয়ার কথা, তা হচ্ছে না। উভয় দেশ পারস্য উপসাগরে যৌথভাবে চাবাহার বন্দর উন্নয়ন ও দক্ষিণ ইরানে রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও তাদের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বরের মধ্যে তা ৮০ ভাগ হ্রাস পায়। ইরানের শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের উষ্ণ সম্পর্ক দিল্লি-তেহরান সম্পর্ক উন্নয়নে বাধার সৃষ্টি করেছে। হয়তো এ কারণেও ভারতের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের বিরুদ্ধে ইরান এমনভাবে সোচ্চার হয়ে থাকতে পারে। আর এ কারণেই বাজওয়াসহ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অভিন্ন অবস্থান ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলছে।

দুই দেশের মধ্যে জনগণ পর্যায়ে যোগাযোগ অব্যাহতভাবে বাড়ছে। পাকিস্তানের শিয়া তীর্থযাত্রীরা বেশ ভালো সংখ্যায় ইরান সফর করছে। এছাড়া ইরানের তিনটি এয়ারলাইন্স সরাসরি পাকিস্তানে ফ্লাইট পরিচালনা করে। বৃহত্তর অঞ্চলের প্রেক্ষাপটেও এই সম্পর্কের গুরুত্ব অনুধাবন করা উচিত। ইরান ও পাকিস্তান তাদের সম্পর্ককে আঞ্চলিক সঙ্ঘাত নিরসনে ব্যবহার করতে পারে। আর্মেনিয়া ও রাশিয়ার সাথে ইরানের সম্পর্ক এবং আজারবাইজান ও তুরস্কেও সাথে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্রতার মানে হচ্ছে দুই দেশই নাগারনো-কারাবাঘের দীর্ঘ দিনের সমস্যাটি নিরসনে ইয়েরেভান ও বাকুর মধ্যে মধ্যস্ততা করতে পারে। উভয় দেশ প্রতিবেশী আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামাবাদ ও তেহরান এবং সেইসাথে মস্কো ও বেইজিং আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার ব্যাপারে তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত করেছে। তারা করোনাভাইরাস অতিমারিতে আফগানিস্তানকে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।

সংক্ষেপে বলা যায়, পাকিস্তান-ইরান সম্পর্ক একদিকে যেমন জটিল, অন্যদিকে আবার গুরুত্বপূর্ণও। বালুচিস্তানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা ও ইরানের সাথে সেতুবন্ধ রচনার পাকিস্তানি চেষ্টা ও ভারতের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের প্রেক্ষাপটে খামেনির সমালোচনাসহ সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করতে হবে। ভৌগোলিক সীমান্ত হয়তো আইডিয়া ও প্রভাব বিনিময়ের ব্যবস্থা করতে পারবে না, কিন্তু দুই পক্ষের কর্মকর্তারা এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার হওয়া অব্যাহত রাখতে পারবেন।

পঠিত : ৬৬৬ বার

মন্তব্য: ০