Alapon

জাপানের জোরে গান্ধীর 'ভারত ছাড়' আন্দোলন



১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জাপান একের পর এক বৃটিশ দুর্গ দখল করে ভারতকে প্রায় ঘিরে ফেলে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন আদায়ে ক্রিপসকে ভারতে পাঠায় ব্রিটেন। কিন্তু ক্রিপসের মিশন ব্যর্থ হয়। এদিকে কংগ্রেস নিশ্চিত ছিল জাপান যেভাবে এগিয়ে আসছে তাতে ভারত দখল করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর ভারতে জাপানিদের হাতে বৃটিশদের পতন হলে তারাই শাসনক্ষমতা দখলে নিবে। তাই জাপানিদের কাছে নিজেদের বৃটিশবিরোধী অবস্থান নিশ্চিত করতে ভারত ছাড় আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়।

কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ মনে করেছিলেন যে যুদ্ধে মিত্র শক্তির পরাজয় অবধারিত। এই সুযোগে দেশে চরম বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সমগ্র দেশের শাসন ক্ষমতা হস্তগত করা ছিল কংগ্রেসের পরিকল্পনার অধীন। এভাবেই মুসলমানদের সকল দাবী দাওয়া প্রত্যাখ্যান করে উপমহাদেশে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কংগ্রেসের এ পরিকল্পনার স্বীকৃতি পাওয়া যায় মাওলানা আবুল কালাম আযাদ-এর ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম’ বইয়ে। তিনি বলেন, তাঁর মনে এ পরিকল্পনা ছিল যে, যেইমাত্র জাপানীরা বাংলায় পৌঁছে যাবে এবং ব্রিটিশ সৈন্য বিহারে পিছু হটে আসবে, কংগ্রেস গোটা দেশের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করবে। কিন্তু কংগ্রেসের এ পরিকল্পনা অমূলক ও অবাস্তব প্রমাণিত হয়।

ক্রিপস মিশনের ব্যর্থতার অব্যবহিত পরপরই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভারতের বোঝাপড়া শেষ করে দিয়ে গান্ধী তীব্র ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের পরিকল্পনা করতে শুরু করে। গান্ধী ১৯৪২ সালে ২৬ এপ্রিল 'হরিজন' পত্রিকাতে 'ভারত ছাড়' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন "ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবিলম্বে অবসান চাই। ভারতের স্বাধীনতা চাই কেবল ভারতের স্বার্থে নয় — চাই বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য নাত্সীবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ এবং একজাতির উপর অন্যজাতির আক্রমণের অবসানের জন্য।" এরপর ১৯৪২ সালের ১৪ জুলাই মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা অধিবেশনে 'কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি' গান্ধী 'ভারত ছাড়' আন্দোলনের প্রস্তাব অনুমোদন করে। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট কংগ্রেসের কার্য-নির্বাহক সমিতি গান্ধীর ঐতিহাসিক 'ভারত ছাড়' প্রস্তাবের আইনগত স্বীকৃতি জানায় এবং সিদ্ধান্ত হয় যে ৯ আগস্ট ১৯৪২ সালে সকালে আন্দোলন শুরু হবে।

এই প্রস্তাবে বলা হয় ভারতের মঙ্গলের জন্য, বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য, নাত্সীবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান অপরিহার্য। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ব্রিটিশ ভারত ছেড়ে চলে গেলে ভারতীয় জনপ্রতিনিধিরা একটি সামরিক সরকার গঠন করবেন এবং সকলের গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান রচনা করবেন। প্রস্তাব অনুমোদনের পর গান্ধী দৃঢ় কন্ঠে ঘোষণা করেন, 'করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে' । অর্থাৎ দেশ স্বাধীন করব, না হয় মৃত্যুবরণ করব । গান্ধীর এই উদাত্ত আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গেই ভারত ছাড় আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলনের রণধ্বনি ছিল 'করেঙ্গা ইয়ে মরেঙ্গে'। সারাজীবন কুসুম কোমল আন্দোলন করা ও বৃটিশদের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য রেখে অধিকার আদায়ের কথা বলা গান্ধী হুট করেই জাপানের জোরে খুবই সহিংস হয়ে উঠলেন। সারা ভারতে কংগ্রেস কর্মীদের দিয়ে জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন শুরু করলেন।

ব্রিটিশ সরকার ১৯৪২ সালের ৯ই আগস্ট গান্ধীকে গ্রেফতার করে। এরপর একে একে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, জওহরলাল নেহরু, আবুল কালাম আজাদ, জে. বি. কৃপালনী সমেত বহু প্রথম সারির নেতা গ্রেপ্তার হন। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসকে বেআইনি সংগঠন রূপে ঘোষণা করে। সারা হিন্দুস্তানে কংগ্রেস কর্মীদের গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা হয়। সরকারি দমন নীতির প্রতিবাদে দেশের আপামর জনসাধারণ ভারত ছাড় আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে।

দেশব্যাপী ধর্মঘট, শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। কংগ্রেসের কর্মীরা আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। রেললাইন ধ্বংস, স্কুল-কলেজ বর্জন, বিভিন্ন অফিস-আদালতে অগ্নি-সংযোগ, ট্রেন ও টেলিফোন সংযোগ বিছিন্নকরণ থানা, ডাকঘর, রেজিস্ট্রি অফিস, রেলস্টেশন দখল ইত্যাদি কর্মসূচি চলতে থাকে।

ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল মহারাষ্ট্রের সাতারা, মেদিনীপুরের তমলুক, কাঁথি, দিনাজপুরের বালুরঘাট, উত্তরপ্রদেশের বালিয়া, আজমগড়, আসামের নওগাঁ, ওড়িশার তালচের, বালাশোর ইত্যাদি । বিশিষ্ট নেতাদের মধ্যে সাতারার শ্রীনাথ লালা, নানা পাতিল, বালিয়ার চৈতু পান্ডে, সরযূ পান্ডে, তমলুকের মাতঙ্গিনী হাজরা, সুশীল ধাড়া, পাঞ্জাবের গৃহবধু ভোগেশ্বরী ফকোননি, আসামের স্কুলছাত্রী কনকলতা বড়ুয়া অন্যতম । এছাড়া অরুণা আসিফ আলি, সুচেতা কৃপালিনী, জয়প্রকাশ নারায়ণ, আচার্য নরেন্দ্রদেব, রামমনোহর লোহিয়া, যোগেশ চ্যাটার্জি, উষা মেহেতা, অচ্যুত পট্টবর্ধন, অজয় মুখার্জি প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ।

জাপানের জোরে গান্ধী এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি ভারত ছাড় আন্দোলনকে আন্দোলন শুরু করার আগেই বৃটিশদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার এই ঘোষণা ইংরেজদের আগেই সচেতন করে তোলে এবং কংগ্রেস নিষিদ্ধ সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে। সারা দেশে আন্দোলনের শুরুতেই দমননীতি চালাতে উদ্বুদ্ধ করে। অবশেষে মাত্র চার মাসে আন্দোলন পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে আসে বৃটিশ সরকারের।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারত ছাড় আন্দোলনকে গৃহযুদ্ধের ঘোষণা আখ্যা দিয়ে এধরণের হটকারি সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। জনগণের নিরাপত্তা ও ব্রিটিশদের দমননীতি থামাতে তিনি কংগ্রেসকে এই আন্দোলন থামানোর আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের এই বিদ্রোহ প্রকৃতপক্ষে মুসলিম লীগ ও অন্যান্য অকংগ্রেসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ১৯৪২ এর ডিসেম্বরে ভারত ছাড় আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়।

যেসব কারণে ভারত ছাড় আন্দোলন ব্যর্থ হয়
১. আন্দোলনের শুরুতেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রেফতার হয়ে যাওয়া এবং সারাদেশে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বৃটিশদের কঠিন দমননীতি।

২. আন্দোলনের সঠিক পরিকল্পনা ও রূপরেখা না থাকা এবং স্থানীয় নেতৃত্ব আত্মগোপনে চলে যাওয়া।

৩. কংগ্রেস এই আন্দোলনে অন্য কোন রাজনৈতিক সংগঠনকে সাথে তো রাখেনি অধিকন্তু অন্যান্য দলের করা বিভিন্ন সময়ের সমঝোতা ও চুক্তি বাতিল করেছে। তাদের চিন্তা ছিলো জাপানের আক্রমণে ব্রিটিশরা পিছু হটলে তারাই হবে ভারতের একমাত্র ক্ষমতার দাবীদার। তাই আন্দোলন চলাকালে অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে পাশে তো পায়নি উল্টো বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছে।

৪. গান্ধীর উস্কানীতে আন্দোলন শুরু থেকে সহিংস আকার ধারণ করেছে। শিক্ষালয়, রেললাইন, ডাক ব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে আন্দোলনকারীরা। ফলে জনসাধারণ এই আন্দোলনের বিপক্ষে চলা যায়।

৫. যাদের ওপর আস্থা করে এই আন্দোলনের সূতপাত সেই জাপানীরা বাংলা দখল করতে ব্যর্থ হওয়া। জাপানিদের টার্গেট ছিলো কোলকাতা বন্দর দিয়ে ভারত আক্রমণ করে তারা ভারতে প্রবেশ করবে। কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়।

পঠিত : ৬১৬ বার

মন্তব্য: ০