Alapon

কাশ্মীরি 'পোস্টার বয়' বুরহান ওয়ানীর ৪র্থ শাহাদাৎ বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধা



বুরহান ওয়ানী আমাদের কাছে অপরিচিত একটি নাম বিশেষ হলেও কাশ্মীরীদের কাছে তা আবেগ-অনুভূতি-উচ্ছ্বাসের অপর নাম। বুরহান ছিল কাশ্মীরের একজন ক্যারিসম্যাটিক লিডার, তাদের ফ্রিডম আইকন। ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই রাজ্যটি যুগ যুগ ধরে কার্যত সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে। সাম্প্রতিক সময়ে গোটা পৃথিবী যখন করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তখন হিন্দুত্ব উগ্রবাদী নরেন্দ্র মোদির সরকার জম্মু-কাশ্মীরের জনতত্ত্ব বেআইনি ভাবে পরিবর্তন করে চলেছে৷ ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীরকে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারায় যে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেয়া হয়েছিল তা ছিনিয়ে নেয়ার মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলে সংখ্যাগুরু মুসলিমদের সংখ্যালঘু বানানোর হীন উদ্দেশ্যে হিন্দুদের সেখানে পুনর্বাসন করার জন্য সম্প্রতি মোদী প্রশাসন উঠেপড়ে লেগেছে। কাশ্মীরের যুবমানসের গতিপ্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে তাদেরকে ভারতের বৃহত্তর জনসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, কাশ্মীরের মূলধারার সকল রাজনৈতিক সংগঠনকে ব্যান করে দিয়ে, পুরো কাশ্মীর উপত্যকাকে মিডিয়া ব্ল্যাক-আউট করে, সোশ্যাল মিডিয়া ব্লক করে, মানাবাধিকারকে প্রতিনিয়ত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটি‍য়ে কাশ্মীরিদের জাতিসত্ত্বাকে বিনষ্ট করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে দখলদার ভারতীয়রা।

কে এই অকুতোভয় বীর বুরহান ওয়ানী?

বিশ্বের বৃহত্তম সংখ্যালঘু-মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্র ভারত অধিকৃত দক্ষিণ কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার অন্তর্গত পাহাড়ঘেঁষা ট্রাল শহরে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নিয়েছিল এই ক্ষণজন্মা বিপ্লবী। কাশ্মীরের দখলদার ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যেসময় পুরো উপত্যকা জুড়ে একের পর এক ধর্ষণ ও গণধর্ষণের অভিযোগ উঠছিল। এক সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত পরিবারে জন্ম হয় বুরহানের। তার বাবা মুজফফর আহমেদ স্থানীয় একটি স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তার মা মাইমুনা মুজফফর বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেন। তিনি এখন ত্রালের শরিফাবাদ এলাকায় বাচ্চাদের কোরানের পাঠ দেন। এমন এক সম্ভ্রান্ত ও বিত্তশালী পরিবারের সন্তান হলেও বুরহান ওয়ানী মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ার উদ্দ্যেশ্যে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিল। পরবর্তীতে মাত্র ২১ বছর বয়সেই সে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কাছে মস্ত আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল। ৩২,৮৭,২৬৩ বর্গকিলোমিটার সমৃদ্ধ বিশ্বের ৭ম বৃহৎ আয়তনের রাষ্ট্র ও ৩৭ লক্ষের বিশাল সেনাবাহিনীর দেশ ভারতের অন্যতম প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল বুরহান ওয়ানী। যার আতঙ্কে বিশ্বের সর্বাধিক সামরিক উপস্থিতি সমৃদ্ধ অঞ্চল কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতীয় দখলদার বাহিনী নিয়মিত তটস্থ থাকতো। এই দখলদারদের যম হয়ে উঠেছিল ২১ বছর বয়সী বুরহান ওয়ানী। তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এক মিলিয়ন রুপি অর্থ পুরষ্কারও ঘোষণা করেছিল দখলদার ভারতীয় বাহিনী।



কেন বুরহান ওয়ানী কাশ্মীরের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল?

কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতীয় দখলদার বাহিনীর চরম নিপীড়ন-নিষ্পেষণ দেখে বুরহানের অন্যান্য নিকটাত্মীয়রা একে একে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দলে যোগ দেন। এই সংগ্রামীদের সঙ্গ পেয়ে বুরহানের মনেও স্বাধীনতার বীজ বুনতে শুরু করে। পুলিশ ও সেনাদের হাতে বুরহানের বেশ কয়েকজন নিকটাত্মীয় পরপর নির্মম ভাবে নিহত হলে মাত্র ১৫ বছর বয়সেই পুলিশি অত্যাচারের বদলা নিতে স্বাধীনতাকামীদের দলে যোগ দিতে বাড়ি ছেড়ে দেন। বুরহান ছোট থেকেই ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসত। হাসিখুশি স্বভাবের বুরহানের একমাত্র নেশা বলতে এটাই ছিল। তবে ধীরে ধীরে সেসব তুচ্ছ হয়ে গেল স্বজাতির মুক্তি সংগ্রামের কাছে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্বাধীনতাকামীদের দলে যোগ দেয় সে। হিজবুল মুজাহিদিন নামক স্থানীয় একটি স্বাধীনতাকামী দলে যোগ দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই কাশ্মীরীদের কাছে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠে সে। এছাড়া শিক্ষিত পরিবারের হওয়ায় স্যোশাল মিডিয়াকে কীভাবে কার্যকরী পন্থায় ব্যবহার করতে হয় তা বুরহান জানত। ফেসবুক সহ বিভিন্ন স্যোশাল মিডিয়াকে হাতিয়ার করে সে কাশ্মীরের যুবসমাজকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করে। বুরহানের বয়স যখন ১৭, তখন প্রথমবার স্যোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নিজের ছবি পোস্ট করে সে। শুরু হয় কাশ্মীরি যুবকদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেওয়ানোর কাজ। পরে একটি ভিডিও পোস্ট করে বুরহান, সেখানে সরাসরি কাশ্মীরি যুবকদের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে আহ্বান জানায় সে। ভারতীয় পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বুরহান ওয়ানি স্যোশাল নেটওয়ার্কিংকে দারুণভাবে ব্যবহার করতে জানত। নবীন প্রজন্মের হওয়ায় সে জানত কীভাবে যুবকদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা যায়। বুরহান দারুণ বক্তাও ছিল। তার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অন্তত একশোর বেশি যুবক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দলে নাম লিখিয়েছে বলেও জানিয়েছে ভারতীয় পুলিশ। আর সেজন্যই বুরহানের মাথার দাম দশ লক্ষ রুপি ধার্য করেছিল ভারতের হিন্দুত্ববাদী প্রশাসন।

বুরহানের মায়ের ভাষ্যমতে,
সালটা ছিল ২০০০। ভারতীয় দখলদার সেনা জওয়ানদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েছিল মাইমুনার দুই ছেলে, খালিদ আর বুরহান। বুরহানের মা মাইমুনা বললেন, ‘‘ওই ঘটনায় সেনার হাতে বুরহানের বড় ভাই খালিদ বেধড়ক মার খেয়েছিল। বাড়ি ফিরেও ভিতরে ভিতরে গুমরোচ্ছিল ছোট ভাই বুরহান। শুধু বলত, এ ভাবে চলতে পারে না। বড় ভাই খালিদও ওকে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল।’’ মাইমুনা জানালেন, কাশ্মীরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও দিনই তিনি সে ভাবে ভাবেননি। শুধু চেয়েছিলেন, বুরহান যেন ভাল মানুষ তৈরি হয়। কিন্তু ওই ঘটনার পর থেকেই পাল্টে যায় বুরহান। পরবর্তীতে কাশ্মীর উপত্যকায় ভারতীয় সেনাদের দ্বারা সংঘটিত অন্যান্য নির্মমতাও বুরহানের বিদ্রোহী মনোজগতে বেশ প্রভাব ফেলে। মাইমুনার কথায়, ‘‘ও খুব জেদি ছিল। যখন চলে যায়, জানতাম স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দলেই নাম লিখিয়েছে। সহজে ফিরবে না। তবু চাইতাম, এক বার হলেও যেন ও ফিরে আসে। দূর থেকেই দেখব। এসেছিল এক বারই। কিন্তু দেখা হয়নি। অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলাম আমি। আজও আফসোস করি, কেন সে দিন বেরিয়েছিলাম বাড়ি থেকে।’’



ক্ষণজন্মা এই বিপ্লবীর অল্প সময়ে চলে যাওয়া

পনেরো বছরের ছেলেটা হঠাৎ এক দিন বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। সাত বছর পরে ত্রালের বাড়িতে ফিরেছিল বুরহান মুজফ্ফর ওয়ানি। তবে নিথর হয়ে। বুরহানের মা স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, তার প্রিয় বুরহান ওয়ানী উপত্যকার গণমানুষের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন। তার প্রিয় কলিজার টুকরা সন্তান বুরহান ওয়ানী একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিল। ২০১৪ সালে সেনার সঙ্গে সংঘর্ষেই তিনি হারিয়েছেন তার বড় ছেলে খালিদকে। বড় ছেলেকে হারানোর পরে মন আরও শক্ত করে ফেলেছিলেন মাইমুনা। জানতেন, ছোট ছেলের মৃত্যুর খবরও একদিন আসবে। এবং মায়মুনার অনুমানই সত্যি করে প্রিয় ওয়ানী তার কোলে ফিরেছিল শহীদ হয়ে। ছেলেকে জীবিত সামনে পেলে কি এই অনিশ্চিত রাস্তা ছাড়তে বলতেন? ‘‘না’’, সাংবাদিকদের প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব বুরহান ওয়ানীর রত্নগর্ভা মা মাইমুনার। কারণ তিনি আজ অবধি গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন, ছেলের জন্য এই পথ বেছে দিয়েছেন স্বয়ং উপরওয়ালা। ‘‘আমার ছোট ছেলে কিন্তু সন্ত্রাসী নয়। ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিল, শহীদ হয়েছেন।’’

দীর্ঘ ৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় বাহিনীকে চরম বিপর্যস্ত করে শেষপর্যন্ত ২০১৬ সালের আজকের এই দিনে তথা ৮ জুলাই শাহাদাৎ বরণ করেছিল ক্ষণজন্মা এই কাশ্মীরি বিপ্লবী। কাশ্মীর উপত্যকার ভারতীয় দখলদার বাহিনীর চোখে মোস্ট ওয়ান্টেড বুরহান ওয়ানীকে কাশ্মীরের কোকেরনাগের বিমদুরা এলাকায় তার দুই সঙ্গীর সঙ্গেই নির্মম ভাবে হত্যা করে ভারতীয় দখলদার হানাদাররা। কাশ্মীরের বিপ্লবীদের জন্য জন্য চিরকাল তার আত্মোৎসর্গ অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। এই উপত্যকার গণমানুষের মুক্তির জন্য তার এই আত্মত্যাগ ও তার সংগ্রামী জীবনের দ্যুতিমান মহিমা চিরভাস্মর হয়ে থাকবে কাশ্মীরিদের হৃদয়ে। বোরহান ওয়ানীর মৃত্যুর ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে কাশ্মীর ভ্যালি। জম্মু ও কাশ্মিরের হাজার হাজার অধিবাসী পথে নেমে বুরহান ওয়ানীর মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন করেছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে ভারত সরকার টানা দুই মাস সেখানে কারফিউ জারি করে রেখেছিল। ভারতীয় দখলদার বাহিনীর শত বাধা উপেক্ষা করে বুরহান ওয়ানির শেষকৃত্যে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক কাশ্মীরি অংশগ্রহণ করেছিল। এই বীরকে 'নায়কোচিত' সম্মানের সাথে বিদায় জানানো হয়। বুরহান ওয়ানীর কপালে চুমু খেয়ে কাশ্মীর স্বাধীন করার প্রতিজ্ঞা করে কাশ্মীরী কিশোর-তরুণ-যুবারা।



এই বিপ্লবীদের শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের হীনমন্যতা কেন?

২২ বছরের এই বীর বুরহান ওয়ানীকে 'বিপ্লবী' আখ্যা দিয়েছিল ভারতের বাম ছাত্র নেতা উমর খালিদ। কিউবা বিপ্লবের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো কিংবা চে গুয়েভারাকে সর্বজনীন বিপ্লবের মুখচ্ছবি হিসেবে সমাদৃত করতে বিশ্বব্যাপী অনেক নামকাওয়াস্তে মুসলিমকেও সম্পৃক্ত হতে দেখি অথচ বুরহান ওয়ানীদের ক্ষেত্রে তাদের এবং আমাদেরও বৃহৎ অংশের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক তার বিপরীত। অথচ তাদের সবারই ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকলেও এক জায়গায় বড্ড মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তা হলো, চরম নিপীড়ক শাসকের দুর্বৃত্তায়ন, শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ। তাহলে কেন এই দ্বিচারীতা?

আমরা আমাদের বীরদের নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগি। আমরা স্বগোত্রীয় বিপ্লবীদের স্যালুট করতে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যায়। অথচ ভিন গোত্রের চামার মুচির পদধূলি নিয়ে আমরা ধন্য হই। তাদের নিয়ে মেতে উঠি। এর পেছনে অবশ্য বড় কারণও আছে। আমাদের মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রক আমরা নই। পশ্চিমারা আমাদের মধ্যে দাসত্বের চিন্তা চেতনা ঢুকিয়ে দিয়েছে। আমরা সবকিছু দেখি কিংবা পরখ করি তাদের পড়িয়ে দেওয়া চশমায়। যার ফলস্বরূপ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে মুসলিমরা সবচেয়ে কঠিন, করুণ, লাঞ্চনা ও অপদস্ততার সময় পার করছে। যতদিন পর্যন্ত মুসলিম জাতি তাদের প্রকৃত শত্রু-মিত্র চিহ্নিত কিংবা নিজেদের বিপ্লবীদের সম্মান জানাতে হীনমন্যতায় ভুগবে ততদিন মুক্তির আশা করা অন্তঃসারশূন্য।

পঠিত : ৭৮২ বার

মন্তব্য: ০