Alapon

আয়া সুফিয়ার ভাগ্য: আদালত ও রাজনীতি...



তুরস্কের শীর্ষ প্রশাসনিক আদালত ‘কাউন্সিল অফ স্টেট’ চলতি মাসের ২ তারিখ আয়া সুফিয়ার মসজিদে রূপান্তর সংক্রান্ত শুনানী শেষ করেছে। পরবর্তী ১৫ কার্যদিবসের মাঝে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করবে যে, আয়া সুফিয়া জাদুঘর থাকবে, না পাঁচশত বছরের মুসলিম ঐতিহ্য মসজিদে ফিরে যাবে।

তুরস্কের রাজনীতিতে আয়া সুফিয়া একটি পপুলিস্ট ইস্যু। ১৯৯৬ সনে ইস্তাম্বুল মেয়র প্রার্থী এরদোয়ান সর্বপ্রথম ইস্যুটি ভোটের উপাদান করেন। তারপর থেকে ইস্যুটি ইসলামপন্থীদের একচেটিয়া দখলে ছিলো। ২০১৬ সন থেকে প্রতিবছর আয়া সুফিয়ায় কুরআন তিলাওয়াতের আয়োজন করা হচ্ছিল। চলতি বছরের ২৯ মে তারিখে ৫৭৬তম ইস্তাম্বুল বিজয়ের দিন সেখানে অনুরূপ আয়োজন হয়েছিলো, যেখানে এরদোয়ান আয়া সুফিয়ার মসজিদের রূপান্তরের বিষয় অতীব জোরালো ভাষায় তুলে ধরেন। গতমাসের একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে ৭৩% তুর্কী মনে করে আয়া সুফিয়া মসজিদে রূপান্তরিত হোক। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী শিবির প্রতিপক্ষ অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রি অবস্থানে সরে এসে ‘আয়া সুফিয়ার মসজিদে রূপান্তর বিল’ সংসদে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা করে। বিরোধীদের ভোটের মাঠে সে সুযোগ না দিতে সরকারী দল কৌশলে তা আদালতে নিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ধর্মনিরপেক্ষ সিএইচপির কয়েকজন শীর্ষ নেতার মন্তব্য থেকে প্রতিয়মান হয়, তারা আগামী নির্বাচনের পূর্বে আয়া সুফিয়া ইস্যুর সুরাহা চায়। আয়া সুফিয়ার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক, তারা বর্তমানে সরকার দলকে সমালোচনা করতে নিজেদের জন্য এমন একটি সুবিধাজনক অবস্থান সৃষ্টি করেছে যা কপটতাপূর্ণ।

এদিকে আদালতের অবস্থা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে, তাতে সরকারপন্থীদের নিয়ন্ত্রন সংহত। তবে অত্যন্ত জাতীয়তাবাদী তুর্কি জাতি এ সিদ্ধান্তটির সমাধান শুধুমাত্র আদালতের মাধ্যমে সম্পন্ন করবে, তা আমি বিশ্বাস করি না। এখানে সরকারী দল ও বিরোধীদল অন্তরালে অনেক দূতিয়ালী করবে। আদালতের সিদ্ধান্ত থেকে আমরা সে দূতিয়ালীর সারমর্ম অচিরে দেখতে পাবো। তবে এ মুহুর্তে দেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী কোনো বাধা আসার সম্ভাবনা নেই। সরকারী দল ইতোমধ্যে খুবই দক্ষতার সাথে ইস্যুটিকে সার্বভৌমত্ব সংশ্লিষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গ্রিসের অতিরিক্ত বাকযুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া ও আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী পম্পের স্টেটমেন্ট তুর্কি জাতিগত অবস্থান আরও সংহত করবে।

আদালত যে প্রিসিডেন্ট/নমুনা অনুসরণ করতে পারেন

ঐতিহাসিক এ রায়ে আদালত ১৯৪৫ সনের অপর একটি রায়ের অনুসরণ করতে পারেন বলে মনে হচ্ছে। শুনানীতে পক্ষের প্রধান আইজীবি সেলামী কেরামান ‘কাউন্সিল অব মিনিস্টার’ কর্তৃক ‘কারিয়া মসজিদ’ কে জাদুঘরকে রূপান্তর সিদ্বান্তকে ১৯৪৫ সনে আদালত অবৈধ ঘোষণা করার প্রিসিডেন্ট/নমুনা উপস্থাপন করেছেন। কৌশলীরা আরেকটি যুক্তি দিয়েছেন যে, আয়া সুফিয়া সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদের [যিনি ইস্তাম্বুল বিজয়ের জন্য আল-ফাতিহ নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন] করা ওয়াকফ সম্পত্তি। ১৯৩৪ সনের কাউন্সিল অব মিনিস্টার আদেশ তুর্কী প্রাইভেট প্রপার্টি আইনের লঙ্গন।

কী আসতে পারে সিদ্ধান্ত?

যদি আদালত আয়া সুফিয়ার যাদুঘর থাকা নিশ্চিত করে তবে তা হবে এরদোয়ান রাজনীতির অপমৃত্যু। এটা হয়তো ক্ষমতাশীন দল কোনোভাবে চাইবেন না এমনটি ঘটলে সেক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ডিগ্রীর সুযোগ নিবেন একে পার্টি। আদালত যদি ১৯৩৪ সনের আদেশটি বাতিল করে তাতে-ই আয়া সুফিয়া প্রায় ৮৬ বছর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাবে। আর তা একে পার্টির আরেক দফা ক্ষমতারোহণের পথ প্রশ্বস্ত করবে। ‍তৃতীয় একটি পন্থা হতে পারে, ইতোমধ্যে সংসদ হয়ে আদালতে আসা বিষয়টি হয়তো আবার সংসদে ফেরত পাঠাতে পারেন আদালত। বিচারকরা নিদের্শনা দিতে পারেন ১৯৩৫ সনে ‘মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তর’ প্রক্রিয়াটি ‘কেবিনেট ডিসিশন’ ছিলো। সুতরাং সে সিদ্ধান্ত বাতিল করার জন্য কেবিনেটির সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে সরকারী দলের নেতৃত্ব ও ক্রেডিট দু’টি-ই প্রতিষ্ঠা পাবে এবং বিরোধী শিবিরও কৌশলগত মিত্র থাকার সম্ভাবনা প্রবল। এভাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গ্রুপের জড়িত থাকায় ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রি’ জারি না করে আদালতের মাধ্যমে সমাধানে আসা হয়তো সরকার ও বিরোধী সবার জন্য-ই স্বস্তিদায়ক। সরকারী দলের স্বস্তি তারা এটাকে ‘এরদোগান রিভোলেশনের অংশ বিবেচনা করে আর বিরোধী দলের জন্য স্বস্তির আগামী নির্বাচনের এ ইস্যু আর থাকছে না। এসব বিভিন্ন পক্ষের দূতিয়ালী ও আদালতের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার উপর নির্ভর করছে।

এরদোয়ানের কপট হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু?

এরদোয়ানের জন্য আদালতের মাধ্যমে মসজিদে রূপান্তর-ই সবচেয়ে উত্তম পথ। দূতিয়ালি সফল না হলে তিনি আদালতে বিষয়টি মিমাংসা না করে যে কোনোভাবে আগামী নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে পারেন। এটা অবশ্যই বিরোধীদের সাথে সমঝোতা না হওয়ার লক্ষণ। একে পার্টি সমালোচনার লক্ষে পরণত হবে এবং তখন পরিস্থিতি উত্তরণে প্রেসিডেন্সিয়াল ডিক্রি জারি করতে পারেন। আগামী নির্বাচনে এরদোয়ান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও একে পার্টির চরম ভরাডুবি হতে পারে। বিরোধীরা আয়া সুফিয়া ইস্যুতে ডাবল স্টার্ডাড নীতির পিছনে সে সফলতার স্বপ্নে বিভোর। শেষ মুহূর্তের এরদোয়ানের পলিসি/ডিক্রি বিরোধীদের কুপোকাত করে দিতে পারে। একে পার্টিকে জিরো থেকে হিরো করে তোলার ঘুঁটি এরদোয়ান হয়তো মিস করবেন না। এই ঘুঁটিচক্রের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আয়া সুফিয়া!

আভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলাম।

- তাজাম্মল হক

পঠিত : ৪১৬ বার

মন্তব্য: ০