Alapon

আয়া সোফিয়া: সেকাল থেকে একাল...


আনুমানিক ১৫০০ বছর আগে ৫৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত কনস্টান্টিনোপলের আয়া সোফিয়া ছিল বাইজান্টাইন খ্রিস্টানদের উপাসনালয়। ১৪৫৩ সালে উসমানীয় সুলতান ফাতিহ মেহমেদ এই এলাকা জয় করেন। বর্তমানে এটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। খ্রিস্টান ও মুসলমান সংস্কৃতির মিশেল এই জাদুঘর।

আয়া সোফিয়ার আরেক নাম হাগিয়া সোফিয়া। দুর্ভেদ্য দেয়াল দিয়ে ঘেরা আয়া সোফিয়ার সুদৃশ্য গ্যালারী, ডোম (গম্বুজ) ও এর অভ্যন্তরভাগে সোনার কারুকার্জখচিত মোজাইক যেন স্বপ্নময় এক জগত।

বাইজাইন্টাইনদের আক্রমনের জবাবে ১৪৫৩ সালে উসমানীয় সুলতান ফাতিহ মেহেমেদ কনস্টান্টিনোপলে অভিযান পরিচালনা করেন। সুলতান মেহেমেদের বাহিনী বিশাল হলেও আয়া সোফিয়ার দেয়ালের কাছে তাকে থমকে দাঁড়াতে হয়। উসমানিয় বাহিনীর অনেক সৈনিকদের আটক করে রোমানরা। পরে দেয়ালের উপর তুলে ২৬০ জনের শীরচ্ছেদ করা হয়। তবুও হাল ছাড়েননি মেহেমেদ। সেনাদের সরে যেতে বলেননি। দেয়াল সামনে রেখে কনস্টান্টিপল অবরোধ করে রাখেন। তিনি প্রথমে দূত পাঠিয়ে শান্তির প্রস্তাব দিলেন এবং সবার জীবনের নিরাপত্তা দিবেন বলে আশ্বস্থ করলেন। কিন্তু যুদ্ধবাজ রোমানরা শান্তির প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে যুদ্ধ শুরু হয়। ফাতিহ মেহেমেদের অভাবনীয় যুদ্ধ কৌশলের কাছে রোমানরা পরাজিত হতে বাধ্য হলেন (তুর্কি টিভি সিরিয়াল “ফেতিহ মেহেমেদ” এ যুদ্ধকৌশলের জীবন্ত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে)।

কনস্টান্টিনোপল থেকে অনেক খ্রিস্টানরা তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যায়। এতদিন ধরে রোমানরা মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল এই বিজয়ে মেহেমেদ ও তার বাহিনী চরম প্রতিশোধ নিবে এই আতংকে যারা পালাতে পারেনি তারা সবাই আয়া সোফিয়ায় জড়ো হয়ে এর দরজা আটকিয়ে দিয়েছিল। ফাতিহ মেহেমেদ তার বাহিনী নিয়ে আয়া সোফিয়ায় প্রবেশ করে তাদের জন্য জীবন ও আশার আলোয় নিয়ে এলেন। ইসলামের শ্বাসত বিধান অনুযায়ী পরাজিতদের পূর্ণ নিরাপত্তা, স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড করার নিশ্চয়তার ঘোষণা দিলেন (উল্লেখ্য যে, এই ঘটনার প্রায় ৪০ বছর পরে স্পেনের মুসলমানরা রডারিক ও ইসাবেলার নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য স্পেনের মসজিদগুলিতে আশ্রয় নিয়েছিল কিন্তু সেদিন মুসলমানদেরকে প্রতিশ্রুত নিরাপত্তা দেয়ার পরিবর্তে পুড়িয়ে মেরেছিল)। ফাতিহ মেহেমেদের বিজয়ের সূত্র ধরেই কনস্টান্টিনোপল ইস্তানবুল নামকরণ করা হয়। উসমানীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হয় এই ইস্তানবুল এবং এই রাজধানী ১৯২৩ সাল পর্যন্ত সেখানেই ছিল।

মেহেমেদের বিজয়ের প্রতিক হিসেবে আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়।

উসমানীয় সালতানাতের শেষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মোস্তফা কামাল পাশা তুর্কীর ক্ষমতায় আসেন। এরপর তিনি ইসলাম বিরোধী নানা আইন চালু করতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় কামাল পাশা ধীরে ধীরে মসজিদকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। শুধু তাই নয় আমেরিকা থেকে আর্কিওলোজীস্ট টমাস ওয়াইমুরকে নিয়ে আসেন। টমাস ওয়াইমুর ফাতিহ সুলতান মেহেমেদের সময়ে প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দেয়া মেরি, যীশু ও অন্যান্য প্রাণীর চিত্রকর্মগুলো দেয়াল থেকে প্লাস্টার সরিয়ে উন্মুক্ত করেন। আর এগুলো সামনে নিয়ে নামাজ পড়া হারাম বিধায় মুসলমানরা আয়া সোফিয়াতে নামাজ পড়া থেকে আস্তে আস্তে সরে আসতে থাকে। আর এভাবেই আয়া সোফিয়াকে ১৯৩৪ সালের ২৪ নভেম্বর জাদুঘরে রূপান্তরের কামাল পাশার পরিকল্পনা সফল হল। পুরো ব্যাপারটাই ধরি মাছ না ছুঁই পানি যেন।

এরপর থেকেই মুসলমানরা বিভিন্ন সমাবেশে দাবি জানিয়ে আসছিল আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তরিত করা হোক। ১৯৭৪ সালে ইসলামী আন্দোলন মিল্লী গুরুশের প্রধান প্রফেসর নাজমুদ্দিন এরবাকান ক্ষমতায় এলে তাদের যুব সংগঠনের (আগেদে) পরিচালনায় আয়া সোফিয়ার সামনে ”ফাতিহ নামাজ” বা ”বিজয়ের নামাজ”র আয়োজন করা হয়। তখন থেকেই আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরিত করার জোর দাবি উঠে। ১৯৯৬ সালে আবারও ক্ষমতায় আসেন নাজমুদ্দিন এরবাকান। তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেও তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ না হওয়ায় মসজিদে রূপান্তরিত করার বিষয়টি সংসদ না ভোটে নাকচ হয়ে যায়।

২০০২ সালে নবগঠিত একে পার্টি ও রেজেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ক্ষমতায় আসলেও প্রফেসর এরবাকানের জারি করা ”ফাতিহ নামাজ” প্রতি বছর চালু থাকলেও এখন পর্যন্ত মসজিদে রূপান্তরিত করা সম্ভব হয়নি। গত ৮ জুলাই, ২০২০ তুর্কি আদালত আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রুপান্তরের মৌখিক রায় দেয়।

স্পেনের কর্ডোভা মসজিদ, আল হামরা প্রাসাদ দখলকারী এবং ঐ সময় মুসলমানদের উপর চরম নিপীড়নকারী ও তাদের দোসর ইউরোপীয়দের বিরোধীতার পরেও মসজিদের পক্ষেই দেশটির আদালত রায় দিয়েছে। আজ ১০ জুলাই চূড়ান্ত রায় প্রকাশ এবং তাতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের স্বাক্ষরের মাধ্যমে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আগামী ২৪ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম সালাতের মধ্য দিয়ে মসজিদের যাত্রা শুরু হতে যাচ্ছে।

৮৬ বছর পরে আয়া সোফিয়ার মিনার থেকে আযানের ধ্বনির অপেক্ষায় শুধু তুর্কি জাতিই নয় সমগ্র মুসলিম বিশ্ব উন্মুখ হয়ে আছে।

- খন্দকাল শাকিল আহমেদ

পঠিত : ৪২৪ বার

মন্তব্য: ০