Alapon

১৯৪৬ সালের নির্বাচন এবং পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিমদের গণরায়



জাপানের হিরোশিমা ও নাগাশাকিতে পারমানবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় আমেরিকা। এক মহা বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয় জাপান। সারা পৃথিবীতে জাপানের বেপরোয়া অভিযান থমকে যায়। আত্মসমর্পন করে জাপান। জাপানের আত্মসমর্পণের পর ১৫ই আগষ্ট, ১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। তার কিছুদিন আগে অর্থাৎ জুলাইয়ের শেষ দিকে ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে লেবার-পার্টি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বহু পূর্ব থেকেই লেবার পার্টির সাথে কংগ্রেসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং এবারের নির্বাচনের ফলাফল কংগ্রেসকে খুবই উল্লসিত করে। এর থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কংগ্রেস তৎপরতা শুরু করে।

ব্রিটিশ পলিসিই ছিলভারতে অখন্ডতার পক্ষে এবং এ ইস্যুটিতে লেবার পার্টির বেশি সমর্থন কংগ্রেস লাভ করবে বলে আশা করে। আর এ ইস্যুটিই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি করে রেখেছিল। কংগ্রেসের দাবি মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে এক জাতি এবং অখন্ড ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের শাসন। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগের দাবি মুসলমানগণ একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতি এবং সে কারণেই তাদের জন্যে হতে হবে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র। এ দুই বিপরীতমুখী দাবির চূড়ান্ত ফয়সালার জন্যে বছরের শেষে শীতের মওসুমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার জন্যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়।

নির্বাচনে মুসলিম লীগের দাবি পুরোপুরি স্বীকৃতি লাভ করে। কেন্দ্রীয় আইনসভার সকল মুসলিম আসন মুসলিম লীগ লাভ করে। প্রাদেশিক আইন সভাগুলোর ৪৯৫ মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ লাভ করে ৪৪৬টি আসন। হিন্দু প্রধান প্রদেশগুলোতে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং তা ছিল অতি স্বাভাবিক। বাংলায় ১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ লাভ করে ১১৩টি। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের মুসলিম লীগের ছয়টি আসন হাতছাড়া হয়। বাংলায় মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পাঞ্জাবে ৮৬টি মুসলিম আসনের মধ্যে ৭৯টি মুসলিম লীগ হস্তগত হয়। সিন্ধুতেও মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। সীমান্ত প্রদেশে সীমান্ত গান্ধী নামে অভিহিত কংগ্রেসপন্থী আবদুল গাফফার খানের প্রচন্ড প্রভাবের দরুন মুসলিম লীগ ৩৬টি আসনের মধ্যে ১৭টি লাভ করে এবং ডা. খান মন্ত্রীসভা গঠন করেন।

তবে এ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রতি প্রায় সকল মুসলিমের রায় ঘোষিত হয়েছে। কংগ্রেসের এক জাতি নীতি মেনে নেয় নি মুসলিমরা। অথচ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে এতটা ভালো সাফল্য পায়নি মুসলিম লীগ। তখন অনেক মুসলিমই ভেবেছে হিন্দু প্রধান কংগ্রেসের সাথে থাকা সম্ভব। এ সাধারণ নির্বাচনে এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, একমাত্র মুসলিম লীগই মুসলিমদের জন্য ভারতের প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এতে কংগ্রেসের মুসলিম লীগ বিরোধিতা তীব্রতর আকার ধারণ করে। মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্বমূলক বৈশিষ্ট্য মেনে নিয়ে তার সাথে একটা রাজনৈতিক সমঝোতায় উপনীত হওয়ার পরিবর্তে কংগ্রেস মুসলমানদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টির পলিসি অবলম্বন করে এবং মুসলমানদের আস্থাশীল প্রতিনিধিদের হাতে, এমনটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশেও রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। এর ফলে সাম্প্রদায়িক মতভেদ তীব্রতর হয় এবং উভয়ের মধ্যে আপস নিষ্পত্তি অসম্ভব হয়ে পড়ে।

অখন্ড বাংলার মূল নেতা ছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের রাজনৈতিক ইস্যুতে মতপার্থক্য দেখা দিলে মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর ফজলুল হক মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৪৩ সালের ২৯ মার্চ ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতন ঘটলে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগ নেতা ২৪ এপ্রিল খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এ মন্ত্রিসভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বাংলায় দুর্ভিক্ষ ও মহামারি দেখা দেয়। এ দুর্ভিক্ষে বাংলায় প্রায় ৫০ লাখ লোক মারা যায়। ১৯৪৫ সালের ৮ মার্চ খাজা নাজিমুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিমকে সাথে নিয়ে মুসলিম লীগ সুসংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এসময় তারা শেরে বাংলার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার করে। এবং প্রচারে কৃষক প্রজা পার্টির বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়। ধারাবাহিকভাবে কংগ্রেসীদের মুসলিম বিদ্বেষ মুসলিম লীগের প্রতি জনমত তৈরি করে। শেরে বাংলার অপরাধ ছিলো তিনি হিন্দু নেতা শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে মন্ত্রীসভা গঠন করেছিলেন। এই কারণে মুসলিম লীগ তাকে মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে প্রচার করে। ফলে শেরে বাংলার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে পড়ে। শেরে বাংলা আর কখনো রাজনীতিতে ভালো করতে পারেন নি। অথচ তিনিই অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

১৯৪৫ সালের ১০-১২ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ৩০টি মুসলিম আসনে জয়লাভ করে। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তান ইস্যুর ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে সোহরাওয়ার্দীর মুসলিম লীগ ১২০টি আসনের মধ্যে ১১৪টিতে বিজয়ী হয়। এ নির্বাচনে শেরে বাংলার প্রজা পার্টির ভরাডুবি ঘটে। সোহরাওয়ার্দীর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে ভারতের সকল প্রদেশের মধ্যে কেবল বাংলায় মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং মন্ত্রিসভা গঠন করে। ১৯৪৬ সালের ৮ এপ্রিল দিল্লীতে মুসলিম লীগ আইনসভার সদস্যদের কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। জিন্নাহর নির্দেশে সোহরাওয়ার্দী ওই কনভেনশনে পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৪৬ সালের ২৪ এপ্রিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করেন।

মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন বা প্রত্যক্ষ দিবস পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এ সময় কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। এ দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয় এবং অসংখ্য বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহসের সাথে এ দাঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সবসময় বিভক্ত ভারতের অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখতেন। বৃটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত বিভাগের ঘোষণা দিলে তিনি ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার দাবি পেশ করেন। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বিরোধিতার কারণে সোহরাওয়ার্দী শরৎ বসুর অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়।

পঠিত : ৪৬০৬ বার

মন্তব্য: ০