Alapon

ইতিহাস পাঠ কেন আবশ্যিক করা প্রয়োজন...


আমরা যদি ইতিহাস ভুলে যাই তাহলে কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। আমাদের কাছে ইতিহাস বলতে সব ৫২ কিংবা ৭১ সালের পর থেকে। তার আগেও যে বাংলা নামক কোনো ভূমি ছিল এটা বোধ হয় আমরা জানি না কিংবা শেখানোও হয় না। ইতিহাসের ফাঁক-ফোঁকড়ে কত গল্প জমা আছে তা বোধহয় চিন্তাও করতে পারি না।

মজার ব্যাপার হলো আগের ইতিহাসের বইগুলো এখন আর পাওয়া যায় না। কেন? এই কেন-এর উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। সম্মানীত আবুল আসাদ স্যার কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন, আমাদের দেশ থেকে পরিকল্পিতভাবে ইতিহাসের বইগুলো সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। তিনি কিছু কাজও শুরু করেছিলেন। আমরাও ওনাকে লজিস্টিক সাপোর্টের কথা বলেছিল। কিন্তু এই জীবন্ত এনসাক্লোপিডিয়া নিজেই সরে থাকার দূরুত্বে অবস্থান করছেন। যাহোক এখন একটা ইতিহাসের বিন্দুকণা আপনাদের সামনে তুলে দিলাম।

“...(নাটোর) মহকুমার কার্যভার গ্রহণ করার পর সরকারী কাজের বাইরে প্রথম যে কাজ করব ঠিক করলাম তা হল মহকুমা শহরের সবকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন। আছেই মাত্র তিনটি হাইস্কুল। একটি অতি সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে - জিন্নাহ স্কুল। দ্বিতীয়টি মহারাজা স্কুল এবং তৃতীয়টি বালিকা স্কুল। জিন্নাহু স্কুল কাছারির কাছেই। একদিন গেলাম সেখানে। প্রধান শিক্ষক বেশ মার্জিত শিক্ষাবিদ। স্কুলের পরিবেশ দেখে মনে হল শিক্ষকমন্ডলী দায়িত্ব-সচেতন।

পরদিন গেলাম মহারাজা স্কুলে। প্রধান শিক্ষক বেশ ভারিক্কি কিসিমের লোক, একটু যেন লা-পরওয়া গোছের। ক্লাস রুমগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ছেলেদের দু'একটা প্রশ্ন করলাম। খুব মামুলি ধরনের যেমন নাম কি, বাড়ী কোথায়, বাপ কি করেন? ইত্যাদি। দেখলাম শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র আরবী শিক্ষকই মুসলমান, বাকী সবাই হিন্দু। সবিস্ময়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, সামনের বেঞ্চ খালি থাকা সত্ত্বেও সেখানে মুসলমান ছাত্রদের বসতে দেওয়া হয়নি। যে গুটিকয়েক মুসলমান ছাত্র স্কুলে আছে তাদের স্থান চতুর্থ ও পঞ্চম সারিতে। প্রতিটি ক্লাসে একই অবস্থা। দশম শ্রেণীতে প্রশ্ন করলাম, ‘কায়েদে আজম কে?' প্রশ্নটা অবশ্য করেছিলাম প্রথমসারির ছাত্রকেই। কিন্তু সে নীরব রইল, জবাব দিতে পারল না। অবাক হলাম। বিশ্বাস করতে মন চাইছিল না যে আমি পাকিস্তানের সরেজমিনে একটা স্কুল পরিদর্শন করছি। কিন্তু আমি জানতাম না তখনো যে আমার জন্য আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছে। দশম শ্রেণীর একটা হিন্দু ছেলেও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। আরও কিছু প্রশ্ন করলাম, কিন্তু সবাই লা-জবাব। হেড মাস্টার সাহেবকে বললাম, ‘কি ব্যাপার, আপনার ছেলেরা তো কোন প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারছে না।’ হেড মাস্টার যা বললেন তা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তিনি গন্ডীর মুখে বললেন, ‘এ প্রশ্নগুলোর সাথে তো আমিও পরিচিত নই'।

বৃথা সময় নষ্ট করতে চাইলাম না। ক্লাস রুম থেকে সরাসরি চলে এলাম শিক্ষকদের কমনরুমে। কয়েকটি বইয়ের আলমারী। আলমারীগুলোর মাথার উপর দেওয়ালে টাঙ্গান রয়েছে বেশ কতগুলো লাইফ-সাইজ রঙ্গীন ছবি। এতে ছিলেন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, গান্ধী, সুভাষ এবং মহারাজা। হেড মাস্টার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কায়েদে আজমের ছবি কোথায়?’ জবাব পেলাম, ‘এটা আমাদের স্কুলে নেই।’ শুধু মাথাটায় নয়, সত্যি বলতে কি, সারা শরীরে উষ্ণ রক্ত বহু আগে থেকেই সঞ্চালিত হচ্ছিল অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। কিন্তু সর্বশেষ প্রশ্নের জবাব শুনে রক্তের সে গতি আরও বহু গুণ বেড়ে গেল। বুঝতে পারলাম আর এখানে থাকা নিরাপদ হবে না। কি থেকে কি ঘটে যায় কে জানে! চলে এলাম। কিন্তু আসার সময় হেড মাস্টার সাহেবকে সংযত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে আমলাতান্ত্রিক কায়দায় বললাম, ‘আমি পরশু আবার আপনার স্কুলে আসব। বাবায়ে কওমের অর্থাৎ আমাদের সবার বাবার ছবিটা এই রুমে দেখতে চাই এবং কাল থেকে কওমী ঝান্ডা সমবেত জাতীয় সঙ্গীতের সাথে উত্তোলন করতে হবে।’

পরদিন আমাকে একটু অবাক করে দিয়েই মহারাজা স্কুলের হেড মাস্টার সাহেব আমার বাংলোয় এলেন। কাল তাঁকে বলে এসেছিলাম যে, পরশু আমি তাঁর স্কুলে যাব। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে সেই দাওয়াত দিতে এসেছেন। তাঁর এই আচরণ আমার খুব ভাল লাগল। পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে গেলাম। স্কুল মাঠে ১৯৪৭ সালের পর এই প্রথমবারের মত জাতীয় পতাকা উড়ছে। আমাকে ছেলেরা অভ্যর্থনা করল ‘ব্রতচারী’ গান শুনিয়ে। শিক্ষক কমন রুমে এলাম। দেখলাম, কায়েদে আজমের ছোট্ট মানের ছবির ফ্রেমটা খুব উঁচুতে স্থাপন করে একটা রুমাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে এবং একটা রশি লাগিয়ে রুমালটা টানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাকে পর্দা উন্মোচন করার জন্য অনুরোধ করা হল। আমি রশি টানলাম। সবাই করতালিতে কামরাটা মুখর করে তুলল। ফ্রেমের মধ্যে ছবিটা পোস্ট কার্ড সাইজের।

এবার বক্তৃতার পালা। কিছু বলতে হবে। বললাম, ‘যে গতিতে আপনারা অগ্রযাত্রা শুরু করেছেন, তাতে আমি খুব খুশী হয়েছি।’ মনে হল তারাও খুব খুশী হয়েছে এসডিওকে খুশী দেখে। কিন্তু তারা এটা মোটেও আঁচ করতে পারেনি যে এই ব্যাটা এসডিও কাল আবার স্কুল বসার সময় সশরীরে এসে হাজির হবেন।

পরদিন সকাল ঠিক দশটায় গিয়ে মহারাজা স্কুলে উপস্থিত হলাম। স্কুলের ত্রিসীমানার কোথাও জাতীয় পতাকার নাম-নিশানা পাওয়া গেল না। এতে অবশ্য আমি অবাক হলাম না। শিক্ষকদের কমন রুমে গিয়ে ঢুকলাম। ‘কায়েদে আজম’ উধাও। এটাও অপ্রত্যাশিত ছিল না আমার কাছে। জিজ্ঞেস করলাম হেড মাস্টার সাহেবকে, ‘ছবিটা কোথায় গেল?’ কোন উত্তর পেলাম না। কারো মুখে রা নেই। সবাই হতচকিত ও বিহবল হয়ে পড়েছেন। এরকম একটা ঘটনা বাস্তবে ঘটতে পারে এটা যেন তারা কল্পনাও করতে পারেননি।
এই নীরবতা ভঙ্গ করে আমার এক নতুন আর্দালী এক পানের দোকানদারের হাত ধরে প্রায় টেনে-হেঁচড়ে আমার সামনে হাজির করল। ‘ব্যাপার কি?’ জানতে চাইলাম। সে যা বলল তা হল কাল যে ছবিটা এখানে টাঙ্গানো হয়েছিল সে ছবিটা এই ব্যাটা দোকানদার ওর দোকানে টাঙ্গিয়ে রেখেছে আজ। কত বড় সাহস! পান দোকানদার কাচুমাচু হয়ে যা বলল তা হল, এতে ওর কোন অপরাধ নেই। এই ছবিটার প্রকৃত মালিক সেই, স্কুল কর্তৃপক্ষ কাল কিছুক্ষণের জন্য এই ছবিটা তার কাছ থেকে ভাড়া করেছিল। কাজ শেষে কালই আবার তাঁরা ছবিটা তাকে ফেরত দিয়েছে। এমনভাবে এঁদের হাটে হাড়ী ভাংবে এঁরা ভাবতেও পারেন নি।

একজন শিক্ষক (হেডমাস্টার নন) বিনীত কণ্ঠে বললেন, ‘স্যার, যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলব।’ আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘নির্ভয়ে বলুন।’ তিনি বললেন, ‘স্যার, আপনি যা চাচ্ছেন তার সাথে যদি আমরা একমত না হই তবে কি আমরা বিনা ঝামেলায় পদত্যাগ করতে পারব?’ জবাবে শান্ত কণ্ঠে বললাম, ‘নিশ্চয়ই পারবেন, খুশী মনে পারবেন। কোন ঝামেলাও হবে না।’ এবার হেড মাস্টার মরিয়া হয়ে মুখ খুললেন, ‘স্যার, এই স্কুলের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্ট কলকাতাবাসী মহারাজা, এসডিও নন।’ বললাম, ‘সে আমি খুব ভাল করেই জানি। এসডিও হিসাবে আমি জানি আমাকে কি করতে হবে এবং আমি আমার দায়িত্ব সম্পর্কে খুবই সচেতন। হেড মাস্টার সাহেব আর কিছু বললেন না। আমি পায়চারি করতে করতে হেড মাস্টার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এ স্কুলটির এ্যাফিলিয়েশন কি কলকাতার সঙ্গে না ঢাকার সঙ্গে?’ উত্তর পেলাম না। হেডমাস্টার সাহেবের চেহারা আরো গম্ভীর হল। হঠাৎ কাঁচের আলমারীর ভিতর একটা বইয়ের উপর নজর পড়ল। বইটা দেখতে চাইলাম। একজন শিক্ষক নীরবে বইটা আমার হাতে তুলে দিলেন। পাতা উল্টাতে উল্টাতে কাঙ্খিত জায়গা পেয়ে গেলাম। নাটোর মহারাজা হাইস্কুল কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাফিলিয়েশন প্রাপ্ত। আগের বছর এই স্কুলের কত জন ছাত্র পাস করেছে তারো একটা হিসাব এতে আছে।

আমার মনে নানা ধরনের সন্দেহ উঁকি-ঝুঁকি দিলেও, সত্য বলতে কি, আমি এতটা ভাবতে পারিনি। ইট ইজ টু মাচ! এই স্কুল সম্পর্কে যা সিদ্ধান্ত নেবার তা নিয়ে ফেলেছি তৎক্ষণাত, নিজের অজান্তেই। চুপচাপ চলে এলাম নিজের বাংলোয়। সরকারী স্কুলের একজন অবসরপ্রাপ্ত হেড মাষ্টার নাটোরের কানাইখালিতে থাকতেন। তাঁকে রেক্টর নিয়োগ করে মহারাজা স্কুলে পাঠালাম পরদিন।

এদিকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাজশাহী থেকে আমার কাছে এক বার্তা পাঠালেন। তাতে তিনি জানালেন যে, কলকাতায় বসবাসকারী মহারাজা প্রাদেশিক গভর্নর এ কে ফজলুল হক সাহেবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মহারাজা অভিযোগ করেছেন, এক ছোকরা এসডিও তার স্কুলটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। সুতরাং হক সাহেব যেন ত্বরিত ব্যবস্থা আনেন।

ঐ দিন বিকেলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্বয়ং নাটোরে তশরিফ আনলেন। সোজা নিয়ে গেলাম তাঁকে মহারাজা স্কুলে। শিক্ষকদের কাছে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিলাম এই বলে যে, ভদ্রমহোদয়গণ, আজ আমাদের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যের কথা এই যে, মহারাজা স্কুলের নব অগ্রযাত্রাকালে আমাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব সুদূর রাজশাহী থেকে আপনাদের আশীর্বাদ করার জন্য স্বয়ং হাজির হয়েছেন। আরও বললাম, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আপনাদের এই যাত্রা শুভ হবে, কামিয়াব হবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের মনে যাই থাক, তিনি তাঁর বক্তৃতায় আমার কথাগুলোরই পুনরুক্তি করলেন মাত্র।

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব তাঁর সদর দফতরে ফিরে গিয়ে মহারাজা স্কুল সম্পর্কে কি রিপোর্ট দিয়েছিলেন জানি না। তবে সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তিনি আমাকে সবিস্ময়ে বলেছিলেন, এটা কি করে সম্ভব হল - যে স্কুলটি এই দেশে অবস্থিত, স্কুলের পাঠ্য বইগুলো এখানকার টেক্সট বুক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত অথচ ছেলেরা পরীক্ষা দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিলেবাস অনুসারে। তাঁকে এ তথ্যও দিয়েছিলাম, যে কটি মুসলমান ছেলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে তারা হয় প্রাইভেট পরীক্ষা দেয় নতুবা পাশের দিঘাপতিয়া স্কুলের ছাত্র হিসাবে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষায় অংশ নেয়। এ স্কুল থেকে যারা মেট্রিক পরীক্ষা দেয় তারা সবাই হিন্দু ছাত্র এবং পরীক্ষা দেয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিলেবাস অনুসারে।

যা হোক, মহারাজা স্কুলের কীর্তিমান হেড মাস্টার এবং তাঁর চার জন সহকর্মী শিক্ষক হঠাৎ এক দিন লাপাত্তা হয়ে গেলেন। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেল, তাঁরা সীমান্তের ওপারে চলে গেছেন। এখানে বলে রাখা দরকার যে তাঁরা স্বেচ্ছা কৌমার্য পালন করে আসছিলেন বহু বছর যাবত।

সুখের কথা যে, নাটোর মহারাজা স্কুল তার নবষাত্রা সফলতার সাথে সম্পন্ন করল। এদিকে এসডিও ‘সাম্প্রদায়িক’ আখ্যায় ভূষিত হলেন। এই সম্মানসূচক ভূষণ আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিমুখে গ্রহণ করলাম স্কুলে প্রথম বারের মত একটা মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে। এ মাহফিলে সানন্দে ঘোষণা করলাম যে, নিজেকে একজন মুসলমানের সন্তান বলে পরিচয় দিতে আমি নিঃসন্দেহে গর্ববোধ করি।”

পিএ নাজির
বই : স্মৃতির পাতা থেকে

পঠিত : ১৭০০ বার

মন্তব্য: ০