Alapon

জান্নাত এবং জান্নাতি মানুষের বর্ণনা...


আল্লাহ তায়ালা জান্নাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন - وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنفُسُكُمْ - আর জান্নাতে, বিশেষভাবে তোমাদের জন্য রয়েছে তোমাদের মন যা চায় তা-ই। তোমাদের 'শাহওয়া' থেকে যেটাই আসে। 'শাহওয়া' মানে তীব্র ক্ষুধা, কোন কিছুর জন্য প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা। শ্রোতাদের মধ্যে যে বাচ্চারা আছে - প্লে স্টেশনে গেইম খেলার জন্য তাদের মধ্যে প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। তাদের মাথায় শুধু একটা জিনিসই থাকে - আমাকে খেলতে হবে, আমাকে খেলতে হবে, আমাকে খেলতে হবে। তারপর তারা খেলতে শুরু করে। মানুষ ভিডিও গেইমে আসক্ত হয়ে পড়ে......

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমাদের বিভিন্ন ধরণের ক্ষুধা রয়েছে। কারো এই ক্ষুধা বিনোদনের জন্য, কারো মিউজিকের জন্য, কারো আবার আড্ডা দেয়ার জন্য; চল চল, আড্ডা দেই। কারো আবার খাবারের জন্য, অনেকে আবার ইন্দ্রিয়পরায়ণ। আমাদের এই ক্ষুধাগুলো রয়েছে। আল্লাহ বলছেন আমি তোমাদের সকল ক্ষুধা নিবারণ করবো। وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنفُسُكُمْ - তোমাদের যত ক্ষুধা আছে আমি তার সব মেটাবো। আমি তোমাদের সম্পূর্ণরূপে তৃপ্ত করবো। তোমরা কোন ক্ষেত্রেই অতৃপ্ত থাকবে না। জানেন? এটা মাত্র শুরু। وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ - ব্যাপারটা সত্যিই অসাধারণ। আরবিতে 'ইদ্দাআ' শব্দের অর্থ হল, কোন কিছু দাবি করা, এর আরেকটি অর্থ - 'আত তলাব' কোন কিছু খোঁজ করা। তোমরা যা কিছু চাইবে।

বর্তমানে, আমি আপনি এই পৃথিবীতে বাস করছি আর আমাদের কল্পনাশক্তি সীমিত। এটা নিয়ন্ত্রিত। তাই এখন, আমি কেবল আমার সীমিত কল্পনা শক্তির ভেতর থেকেই কোন কিছু কল্পনা করতে পারি। সত্য কিনা? আমি এখন যা কিছু চাইবো তা আমার সীমিত কল্পনাশক্তির পরিসর থেকেই।

এখন, রাসূলুল্লাহ (স) জান্নাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন - "مَا لَا عَيْنٌ رَأَتْ - যা কোন চোখ কোনদিন দেখেনি।" "وَلَا أُذُنٌ سَمِعَتْ - কোন কান কোনদিন শোনেনি।" "وَلَا خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ - মানুষের অন্তর কোনদিন পরিকল্পনা করেনি।”

যখন আমি আর আপনি একদিন আল্লাহর অনুমতিক্রমে এবং তাঁর দয়ায় - দোয়া করি, আল্লাহ আমাদের সবাইকে জান্নাত দান করুন - যখন আমরা জান্নাতে প্রবেশ করবো, আমাদের কল্পনাশক্তি কি তখন বিস্তৃত হবে না? তখন কি এমন হবে না যে আমরা এমনসব জিনিস দেখবো যা আগে কখনো কল্পনাও করিনি? হ্যাঁ, এমন হবে। তাহলে, দুনিয়াতে যে ক্ষুধাগুলোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন জান্নাতের শুরুতে আপনার শুধু সে ক্ষুধাগুলোই থাকবে। কিন্তু জান্নাতে আসার পর আপনার মাঝে এখন নতুন ধরণের কামনাবাসনা জাগ্রত হতে থাকবে। আপনি এখন নতুন নতুন জিনিস চান। কারণ, এখন এমনসব জিনিস দেখতে পাচ্ছেন যা আগে কখনো দেখেননি। তাই, আল্লাহ বলছেন শুধু তোমাদের 'শাহওয়া' নয় বরং "ওয়া লাকুম ফিইহা মা তাদ্দাউন" পরবর্তীতে জান্নাতে তোমাদের মাথায় নতুন কোন চাহিদা জাগ্রত হলে সেটাও তুমি পাবে। "ইয়া আল্লাহ! আমি ঐ জিনিসটাও চাই" আপনি তখন সেটাও পাবেন।

ব্যপারটা এমন হবে না যে তুমি তো ইতোমধ্যে একবার অর্ডার করেছ, আর করতে পারবে না; অথবা আমরা শুধু একবার অর্ডার নিয়ে থাকি। জান্নাত এরকম হবে না। একবার অর্ডার করার পর আপনাকে সেটা পরিবেশন করা হয়েছে। এরপর আপনার কামনা বাসনার বিকাশ ঘটে। আপনাকে তা দেওয়া হয়, এরপর আপনি আবারো চান, আপনাকে আবারো দেওয়া হয়। এভাবে আপনি শুধু চাইতেই থাকেন আর সর্বদা আপনার এই চাহিদা পূরণ করা হতে থাকে। "ওয়া লাকুম ফিইহা মা তাদ্দাউন।" জান্নাতের কি অসাধারণ এক বর্ণনা!

কিন্তু সবচেয়ে অসাধারণ বর্ণনাটি আপনাদের নিকট উপস্থাপন করেই আজকের আলোচনার সমাপ্তি টানছি। বর্ণনাটি পরবর্তী আয়াতে। আমি যেহেতু পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত তাই আমি ব্যাপারটি উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির আলোকে ব্যাখ্যা করব। ইন্দো-পাক সংস্কৃতিতে, যদি কারো বাসায় যান, তারা শুরুতেই আপনাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে যান না, তারা প্রথমে আপনাকে লিভিং রুম বা গেস্ট রুমে নিয়ে বসান। আসল ডিনারের পূর্বে আপনাকে নাস্তা-পানি, পিঠা, পায়েস প্রভৃতি পরিবেশন করা হয়। তাহলে, শুরুতেই তারা আপনাকে ডিনার পরিবেশন করেন না, প্রথমে লিভিং রুমে নিয়ে বসতে বলেন এবং হালকা চা-নাস্তা পরিবেশন করেন। এমন করার উদ্দেশ্য কী? আপনার ক্ষুধাকে কিছুটা দমন ধরানো। তারপর, আপনাকে আসল খাবার পরিবেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। ঐ দুইটার মাঝে এটাই পার্থক্য। তাহলে, কারো বাসায় গেলে শুরুতে প্রাথমিক একটি আপ্যায়ন পেয়ে থাকেন, সামান্য জুস, পানি ইত্যাদি। আর এর মধ্যে ডিনারের প্রস্তুতি চলতে থাকে, টেবিল সাজানো হচ্ছে ইত্যাদি।

প্রাথমিক এই আপ্যায়নকে বলা হয় 'নুযূল।' আরবি ভাষায় এই প্রাথমিক আপ্যায়নকে বলা হয় 'নুযূল।' আর নুযূল শব্দটি এসেছে 'নাজালা' থেকে, যার অর্থ - অবতীর্ণ হওয়া, নেমে আসা। এই শব্দ ব্যবহার করা হত কারণ, আগের দিনে মানুষ কারো বাড়িতে যেত ঘোড়ায় চড়ে বা উটের পিঠে চড়ে। তারপর সে কী করত? সে ঘোড়া থেকে নেমে আপনার বাড়িতে আসতো। আর আপনার বাড়িকে বলা হত, মাঞ্জিল। আরবিতে মেজবানের বাড়িকে বলা হত মাঞ্জিল। তো, সে আপনার মাঞ্জিলে আসলে আপনি তাকে 'নুযূল' প্রদান করেন, প্রাথমিক আপ্যায়ন, আসল ভোজের ভূমিকা স্বরূপ।

জান্নাতের যে বর্ণনা আমি আপনাদের দিয়েছি, যে বর্ণনা আপনাদের সামনে তুলে ধরেছি, পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন - نُزُلًا مِّنْ غَفُورٍ رَّحِيمٍ - "এটা ক্ষমাশীল করুনাময়ের পক্ষ থেকে প্রাথমিক আপ্যায়ন।" (৪১:৩২) আমি তোমাদের আপ্যায়ন করা শুরু করলাম মাত্র।

যত কিছু আমরা কামনা করি, যত কিছু আমাদের কল্পনা শক্তি দিয়ে আমরা আল্লাহর কাছে চাইতে পারি, এরসব কিছুই আপ্যায়নের শুরু মাত্র। এর মাধ্যমে আপ্যায়ন শুরু হল মাত্র। জানেন? এটা কেন অসাধারণ চমকপ্রদ? কারণ, দিনশেষে, আমরা তো সৃষ্টি মাত্র। কতটুকুই বা আমরা আর চাইতে পারি? কত পরিমাণ আমরা চাইতে পারি? এমনকি জান্নাত দেখার পরেও আমাদের কল্পনাশক্তি সীমিত। এমনকি জান্নাত দেখার পরেও। তাই, আল্লাহ আমাদের এমনসব জিনিস দিবেন, আমাদের চাওয়া ব্যতীত, যা এমনকি আমরা কল্পনাও করতে পারি না, জান্নাতে প্রবেশ করার পরে। আর এসব কিছু তোমাদের পরবর্তীতে দেওয়া হবে। যা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। এটা তোমার ভোগের শুরু মাত্র।

এরাই হল জান্নাতের মানুষ। এরা দীন পালনে সাহসী। এরা ইসলামের জন্য দাঁড়িয়ে যায়। এরা নিজেদের সাথে এভাবে প্রতিজ্ঞা করে যে, দিন দিন তারা ভালো থেকে আরও ভালো মুসলিমে পরিণত হবে, আরও অধিক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মুসলিমে পরিণত হবে। দীনের শিক্ষাগুলো প্র্যাকটিক্যাল্লি নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করবে। এরা এমন ধরণের মুসলিমে পরিণত হবে, দিনের পর দিন। আল্লাহ যেভাবে বলেছেন - ثُمَّ اسْتَقَامُوا - অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে। আল্লাহ আমাদের এমন মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা দীনের উপর অবিচল থাকে।

- নোমান আলী খান

পঠিত : ৮৪৯ বার

মন্তব্য: ০