Alapon

সাইপ্রাস বিজয়ঃ পাশ্চাত্যের গালে সবচেয়ে বড় চপেটাঘাত



২০ শে জুলাই, ১৯৭৪ সাল!!!

ইঞ্জিনের শব্দে স্থলের অংকুরকণাও যেন প্রকম্পিত। পরক্ষণেই সাইপ্রাসের নীল আকাশের বুক চিরে শতশত বিমানের আগমণ। সেই সাথে ক্ষিপ্র গতিতে নেমে আসছে হাজার হাজার জানবাজ তার্কিশ প্যারাট্রুপার। দৃশ্যটি কোন একশন মুভির নয়। দৃশ্যটি সাইপ্রাসে চালিত মুসলিম গণহত্যার বিরুদ্ধে তুরস্ক সেনাবাহিনীর উদ্ধার অভিযান।

কৌশলগতভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বীপটি হযরত উসমান (রা) এর সময় থেকে মুসলমানদের অধীনে ছিল। কিন্তু ১৯ শতাব্দীর শেষের দিকে এই দ্বীপটি ব্রিটিশ বাহিনী উসমানী খলীফাদের কাছ থেকে দখল করে নেয়। এরপর থেকেই সেখানকার মুসলিমদের উপর চলে আসছিল অকথ্য নির্যাতন। পৃথিবীর নিপীড়িত অন্যান্য অঞ্চলের মতোই তাদের পাশে দাড়ানোর সাহসটুকুও করনি কোন দেশ।
ম্যাসাকার মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৬৩ সাল থেকে। মুসলিম বিদ্বেষী গ্রীক সরকারের অত্যাচারে নাজেহাল সাইপ্রাসের মুসলিম সমাজ।

ঘটনার শুরু ৭৪ সালের জুলাই মাসে। ১৫ জুলাইতে ক্যু এর মাধ্যমে জাদরেল আর্মি শাসনের অধীনে আসে গ্রীস। এরপরই দ্বীপটিতে মুসলিমদের উপর নেমে আসে চরম মাত্রার নির্যাতন। পূর্বের মতো এবারও তুরস্ক চুপ থাকবে সেরকম একটি বিশ্বাস ছিল সকলের।

কিন্তু ক্ষমতায় তখন তুরস্কের ইসলামী আন্দোলন মিল্লি গুরুশ। ১১% ভোট অর্জন করার কারণে তুরস্কের প্রথমসারির সেক্যুলার দল CHP(৩৩%) এর সাথে কোয়ালিশন করে ক্ষমতার আসনে মিল্লি গুরুশ যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দুই বিপরীত আদর্শের দল জোটবদ্ধ ভাবে ক্ষমতায় রাজনীতির ইতিহাসে বিরল এবং একই সাথে যেকোন দেশের রাজনৈতিক ময়দানে তা থেকে শেখার অনেক কিছুই আছে। সকল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় মিল্লি গুরুশের অধীনে জোটের শর্তানুযায়ী। দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ উপ-প্রধানমন্ত্রীর আসনে মিল্লি গুরুশের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর এরবাকান।

সংসদকে মানাতে পারছিলেন না সাইপ্রাস অভিযানের ব্যাপারে। দিনকে দিন মুসলিমদের একের পর এক চিঠি আসছিল প্রফেসর এরবাকানের কাছে যে, আমাদের উদ্ধার করুন। কিন্তু সংসদ সায় না দিলে কিছু হচ্ছেও না। দল হিসেবে মিল্লি গুরুশের রাজনৈতিক দল মিল্লি সালামেত পার্টির পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয় ডিসিশন নেয়া, কেননা ভোট মাত্র ১১% ও সংসদ সদস্য মাত্র ৪৮ জন।

অবশেষে সুযোগ এল। প্রধানমন্ত্রী বুলেন্ত এজেভিদ তখন ইংল্যান্ড সফরে। পদাধিকার বলে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রফেসর এরবাকানের হাতে।
একমুহূর্ত দেরী না করে ১৯ শে জুলাই আদেশ দিলেন সেনাবাহিনীকে পুরোদমে সাইপ্রাসে আক্রমণ করতে। আক্রমণের পূর্বে জানবায ১০০ পাইলটকে ডেকে নিয়ে গেলেন একটি সম্মেলন কক্ষে।
সেখানে তাদেরকে জিহাদের গুরুত্ব এবং মজলুমের পাশে দাড়ানোর মহত্ব সম্পর্কে অনুপ্রাণিত করলেন।

সর্বশেষে প্রফেসর এরবাকান তাদের উদ্দেশ্যে বলেন- “আপনাদের অভিযানের সময় ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত আমেরিকান রণতরী থেকে হুমকি আসতে পারে, এমনকি সরাসরি হামলাও হতে পারে। আপনাদের মধ্যে কারা সেই হুমকিকে প্রত্যাখ্যান করে, নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে, নিজের মজলুম ভাইদের জন্য জালিম আমেরিকার রণতরীতে হামলা করার দুঃসাহস দেখাতে পারবেন?? মনে রাখবেন আমরা এখানে সরাসরি আমেরিকার সাথে সঙ্ঘাতে যাচ্ছি। যারা দুঃসাহসী কেবলমাত্র তারাই হাত তুলুন। কেউ না চাইলে আমরা অন্য কাউকে তার জায়গায় রিপ্লেস করব। আমরা কোন বুযদীলকে নিয়ে যুদ্ধে যেতে চাই না।”

কনফারেন্স রুমে অবস্থিত ১০০ জন পাইলটের সকলেই হাত তুললেন। কনফারেন্স রুমের ভেতর অন্যরকম এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ বিরাজ করছিল তখন। পাইলটদের কারও চেহারায় দৃঢ় প্রত্যয় কিংবা কারও চোখে আত্মবিশ্বাসের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হচ্ছিল নতুবা কারও শরীরের মধ্যে দুঃসাহসের বিজলী খেলে যাচ্ছিল।



২০ শে জুলাই, শত শত প্যারাট্রুপারের কারণে সাইপ্রাসের আকাশের চিত্র হয়ে উঠেছিল অনন্যসাধারণ এক চিত্রকর্ম।

এরই মধ্যে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বুলেন্ত এজভিদকে বারংবার ফোন করে অপারেশন থেকে সরে আসার সরাসরি আদেশ দিচ্ছিলেন।
এজেবিদ মন্ত্রীসভার বৈঠক ডাক দিলেন। CHP এর মন্ত্রীদের অধিকাংশই ভয়ে কাবু। তাদের মতে- “স্বয়ং হেনরি কিসিঞ্জার ফোন করেছেন। এবার যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা দিতেই হবে।”

প্রফেসর এরবাকান মন্ত্রিসভার বৈঠকে উঠে দাড়ালেন। সকলকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন- “ইসরাঈল আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবকে কী মেনে নিয়েছে? জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলেই যে আমাদেরকে সেই একই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এমন কোন কথা নেই। দেশ ও জাতির অস্ত্বিত্বের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করার কোন যৌক্তিকতাই নেই।”



অবশেষে, আল্লাহর অশেষ রহমতে ৫০০ জন তরতাজা সৈনিকের রক্তের বিনিময়ে সাইপ্রাসের মুসলিমদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এরকম একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মাত্র ৫০০ জন তার্কিশ সৈন্যের শাহাদাত প্রমাণ করে তৎকালীন সময়েও তার্কিশ সেনাবাহিনী কতটা যোগ্য ছিল। সেই সাথে ৭০০ গ্রীক সৈন্যকেও বন্দী করতে সক্ষম হয় তুরস্ক।


আজ সাইপ্রাসের ৪৬ তম বিজয় বার্ষিকী। বলা হয়ে থাকে, উসমানী খিলাফাতের পতনের পর এই প্রথম তুরস্কের সেনাবাহিনী কোন যুদ্ধে বিজয় লাভ করে।

আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সকল হুমকি এবং তাদের রণতরীকে উপেক্ষা করে সাইপ্রাসে অভিযানের নির্দেশ প্রদানকারী এবং সফলভাবে বিজয় অর্জনকারী ইসলামী আন্দোলনের অসীম সাহসী নেতা নাজমুদ্দিন এরবাকান প্রায় সময়ই বলতেন- ''আমেরিকা!! তো আমার কী? কিসের ইউরোপীয় ইউনিয়ন? আমরা হলাম সুলতান ফাতিহর উত্তরসূরি, আমরা ১০০০ বছর সমগ্র দুনিয়াকে শাসন করেছি। আমরা ইউরোপকে আলো দেখিয়েছি, ওদেরকে শিক্ষিত করেছি। আমরা আজও যদি কোরআনকে বুকে ধারন করে অগ্রসর হই, তাহলে কোন শক্তিই আমাদেরকে পরাভূত করতে পারবে না।''

উল্লেখ্য, তুর্কি অধিকৃত সাইপ্রাসের মানচিত্র প্রফেসর এরবাকান নিজে তৈরী করেন এবং তা ছিল জায়োনিস্টদের প্রতি তার সরাসরি জবাব।

পঠিত : ৮৪৩ বার

মন্তব্য: ০