Alapon

আলজেরিয়ায় ফ্রান্সের বর্বরতার খন্ডচিত্র...



বিখ্যাত ফরাসী ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ অ্যালেক্সিস ডি টক্ভিল তাঁর ‘Democracy in America’ (1835) গ্রন্থে ইউরোপীয়ানরা অন্যদের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের মনস্তাত্ত্বিক দিক নিয়ে এবং অন্যের উপর নিজের চালানো জুলুমের বৈধতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, "আমরা যদি আমাদের চিন্তাধারার প্রতি লক্ষ্য করি, আমাদেরকে প্রায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় যে, ইউরোপীয়রা মানবজাতির এক ভিন্ন গোত্রভুক্ত সম্প্রদায়, যেমন ইতর প্রাণীর বিপরীতে মানব সম্প্রদায়। সে তার নিজের প্রয়োজনে তাদেরকে বশীভূত করে এবং যখন তা করতে ব্যর্থ হয় তার বিনাশ সাধন করে।" যা চেতনাগত দিক থেকে জার্মানির নাতসিদের থেকেও ভয়াবহ।

ইউরোপীয়নরা নিজেদেরকে বিশ্বে সভ্য ও গণতান্ত্রিক মনোভাবা সম্পন্ন হিসেবে উপস্থাপন করলেও আদতে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে তারা ভয়ংকর রকমের ফ্যাসিস্ট। (সম্প্রতি Black Lives Matter আন্দোলনে তাদের ভিতর কিছুটা তাদের পাপের বোধদয় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে) এই ব্যাপারে তাদের কলোনিয়াল যুগের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায় যে প্রায় পুরো পৃথিবী জুড়ে কি পরিমাণ বিভতসতা মানবজাতির উপর চালিয়েছে তারা। এমনকি এখনো বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে এবং আফ্রিকায় চালাচ্ছে গণতন্ত্রের নামে। এই ইউরোপীয়ানদের মধ্যে অত্যাচার, জুলুমের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে যে দেশটি সেটি হলো "ফ্রান্স"! এক আফ্রিকার দিকে তাকালেই ফ্রান্সের ভয়াবহতম অত্যাচারের স্পষ্ট প্রমাণ দেখা যায়।

আফ্রিকা পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা অন্যতম একটি মহাদেশ। এই প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করতে হেন অপকর্ম নেই যা করেনি এই ‘ভিন্ন গোত্রভুক্ত’ ইউরোপিয়া সম্প্রদায় । তাদের কাছে আফ্রিকার মানুষ ছিল ওরাং ওটাং এমনকি এখনো বিভিন্ন ইতিহাস, তত্ত্ব, নৃ-তত্ত্ব ইত্যাদির ভিতর দিয়ে আফ্রিকার মানুষগুলোকে ইতর প্রাণী হিসেবেই উপস্থাপন করতে সচেষ্ট এই কথিত সভ্যতার কান্ডারিরা।

এই ‘মহান’ ইউরোপের গোত্রভুক্ত ফ্রান্স উনিশ শতকের শুরুতে উপনিবেশ বিস্তার করতে শুরু করে। বর্তমানে ফ্রান্সের আয়তন ৬ লাখ ৭৪ হাজার ৮৪৩ বর্গ কিলোমিটার। অথচ ১৯৬০ সাল পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদী এ রাষ্ট্রটির আয়তন ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বড় একটি অংশ ছিল আফ্রিকা জুড়ে। ১৮৩০ সালে আলজেরিয়া দখলের মধ্য দিয়ে আফ্রিকায় প্রবেশ করে ফ্রান্স।

আলজেরিয়া ছিল মুসলিম প্রধান দেশ।ফরাসিরা এইখানে উপনিবেশ স্থাপনের পর থেকে নানান অজুহাতে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিলো মূলত মুসলিমদেরকেই। (এখনো পর্যন্ত ফ্রান্সে রাষ্ট্রীয়ভাবেই মুলিমরা বিভিন্নভাবে হেনস্তার শিকার হতে খবর পাওয়া যায়)। ফরাসিরা শুধু হত্যাকাণ্ডই চালায়নি সেখানে অবৈধভাবে অভিবাসনও করেছিলো (প্রায় দশ লাখ)। ফরাসিরা দেশটি শাসন করে ১৮৩০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত। আলজেরীয় তথ্যসূত্র মতে প্রায় ১৩০ বছরের ‘সভ্যতার মিশনে’ তারা বিশ লাখের বেশি আলজেরিয়কে হত্যা করেছে। ফ্রান্সের হিসাব অনুযায়ী দশ লাখ আলজেরিয় এবং এক লাখ ফরাসি নিহত হয়েছে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনে।

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে হলে জেনারেল শার্ল দ্য গলের আহ্বানে আলজেরিয়ার তরুণরা ফ্রান্সের পক্ষে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়। (অধিকাংশই যোগ দিয়েছে বাধ্য হয়ে যেহেতু আলজেরিয়া ছিল ফ্রান্সের কলোনি) ১৯৪৫ সালে নাৎসী বাহিনির বিরুদ্ধে ফ্রান্স ও মিত্র বাহিনির জয়লাভ করে। বিজয় উদযাপনের জন্য ঐবছর ৮ মে আলজেরিয়ার সেফিত শহরে জমায়েত হয় তরুণরা। সেখানে সাল বোউজিত নামে এক কিশোর স্বাধীন আলজেরিয়াযর পতাকা নিয়ে এলে আলজেরিয়দের অনেকেই স্বাধীনতার স্বপক্ষে স্লোগান দেয়া শুরু করে। এসময় সেখানে জেনারেল ডুভালের নেতৃত্বে ফরাসি সেনারা গুলি চালালে ওই কিশোর নিহত হয়। আন্দোলন তীব্র হলে মুহূর্তেই পুরো এলাকায় তাণ্ডব শুরু করে ফরাসি সেনারা। ওই দিন সেতিফে এক হাজার আলজেরিয়ান নিহত হয়। সেতিফের পাশের শহর গুয়েলমাতে একই দিন বিক্ষোভ মিছিল বের করে আলজেরিয়ানরা।ড

সেখানেও গুলি চালায় ফরাসি সেনারা। এর ফলে শহর দুটিতে ফরাসি সেটলারদের সঙ্গে দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ে আলজেরিয়রা। ইউরোপিয় ইতিহাসবিদদের দাবি দাঙ্গায় ১০৩ জন ফরাসি নাগরিক নিহত হয়েছে (এই সংখ্যাগত তথ্য কিন্তু ফরাসি জেনারেলরাই ইতিহাসের নামে লেখিয়েছে) তবে আলজেরিয়দের দাবি নিহতের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ১২ । এর প্রতিক্রিয়ায় আলজেরিয়া জুড়ে হত্যার উৎসবে মেতে ওঠে ফরাসি সেনারা। আলজেরিয়দের দমনের জন্য তাৎক্ষণিক যে গণহত্যা চালায় তাতে নিহত হয় প্রায় ৪৫ হাজার আলজেরিয়। কতোটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ছিলো তা ফুটে ওঠে এক ফরাসি সেনা কর্মকর্তার মন্তব্যে। আলজেরিয়দের লাশ গুম করার দায়িত্বে ওই সেনা কর্মকর্তা তার সঙ্গের অফিসারকে বলেন, ‘‘You are killing them faster than I can bury them.’ (তাদেরকে যতো দ্রুত কবর দিতে পারছি তার চেয়ে দ্রুত তাদের হত্যা করছ )।

মুসলমানদের গ্রামগুলোতে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে ফরাসি সশস্ত্র বাহিনী কারাটা ও বুগি এলাকায় বিমান হামলা চালায়। ফরাসি সেনারা জাইলস শহরে আলজেরিয় বন্দিদের নির্বিচারে হত্যা করে। ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের দাবি নিহত আলজেরিয়দের সংখ্যা ৬ হাজার। তবে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের দাবি পাঁচ দিনে ফরাসি সেনারা পুরো আলজেরিয়ায় ৪৫ হাজার লোককে হত্যা করেছে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক অ্যালিস্টার হর্ন তার বিখ্যাত "অ্য সেভেজ ওয়্যার অব পিস" বইতে লিখেছেন, অভিযান চলাকালে নৃশংসভাবে আলজেরিয় নারীদের ধর্ষণ করে ফরাসি সেনারা। ধর্ষণ শেষে অনেক নারীর স্তুন তারা কেটে ফেলে। হত্যার পর অনেকের মৃতদেহ বিকৃত করতেও কসুর করেনি ফরাসি সেনারা। এমনকি মুসলিম কোয়াটারগুলোকে তারা টাইম বোম দিয়ে নারী শিশু সহ গুড়িয়ে দিতে থাকে।

এছাড়া আলজেরিয়ায় ফরাসি দখলদারিত্ব এবং ঔপনিবেশিক শাসনামলের শেষের দিকে মানবতার বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধ ঘটায় পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে।

নানা তথ্য-প্রমাণে দেখা গেছে ফরাসিরা ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে আলজেরিয়ায় ১৭টি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল (পরীক্ষা নাম করে)। প্রথম বোমাটি ফাটানো হয়েছিল ১৯৬০ সালে। ওই বোমার ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল জাপানের হিরোশিমা শহরে নিক্ষিপ্ত মার্কিন পরমাণু বোমার ৬ গুণ বেশি। ১৭টি ফরাসি পরমাণু বোমার মধ্যে চারটি খোলা স্থানে এবং ১৩টি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে ফাটানো হয়।

এমনকি ফরাসি উপনিবেশবাদীরা মানবদেহে পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব পরীক্ষার জন্য আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বন্দী হওয়া ২৪ হাজার স্বাধীনতাকামিকে এই ধ্বংসাত্মক পরীক্ষার গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে। এই ২৪ হাজার স্বাধীনতাকামি ছিলেন আলজেরিয়ার জাতীয় মুক্তি ফ্রন্টের যোদ্ধা। আলজেরিয়ার বিজ্ঞানীরা বলছেন এই বিস্ফোরিত পারোমানোবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তা রয়ে যাবে আরো হাজার বছর!

অবশেষে এতসব অত্যাচার, নির্যাতন এবং রক্তের স্রোত পেরিয়ে ১৯৫৪ সাল থেকে শুরু হওয়া ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আলজেরিয়দের স্বাধীনতা সংগ্রাম ১৯৬২ সালে এসে জয় লাভ করে। ১৯৬২ সালে ফরাসিরা আলজেরিয়াকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। তবে এই সময়ের মধ্যেও অভিযান ও বিচারের নামে আরো অন্তত ১০ লাখ আলজেরিয় মুসলমানকে হত্যা করা হয়।

বলা হয়ে থাকে একটি প্রজম্ম ভুল করলে তথা কারো উপর জুলুম করলে আরেকটি প্রজম্ম এসে পূর্ববর্তীদের জন্য ক্ষমা চাইবে সভ্যতার আলো মানুষকে তাই শিক্ষা দেয়। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মানবাধিকারের ধ্বজাধারী ইউরোপীয়ানরা তথা ফরাসিরা কিন্তু আজও আলজেরিয়ায় চালানো গণহত্যার বিষয়ে কোনো ধরণের ক্ষমা চায়নি। ২০১২ সালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ স্বাধীনতাযুদ্ধে আলজেরিয়ার জনগণের ওপর চালানো ‘হত্যাযজ্ঞের’ কথা স্বীকার করেছিলেন বটে তবে ওই নির্মমতার জন্য ফ্রান্সের পক্ষ থেকে তিনি ক্ষমা চাননি! বরং এখনো পর্যন্ত আলজেরিয়ার রাজনীতিতে নানাভাবে ফরাসি সরকার অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে। স্বাধীনতার পরে আলজেরিয়া জুড়ে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার মূল ক্রিড়ানক ছিলও ফ্রান্স!!

(তথ্যসূত্র বিভিন্ন লেখা থেকে সংগ্রহ করা)

পঠিত : ৪৮৫ বার

মন্তব্য: ০